“বুঝেন না আমাদের দেশের অবস্থা, দেখানোর জন্য দেয় আরকি। কম টাকায় বেশি নিতে পারবে, বেশি মানুষকে দিতে পারবে,” বলছিলেন একজন বিক্রেতা।
Published : 06 Apr 2024, 01:27 AM
গুলিস্তানের পীর ইয়ামেনি মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতেই চোখে পড়ল দেওয়ান শাড়ি বিতানের সাইনবোর্ডে লাল অক্ষরে লেখা 'সুলভ মূল্যে জাকাতের শাড়ি পাওয়া যায়'।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপে বিক্রেতারা বললেন, সক্ষম ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ এই ইবাদতের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই তাদের এ ব্যবস্থা।
তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বলছে, জাকাত হিসেবে শাড়ি-লুঙ্গি দেওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে ‘উত্তম চর্চা নয়’। কাপড় না দিয়ে বরং অস্বচ্ছল মানুষকে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করা জাকাতের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
ইসলাম ধর্মে ইবাদতের পাঁচটি স্তম্ভের একটি হলো জাকাত। কোনো মুসলমান ‘নিসাব সম্পন্ন’ সম্পত্তির মালিক হলে, অর্থাৎ সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ করার পর সাড়ে ৭ তোলা স্বর্ণ অথবা সাড়ে ৫২ তোলা রুপা বা সমপরিমাণ অর্থ এক বছর স্থায়ী সঞ্চয় হলে তাকে ওই পরিমাণ সম্পদের বছর পূর্তিতে আড়াই শতাংশ হারে জাকাত দিতে হয়।
কোন কোন খাতে জাকাত দেওয়া যাবে, সে নির্দেশনা কোরআনেই আছে। সুরা তাওবার ৬০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: ‘নিশ্চয়ই জাকাত ফকির, মিসকিন ও সেই সব কর্মচারীর জন্য, যারা সদকা উসুলের কাজে নিয়োজিত এবং যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য। আর দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের (সাহায্যের) জন্য। এটা আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।”
শাড়ি-লুঙ্গি দিয়ে জাকাত আদায়ের একটি প্রবণতা প্রচলিত আছে বাংলাদেশে। দেখা যায়, রোজার শেষ ভাগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণের ঘোষণা দিচ্ছেন স্থানীয় ধনাঢ্যরা। নির্ধারিত দিনে লাইন দিয়ে মানুষ অপেক্ষা করছে জাকাতের কাপড়ের জন্য।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর কেউ কেউ কাপড় পায়, কেউ খালি হাতে ফেরে। জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও বিভিন্ন সময়ে ঘটেছে।
আবার রোজায় বিভিন্ন বিপণিবিতানে নোটিস ঝোলানো দেখা যায়– ‘এখানে জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি পাওয়া যায়’। সেসব কাপড়ের মান নিয়েও প্রশ্ন থাকে।
মিরপুর ১ নম্বর, মিরপুর ১১ নম্বর, নিউ মার্কেট ও গুলিস্তানের পীর ইয়ামেনী মার্কেটসহ ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটে ‘জাকাতের কাপড়’ বিক্রি হয়। তবে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় পীর ইয়ামেনী মার্কেটে। এখানকার বিক্রেতারা বলছেন, রোজার ঈদের সময়ই এ কাপড়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে।
মঙ্গলবার দেওয়ান শাড়ি বিতানে গিয়ে দেখা গেল, যে শাড়িগুলো জাকাতের কাপড় হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে সেগুলো দোকানের এক কোণে জড়ো করে রাখা হয়েছে। মোটা সুতার কাপড়গুলোর বুননও ভালো নয়।
বিক্রেতা বললেন, কাপড়গুলো ৪১০ টাকা দামে বিক্রি করা হচ্ছে, ব্যবহার করা যাবে ‘এক বছর’।
“বিভিন্ন দামের কাপড় আছে, যার যেমন তৌফিকে কুলায় সে জাকাতের জন্য তেমনটা নেয়। চলে বেশি ৪১০ টাকারটাই। ঈদ এলেই এগুলো বেশি বিক্রি হয়।”
পাশের দোকান মাহবুব লুঙ্গি স্টোরেও নিম্ন মানের এক গাদা লুঙ্গির উপর জাকাতের নোটিস ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
