পোশাক খাতের এক সময়ের শীর্ষস্থানীয় এই উদ্যোক্তার মালিকানাধীন এক কোম্পানি ফেব্রিক্স আনার ঘোষণা দিয়ে আমদানি করে ১২ কোটি টাকার বেশি বিদেশি মদ।
Published : 16 Sep 2024, 01:03 AM
কাপড় আমদানির ঘোষণার আড়ালে কন্টেইনার ভর্তি বিদেশি মদ আনার অভিযোগে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান সিনহার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ।
পোশাক খাতের পথিকৃত উদ্যোক্তাদের একজন হিসেবে পরিচিত আনিসুর রহমান সিনহার বিরুদ্ধে এ মামলা হয়েছে সুপ্রিম স্মার্ট ওয়ার লিমিটেডের নামে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি হওয়ায়। মামলার এজাহারে তাকে এ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের আদমজী ইপিজেডের এ কোম্পানি ফেব্রিক্সের ঘোষণা দিয়ে ১১ হাজার ৬৭৬ লিটার বিদেশি মদ আমদানি করে বলে এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মাসুদ হাসান বন্দর থানায় শুক্রবার এ মামলা দায়ের করেন।
আমদানিকারক কোম্পানিটির পাশাপাশি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এবং জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে পণ্য খালাসের চেষ্টায় সংশ্লিষ্ট আটজনকে মামলায় আসামি করা হয়েছে।
এ রাজস্ব কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফেব্রিক্স ঘোষণায় এক কন্টেইনার বিদেশি মদ আমদানি করেছিল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটি। এক্ষেত্রে দায়ীদের শনাক্ত করতে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল।
“এ কমিটি প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে ফৌজদারি মামলার জন্য সুপারিশ করে। পরে কমিশনার স্যারের নির্দেশে আমি এজাহার দায়ের করি।”
এর আগে গত ৪ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে ফেব্রিক্স ঘোষণায় চট্টগ্রাম বন্দরে আসা পণ্যভর্তি একটি কনটেইনার পরীক্ষা করে ১১ হাজার ৬৭৬ লিটার বিদেশি মদ জব্দ করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের অডিট, ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড রিসার্চ (এআইআর) শাখা গভীর রাত থেকে সকাল পর্যন্ত ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের কন্টেইনারের কায়িক পরীক্ষা করে ১১টি বিদেশি ব্র্যান্ডের এসব মদ জব্দ করে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের উপ কমিশনার এ কে এম খায়রুল বাশার বলেন, এগুলোর শুল্ক ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার মত হতে পারে।
“এখনও প্রাথমিক মূল্যায়ন হয়েছে। অ্যাসেসমেন্টের কাজ চলছে। এটি ১২ কোটি টাকার কম হওয়ার কথা না।”
এ ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত শেষে আনিসুর রহমান সিনহাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করল চট্টগ্রাম কাস্টম।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে আনিসুর রহমান সিনহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাংবাদিক পরিচয় শুনে ফোন কেটে দেন। এরপর আরও অনেকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি।
পরে পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর নিবন্ধন তালিকায় থাকা আনিসুর রহমান সিনহার যে নম্বর দেওয়া রয়েছে সেটিতে ফোন করা হলে নম্বরটি আর ব্যবহার করা হচ্ছে না বলে দেখায়।
পোশাক খাতের শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তাদের একজন আনিসুর রহমান সিনহার মালিকানাধীন ওপেক্স সিনহা গ্রুপের কোম্পানিগুলো এক সময় সফলতায় ছিল আকাশচুম্বী। ১৯৮৪ সালে যাত্রা শুরু করা এ গ্রুপের বার্ষিক আয় ৫০০ মিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছেছিল। কারখানাগুলোতেও কর্মীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৫ হাজার।
ফেব্রিক্সের বদলে এল ১১ হাজার লিটার বিদেশি মদ
নারায়ণগঞ্জে বিশাল এলাকাজুড়ে কোম্পানিটির কারখানা এশিয়ার বৃহত্তম কারখানা হিসেবে পরিচিত পায়। পোশাক খাতের রপ্তানিকারকদের মধ্যে আলোচনা ছিল ওপেক্স গ্রুপের এমন এক সময় ছিল, যখন পোশাকের ক্রয় আদেশ দেওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকতেন বিদেশি ক্রেতারা। স্বর্ণ যুগ ফেলে আসা এ গ্রুপের যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও হংকংয়ে তিনটি লিয়াজোঁ অফিসও ছিল।
