অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের এক মাস চার দিনের মাথায় দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রথমবারের মত ব্যবসা সংলাপে অংশ নেন প্রধান উপদেষ্টা।
Published : 12 Sep 2024, 10:02 PM
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের মাধ্যমে নিরাপদে ও আস্থার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করার পরিবেশ তৈরির বিষয়ে ব্যবসায়ীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এ সমস্যা থেকে উত্তরণ দ্রুত হবে।
এসময় সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান আমাদের নতুন বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আসুন আমরা নতুন তরতাজা বাংলাদেশ গড়তে একসঙ্গে কাজ করি।”
বৃহস্পতিবার রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশ (আইসিসিবি) আয়োজিত ন্যাশনাল বিজনেস সংলাপে তিনি এ আহ্বান জানান।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের এক মাস চার দিনের মাথায় দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রথমবারের মত এ ব্যবসা সংলাপে অংশ নেন প্রধান উপদেষ্টা।
আইসিসিবির সভাপতি মাহবুবুর রহমান অসুস্থ থাকায় তার পক্ষ থেকে সংলাপের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন।
দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ তৈরির অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ”এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি আমাদের জন্য এক নম্বর অগ্রাধিকার।”
শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা কাটানো না গেলে মীর নাসিরের শঙ্কা বিপুল জনগোষ্ঠীর বড় অংশ অংশ কর্মহীন হয়ে যেতে পারে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি করবে।
তিনি বলেন, “শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন বহিরাগতদের উস্কানিতে শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে। এমনকি শ্রমিক সংগঠনগুলোও এই কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় বলে বিবৃতি দিচ্ছে। এ সকল দুষ্কৃতকারীরা ব্যবসায়িক স্থাপনা, শিল্প- কারখানায় ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ চালাচ্ছে।
“দুষ্কৃতকারীদের হামলার কারণে এ যাবৎ প্রায় আনুমানিক ১০০টির অধিক কারখানায় ভাংচুর চালানো হয়েছে এবং অবস্থা বেগতিক দেখে ২০০ এর অধিক কারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছে। এতে আনুমানিক ৫,০০০ কোটি টাকার অধিক ক্ষতি হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।”
এতে রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানার উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা প্রত্যক্ষভাবে কর্মসংস্থান হ্রাস করবে। আমরা অবিলম্বে সকল শিল্পাঞ্চলে যৌথবাহিনীর অধিকতর উপস্থিতি সার্বক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করার জন্য জোরালোভাবে আবেদন জানাচ্ছি।”
অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ অবশ্য এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ‘গেল ১৫ বছরের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ’।
তিনি বলেন, “১৫-১৬ বছরের পুঞ্জিভূত সমস্যা রয়েছে, সেটা হয়েছে। এটা সারাতে সময় লাগবে। ইন দ্য লং রান, উই আর ডেড। দীর্ঘ সময় আমরা এটি রাখব না। ডেফিনেটলি বেসিক কতগুলো জিনিস আমরা করব।
“অর্থনীতির যে অবস্থা ছিল, আছে… আমি একটা কথা বলি একটা গাড়ি থেমে গেছিল, স্লো হয়ে গেছিল, হুট করে স্টার্ট করা ডিফিকাল্ট। আমরা এটাকে তাড়াতাড়ি সামনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।”