বিক্রেতাদের একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, লুঙ্গিগুলো বিক্রি করা হচ্ছে ২২০ টাকা দামে। জাকাতের লুঙ্গি হিসেবে ক্রেতারা এগুলোই দুই থেকে পাঁচ হাজার করে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
এই কাপড়গুলো জাকাতের জন্য আলাদা করার কারণ জানতে চাইলে রাহুল নামের ওই বিক্রেতা বললেন, “এটা মাহাজন লাগাইছে। রেট কম তাই। কম রেটের কাপড়গুলোই জাকাত হিসেবে বেশি বিক্রি হচ্ছে।
“২২০ টাকা দাম কী কোয়ালিটি হবে, বুঝেনইতো। মোটা কাপড়, আরামও কম। এগুলা টিকে না বেশি দিন, ক্রেতারা চায় তাই আনা হয়।”
মিরপুর ১১ নম্বরের মোহাম্মদীয়া মার্কেটে গিয়ে জাকাতের জন্য ক্রেতারা কোন কাপড়গুলো কিনছেন জানতে চাইলে, ব্যবসায়ীরা কিছু নিম্ন মানের শাড়ি দেখিয়ে বলেন, এগুলোই বিক্রি হচ্ছে ‘জাকাতের কাপড়' হিসেবে।
কোনো দোকানদার কাপড়গুলো ফেলে রেখেছেন দোকানের বাইরে, কেউ আবার দোকানের এক কোনায় রেখেছেন কোনো রকমে।
তাদের ভাষ্য, এই মার্কেটে জাকাতের কাপড় হিসেবে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা দামের কাপড়গুলোর চাহিদা বেশি।
এ হোসেন শাড়ি সেন্টারের বিক্রেতা আরিফ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেমন দামে কাপড় নেবে, মানও তেমন হবে- সেটাই স্বাভাবিক। মানুষ ভাবে গরিব মানুষরে দেবে, তাই দামি জিনিস নিতে চায় না।”
অনামিকা শাড়ি কর্নারের বিক্রেতা কামরুল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কাপড়গুলো পাতলা; মোটামুটি কোয়ালিটির। কেউ তো আর প্রতিদিন পরবে না, একবছর চলবে আর কি।”
মিরপুর-১ নম্বরের মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের বিক্রেতারাও বাইরে জমিয়ে রাখা কাপড়গুলো দেখিয়ে বললেন, এগুলোই ক্রেতারা লট বেঁধে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন জাকাত দেওয়ার জন্য। এই মার্কেটেও ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে কাপড়গুলো।
শারমিন শাড়ি কুটিরের স্বত্বাধিকারী মো. রিয়াজ চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “কাপড়গুলা মোটা সুতার। পরতে তেমন আরাম হয় না। বুঝেন না আমাদের দেশের অবস্থা, দেখানোর জন্য দেয় আরকি। কম টাকায় বেশি নিতে পারবে, বেশি মানুষকে দিতে পারবে।”
এই ‘দেখানোর’ কিছু নমুনা পাওয়া গেল ফেইসবুকে। অনেকেই জাকাত দেওয়ার জন্য কাপড় কিনে সেই ছবি শেয়ার করেছেন।
এমডি মুকবুল নামে একজন ফেইসবুকে লিখেছেন, “আলহামদুলিল্লাহ আজকে জাকাতের কাপড় কেনার জন্য বাবুরহাট কাপড়ের বাজারে গিয়েছিলাম…. আল্লাহর রহমতে ভালো ভালোই কাপড় নিয়ে ফিরে এসেছি।”
নরসিংদীর শেখেরচরের বাবুরহাট মার্কেটের আমেনা প্রিন্ট শাড়ি দোকানের বিক্রেতা মাসুদ রানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, তারা জাকাতের শাড়ি বিক্রি করছেন ৩১০ টাকা দামে।
“এই শাড়িগুলো এই সিজনের জন্যই করা হয়। আসলে মানুষের মন তো, শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষই দেখানোর জন্য জাকাত দেয়। অনেকে ২৫০ টাকার কাপড়ও নেয়। এগুলো দেখানোর জন্য।”
কাপড়ের মান কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, একাধারে ব্যবহার না করলে মাস ছয়েক চলবে।
“এক টাকা দিয়ে যা পাওয়া যাবে, দুই টাকা দিয়ে কিন্তু এর চেয়ে ভালোটা কিনতে পাওয়া যাবে। দুই টাকা দিয়ে যে চকলেটটা দিবে, এক টাকা দিয়ে তো তা দিবে না– এই কাপড়গুলোও তেমনই হবে।
“তবে কারোর সামর্থ্য বেশি থাকলে সে ভালোটাও নেওয়ার চেষ্টা করে।”
মিরপুর ১২ নম্বরের কালাপানি এলাকার গৃহকর্মী জাহানারা বেগম জানালেন, প্রতি বছর তিনি ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে গিয়ে জাকাতের শাড়ি পান।
“একজন দেয় শাড়ি কাপড়, মাইকে বলে দেয় আগে। মানুষ লাইন ধরে আনতে যায়। তাও নতুন কিছু একটা পাই, কয়েকদিন চলে আরকি। আরেকটু ভালো হইলে আরো কিছুদিন চলত।”
জাকাত হিসেবে যারা প্রতি বছর কাপড় বিতরণ করেন, তাদের যুক্তি কী?