তবে বেতন নিয়ে শ্রম অসন্তোষসহ নানা কারণে এ গ্রুপের অনেক কারখানা লে-অফের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন সংকটের কারণে ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসা ওপেক্স গ্রুপ ২০২১ সালে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে তাদের পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে।
এজাহারে যা বলা হয়েছে
সুপ্রিম স্মার্টওয়্যার লিমিটেড নারায়ণগঞ্জের আদমজি ইপিজেডের একটি কোম্পানি। কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, এটি প্রায় আড়াই বছর ধরে বন্ধ।
ইপিজেডের কোম্পানির পণ্য আমদানিতে মানতে হয় বিশেষ কিছু নিয়মও। এক্ষেত্রে নিয়ম মানা হয়নি। কোম্পানিটির আইডি-পাসওয়ার্ডের অপব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
মিথ্যা ঘোষণায় বিদেশি মদ আমদানির মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে, “আমদানিকারকক প্রতিষ্ঠান সুপ্রিম স্মার্টওয়্যার লিমিটেড চীনের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জিয়াংশু হাই হোপ ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন হতে ১০০ শতাংশ রপ্তানিকারক পোশাক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ফেব্রিক্স ঘোষণায় এক কন্টেইনার পণ্য আমদানি করে।
গত বছরের ১৮ ডিসেম্বরে আমদানিকারকের মনোনীত সিএন্ডএফ এজেন্ট হাফিজ হাফেজ ট্রেডিং প্রাইভেট লিমিটেড কর্তৃক অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করেন।
”চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার এর নিকট হতে প্রাপ্ত গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রিস্ক ম্যানেজমেন্ট এর মাধ্যমে কাস্টম হাউসটির অডিট, ইনভেস্টিগেশন এন্ড রিসার্চ (এআইআর) এবং পোর্ট কন্ট্রোল ইউনিট (পিসিইউ) শাখা কর্তৃক বিশ্লেষণ পূর্বক পণ্যচালানটিতে অসত্য ঘোষণায় মদের চালান থাকার বিষয়ে প্রাথমিক তথ্য পাওয়া যায়।”
পরে ওই চালানের কায়িক পরীক্ষা করে কন্টেইনারে ‘জ্যাক ড্যানিয়েল, পাসপোর্ট স্কচ, সিভাস রিগ্যাল, ব্ল্যাক লেবেল’ এর মত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ১১ হাজার ৬৭৬ লিটার মদ পাওয়া যায় বলে মামলায় বলা হয়।
তদন্তে কী মিলল
মূল্য হিসাব করলে ১৩ থেকে ১৪ কোটি টাকার পণ্য এখানে ছিল বলে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে অবস্থিত আটলান্টিক ইন্টারন্যাশনালে সরেজমিনে গিয়ে সরবরাহ আদেশ (ডিও) প্রাপ্তির লক্ষ্যে সিএন্ডএফ এজেন্ট প্রতিনিধি কর্তৃক শিপিং এজেন্ট কর্তৃপক্ষের নিকট দাখিল করা দলিলাদির কপি সংগ্রহ হয়। এছাড়া সরবরবাহ আদেশ প্রাপ্তির লক্ষ্যে শিপিং এজেন্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগকারী সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিনিধি হিসেবে তিনজন ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়।
এ তিনজন হচ্ছেন- রাজীব ওরফে আরাফ হোসেন রাজু, রিপন ও মিজানুর রহমান।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ”এ তিনজন জালিয়াতির মাধ্যমে দলিলাদি সৃজনপূর্বক শিপিং এজেন্ট আটলান্টিক ইন্টারন্যাশনালের সহিত যোগযোগপূর্বক পণ্য চালানটি খালাসের অপচেষ্টা করেন। প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ তিনজন ব্যক্তি আলোচ্য পণ্যচালানটি খালাসের অপচেষ্টার সহিত জড়িত মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে বলে জানান তদন্ত দল।“
চালানটি খালাসে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট হাফিজ ট্রেডিংয়ের দলিল যাচাই করে দেখা যায় আটলান্টিক ইন্টারন্যাশনালের নিকট দাখিল করা পরিচয়পত্রটি জাল বলে দেখতে পায় তদন্ত দলে।
”দাখিলকৃত পরিচয় পত্রে যার ছবি রয়েছে তার নাম আশরাফ হোসেন রাজু কিন্তু পরিচয়পত্রে ভুয়া নাম ঠিকানা ব্যবহার শিপিং এজেন্ট প্রতিষ্ঠান হতে জানা যায়, পরিচয় পত্রে ব্যবহৃত ব্যক্তি আশরাফ হোসেন রাজু সরেজমিনে শিপিং এজেন্ট প্রতিষ্ঠানে গমনপূর্বক সরবারহ আদেশ প্রাপ্তির চেষ্টা করেছেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদনে ফৌজদারি মামলার সুপারিশ করে তদন্ত দল।