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদও একই রকম পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে দ্রুতই এসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠার আশ্বাস দিয়েছেন।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “মানুষের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ছিল, এর বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে। এইজন্য শিল্পে সমস্যা হচ্ছে। সবাই মিলে কাটিয়ে উঠতে পারব।”
‘শ্রমিক-মালিক-সরকার মিলে এক টিম’
ব্যবসায়ীদের বক্তব্য শোনার পর তরুণদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে সংলাপে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বলেন, “যে কয়টা দিন সরকারে থাকি- আমরা একসঙ্গে কাজ করতে চাই। আমাদের অঙ্গীকার হল-নতুন বাংলাদেশের জন্য যা আছে তা করব। যেন বলে যেতে পারি-এই দেশ আমাদেরকে একটা সুযোগ দিয়েছিল, আমরা সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছি।”
শ্রমিক-মালিকের মধ্যে সরকার সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চায় তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমাদের মেয়াদেকালে আমরা শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে চাই। আমরা এখনও জেনিভা কনভেনশনে যোগ দিতে পারিনি। আমাদেরকে সাহস দিন, এগিয়ে আসুন, আমরা সবাই মিলে আইএলও কনভেনশনে স্বাক্ষর করি।”
‘শ্রমিক-মালিক ও সরকার মিলে’ এক টিম জানিয়ে তিনি শ্রমিকদের যা প্রাপ্য, মালিকদের তাতে শরিক হওয়ার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনায় অনেক বাধা রয়ে গেছে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “ব্যবসায় বাধার কোনো সীমা নেই। ব্যবসা করা এক মহা সংগ্রাম। তবে আমরা এসব বাধা পেরিয়ে যেতে আজ একযোগে সরকার, সরকারের বাইরে সবাই এক পরিবারের সদস্য হিসেবে কাজ করে যাব।”
আস্থা ফেরানো গুরুত্বপূর্ণ
অর্থনীতির চলমান এত সংকটের মাঝে কিছুটা হলেও আস্থা পুনরুদ্ধার হয়েছে বলে তুলে ধরেন অর্থ উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “অর্থনীতির যে অবস্থা এর মাঝে মোটামুটি কনফিডেন্স ফিরে এসেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, আস্থাটা ফিরিয়ে আনা।
“আপনারা বলেছেন, ব্যাংকিং সেক্টরে আস্থা একদম শেষ। বাংলাদেশ ব্যাংক ও আমরা মিলে চেষ্টা করছি ব্যাংকিং সেক্টরে আস্থা ফিরিয়ে আনার। এটা ইম্পর্ট্যান্ট।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “পুঁজিবাজার অনেকটা নেগলেক্টেড আমি বলব। অনেক কথা হয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ে। আমাদের দেশের প্রবলেম হল কী-সবাই ব্যাংক থেকে টাকা নেয়। পৃথিবীর কোনো দেশে ব্যাংক নির্ভর ফাইন্যান্সিং, ইন্ডাস্ট্রি হয় না। আমরা তাই পুঁজিবাজারে দৃষ্টি দিচ্ছি।”
এছাড়া কাস্টমস, ট্যারিফ, এআইটি, ফাইনাল সেটেলমেন্ট হচ্ছে না কেন, অনেক ইস্যু আছে, সেগুলো সরকার বিবেচনায় নিয়েছে বলে তুলে ধরেন তিনি।
সালেহউদ্দিনের ভাষ্য, “মানুষকে কতটা স্বস্তি দিতে পারি, মানুষের জীবিকার… সবাই মোটামুটি যেন ভালো থাকে সেটিই আমাদের কাম্য।
“ব্যবসায়ীদের অনেক বাধা। কিছুটা আরটিফিশিয়াল, কিছুটা রেগুলেটরি। আমরা চেষ্টা যতটা পারা যায় সরিয়ে দেওয়া। এক্ষেত্রে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হবে। আপনারা মুনাফা করবেন কিন্তু এবনরমাল প্রফিট করবেন না অবশ্যই, এটা তো হতে দেওয়া যায় না।“
‘দুর্নীতি করে রাতারাতি’ বিলিওনিয়ার
ক্ষমতাচ্যুত সময়ের সুবিধাভোগী শিল্প গোষ্ঠীর অতীতের আমলনামা তুলে ধরার ক্ষেত্রে পাকিস্তান আমলের সময় থেকে উদ্যোক্তাদের উদাহরণ টেনে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “অনেক উদ্যোক্তা আছেন যারা নিষ্ঠা ও সততার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নানান প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হতে পেরেছেন।