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর এলাকার বাসিন্দা তকদির হোসেনও প্রতি রোজার ঈদে নিজের এলাকায় জাকাতের শাড়ি লুঙ্গি দেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, "অনেকে আশা করে থাকে যে ঈদে তাদের জন্য কিছু নিয়ে যাব৷ আর টাকা দিলে তারা অন্যভাবে খরচ করে ফেলে, কাপড় কেনে না। তখন পরনের পোশাকও থাকে না৷ তাই আমি তাদের জন্য নতুন কাপড় কিনেছি, সাথে ঈদের জন্য সেমাই চিনিও কিনেছি৷"
কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মো. আব্দুল রশিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, এভাবে জাকাত দেওয়া ‘ঠিক না’।
“যত টাকা আসবে তা হিসাব করে এমনভাবে দিতে হবে যাতে তার দারিদ্র্য দূর হয়ে যায়। এরকম যদি পাঁচজনের দারিদ্র্য দূর করতে পারে, তাহলে আস্তে আস্তে দেশের দারিদ্র্যও দূর হয়ে যাবে। আর এগুলো নিতে গিয়ে মানুষ মারাও তো যায়, তাদের তাচ্ছিল্য করা হয়, সম্মানজনক আচরণ করা হয় না।
“একজন জাকাত নিতে পারে এটা আল্লাহর নির্দেশ, কিন্তু তাকে ছোট জ্ঞান করা জায়েজ নয়।”
আব্দুল রশিদ বলেন, জাকাত হিসেবে নিম্ন মানের কাপড় দিয়ে গরিব মানুষদের আসলে ‘ঠকানো’ হচ্ছে, আন্তরিকতারও অভাব থাকছে।
“একটা কাপড় ২০০ টাকায় কিনল, দোকানদার তো সেখানে ২০ টাকা লাভ করবে। সেক্ষেত্রে তার তো ২০০ টাকা জাকাত আদায় হল না। কারণ পুরো টাকাটা গরিব লোক পায়নি।”
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জাকাত ফান্ড বিভাগের পরিচালক হারুনুর রশিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জাকাত হিসেবে শাড়ি কাপড় দেওয়াটা ইসলামের সঙ্গে ‘সমাঞ্জস্যপূর্ণ নয়’।
“এটা যারা করেন তারা নিজেদের সুনাম কুড়ানোর জন্য করে থাকেন। জাকাতের মূল দর্শন হল মানুষকে স্বাবলম্বী করা। আজকে যিনি জাকাত নিয়েছেন, তাকে যাতে পরবর্তী বছর জাকাতের জন্য হাত পাততে না হয়, এমনভাবে দিতে হবে।”
কীভাবে জাকাত আদায় করতে হবে সে বিষয়ে তিনি বলেন, “প্রথমে কত টাকা জাকাত এসেছে তার হিসাব নিকাশ সেরে বণ্টনে যেতে হবে। শাড়ি লুঙ্গির চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।
“কাউকে স্বাবলম্বী করে দিতে হবে, নাহলে অন্তত এমন একটা কিছু করতে হবে যাতে সে আয় করতে পারে। যেমন- রিকশা কিনে দেওয়া, সেলাই মেশিন, ভ্যান গাড়ি ইত্যাদি কিনে দেওয়া যেতে পারে। যে জাকাত নিল, সে যেন আয়ের একটা উৎস খুঁজে পায়।”