“তারাই আমাদের মূল উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী। তারাই আমাদের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। অনেক সময় গতিশীল অর্থনীতির বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব করেন।”
তিনি বলেন, “কিন্তু কিছু ব্যবসায়ী-শিল্প মালিক সরকারের, বিগত সরকারের আনুকূল্যে নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে রাতারাতি বিলিওনিয়ার হয়ে গেছেন। তারা আপনাদের এবং দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করেছেন। আমরা অর্থনৈতিক বিশ্ব মানচিত্রে বিলিওনারদের সংখ্যা নিয়ে নাম লেখাতে অত বেশি উৎসাহী নই।”
এসময় উপদেষ্টা বলেন, “এই যে বাজার অর্থনীতির অপব্যাখ্যা দিয়ে বিলিওনিয়ার বানানোয় আমাদের কোনো কৃতিত্ব নাই। বরং আপনারা সবাই মিলে ছোট থেকে আস্তে আস্তে বড় হয়েছেন নিষ্ঠার মাধ্যমে, সেটাই আমাদের কাম্য।”
এখন ‘চ্যালেঞ্জ’ এলডিসি
ব্যবসায়ী নেতা মীর নাসির বলেন, “বাংলাদেশ ২০২৬ সালে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে। নিম্ন আয়ের দেশ থাকায় আমরা যে সকল বাণিজ্য সুবিধা ভোগ করছি, সেগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে যাবে এবং আমাদের শিল্প উৎপাদন ও রপ্তানি একটি কঠিন প্রতিযোগিতার মধ্যে চলে যাবে।”
বর্তমানে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে, ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে এলডিসি গ্রাজুয়েশনের নির্ধারিত সময়ের বিষয়টি ভেবে দেখতে তিনি প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা সুযোগ কমে যাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, “আমরা যখন বিভিন্ন দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক, বহু পাক্ষিক চুক্তি করতে যাব, শিল্পের উৎপাদন ও শ্রমিকের দক্ষতা বাড়াতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। নয়তো টিকে থাকতে পারব না।
“কেবল সস্তা শ্রম আর রেমিট্যান্স দিয়ে হবে না। বরং বিনিয়োগ পরিবেশ ও শ্রমিকদের প্রশিক্ষণে যে পরিবেশ দরকার এর জন্য সকলে মিলে কাজ করতে হবে।”
অর্থ উপদেষ্টাও একইরকম সুর মেলান। এলডিসি পরবর্তী সময়ের জন্য তার ভাষ্য, “কম্পিটিটিভ হতে হবে, প্রডাক্টিভিটি বাড়াতে হবে। তখনই আপনারা ডিসেন্ট ওয়ার্ক, ভালো ওয়েজ দিতে পারবেন। সাথে অফকোর্স কিছু রেগুলেটরি সাপোর্ট আপনাদের দিতে চেষ্টা করব।”
উন্নয়ন সহযোগীরাও সব ধরনের সহযোগিতা দিতে আগ্রহী বলে তুলে ধরে তিনি বলেন, “জিএসপি নিয়ে কয়েকেজনের সাথে কথা বলেছি। তারা বলেছে, জিএসপি নিয়ে কিছু শর্ত আছে আর কিছু জাজমেন্ট আছে। আমি তাদের রিকুয়েষ্ট করেছি, দেখা যাক।
‘এভ্রি চেয়ার ওয়ান্টস মানি’
দেশের সামগ্রিক সংকট মোকাবেলায় রপ্তানি বাড়ানো ও বহুমূখীকরণের বিকল্প নেই জানিয়ে ব্যবসায়ীদের অর্থ উপদেষ্টা অনুরোধ করেন, “আপনার এক্সপোর্ট ডাইভারসিফাই করবেন।”
দেশে এত আম কিন্তু জাপান আগ্রহ দেখিয়েও বাংলাদেশ থেকে আমদানি করতে পারে না। পাটের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা, বলেন তিনি।
এ সময় বাংলাদেশের সঙ্গে ভিয়েতনাম ও অন্যান্য দেশের রপ্তানি বহুমুখী না হওয়ার কারণ তার এক বন্ধুর উদ্ধৃতি দিয়ে তুলে ধরেন। বলেন, “আমার এক বন্ধুর সাথে সেখানে (অন্য দেশে) দেখা। আমি তাকে বললাম তুমি এখানে, অথচ বাংলাদেশ খুবই বিউটিফুল। সুন্দরবন আর দেয়ার।
“তিনি (বন্ধু) তখন বলেন, আমি ছয় মাস ছিলাম। এক্সপোর্ট করতে পারি নাই। কারণ এভ্রি টেবল ওয়ান্টস মানি, এভ্রি চেয়ার ওয়ান্টস মানি, এভ্রি ডোর ওয়ান্টস মানি। এটা আপনারা বুঝতে পারেন, কে কেন খায়। টেবিলও খায়, দরজাও খায়। ফ্রাঙ্ক অ্যান্ড ক্লিয়ার কনফেশন।”
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে তিনি ব্যবসায়ীদের সহায়তা চান।