“আমরা পদ্মার (পদ্মা অয়েল) মনোপলি থেকে মুক্তি চাই। যদিও এটা কমিশনের ব্যাপার নয়। এজন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই আমরা।”
Published : 23 Mar 2025, 05:57 PM
উড়োজাহাজের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত জেট এ- ১ তেলের দাম নিয়ে গণশুনানিতে এসে দেশিয় এয়ারলাইন্সগুলো আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দ্বিগুণ দামে তেল কেনার অভিযোগ করেছেন।
এয়ারলাইন্সগুলো বলেছে, বিমানবন্দরে একমাত্র তেল সরবরাহকারী রাষ্ট্রীয় কোম্পানি পদ্মা অয়েলের কাছে অনেকটা জিম্মি তারা।
জেট ফুয়েল সরবরাহের জন্য পারটেক্স পেট্রো, ইস্টার্ন রিফাইনারির মতো দেশি কোম্পানিগুলোকে সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) প্রথমবারের মতো তরল কোনো জ্বালানির দাম নির্ধারণ নিয়ে রোববার এ গণশুনানি করে।
সেখানে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) পক্ষ থেকে বলা হয়, এখন দেশের রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্স বিমানসহ সবগুলো বেসরকারি এয়ারলাইন্স নগদ টাকায় জ্বালানি কিনছে। তবে বিমানের কাছে এখনো বিপিসির পুরনো বকেয়া আছে ১৭০০ কোটি টাকা।
দীর্ঘ চার ঘণ্টা শুনানির পর বিইআরসি চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ আগামী মাসে জেট ফুয়েলের দর নির্ধারণের কথা বলেছেন।
এ সময়ের মধ্যে অংশীজনদের কেউ চাইলে লিখিতভাবে কমিশনের কাছে প্রস্তাব পাঠাতে পারবে।
রোববার সকালে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে বিইআরসির কার্যালয়ে গণশুনানিতে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বেশ কয়েকটি প্রশ্ন তোলেন।
বাংলাদেশের বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোর সংগঠন এওএবির পক্ষে কথা বলেন নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান ও এয়ার অ্যাস্ট্রার সিইও ইমরান আসিফ। পৃথকভাবে কথা বলেছেন ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার হাবিবুর রহমান আকন্দ।
কথা বলার জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রতিনিধিদের ডাকা হলে তারা বলেছেন, তাদের সব কথা এসে গেছে। তাই বলার কিছু নেই। গণশুনানিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং জ্বালানি ও খণিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরাও কথা বলেন।
বক্তব্য দিতে গিয়ে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম জ্বালানি খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের পরেও কেন দাম কমছে না, চুরি বন্ধ হচ্ছে না, রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানিগুলোর পরিচালক পদে থাকা সরকারি কর্মকর্তারা কেন মিটিং প্রতি আনুতোষিক পাবেন এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
লভ্যাংশের টাকা থেকে তেল কোম্পানির সুরম্য ভবন, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ করাকে বিলাসিতা বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, “আপনারা বলছেন ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। কিন্তু তার ফল কোথায়? তেলের দাম কমেনি কেন? যখন কোনো উন্নয়নের লক্ষ্য থাকে কস্ট এবং শ্রম কমানো, দেশের জ্বালানি খাতে এসে উন্নয়নের সংজ্ঞা বদলে গেল। জ্বালানি চুরি বন্ধ করতে আপনারা কী এমন করেছেন? চুরি বন্ধ হয়নি। আমরা চুরি বন্ধের পক্ষে।”
এসময় বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, এগুলো নিয়ে বিপিসির চেয়ারম্যানকে জানানো হয়েছে।
আর এ খাতে কোনো প্রকল্প প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর আগে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কাছে পাঠাতে হবে জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, “আমি এর মধ্যে পিডিবিকে চিঠি লিখেছি। তাদের বলেছি প্রকল্প প্রস্তাব আগে আমাদের এখানে পাঠাতে।”
এওএবির পক্ষে নভোএয়ারের এমডি মফিজুর রহমান বলেন, “একটা উড়োজাহাজের মোট অপারেশনাল কস্টের ৪০ থেকে ৪৬ শতাংশ হচ্ছে ফুয়েল কস্ট। আমাদের আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দ্বিগুণ দামে ফুয়েল কিনতে হচ্ছে। তাতে ওভারঅল কস্ট বাড়ছে, যার কারণে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলো ব্যাংকরাপ্ট হচ্ছে। আমরা আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ী ফুয়েলের দাম নির্ধারণের দাবি জানাই। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে এখানে বাড়ে, কিন্তু পরে আর কমে না। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে এখানেও তেলের দাম কমাতে হবে।”
বিমানবন্দরে একাধিক তেল সরবরাহকারী রাখার দাবির জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা পদ্মার (পদ্মা অয়েল) মনোপলি থেকে মুক্তি চাই। যদিও এটা কমিশনের ব্যাপার নয়। এজন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই আমরা।”
তিনি বলেন, “পারটেক্স রিফাইনারি এসছে, যখন আমাদের এখানে ফুয়েলের দাম ১৩১ টাকা, তখন পারটেক্সের এমডি সাহেব আমাদের বলেছেন ৮০ টাকা করে তিনি দিতে পারবেন। কোথায় ১৩১ টাকা আর কোথায় ৮০ টাকা। আমরা যদি এ ধরণের মাল্টিপল অপশন পাই তাহলে আমাদের উচ্চমূল্য দিতে হবে না। আমরা আশা করব যতদিন মাল্টিপল অপারেটর না আসে ততদিন যেন আমরা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ যৌক্তিক মূল্যে ফুয়েল কিনতে পারি সে বিষয়ে কমিশন ব্যবস্থা নেবে।”
মফিজুর রহমান জেট ফুয়েলের একটি মূল্য তালিকা দেখিয়ে বলেন, “ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরবের বিমানবন্দরগুলোর চেয়ে ঢাকায় তেলের দাম বেশি। ঢাকায় এখন কিনতে হচ্ছে প্রতি লিটার ৭৫ সেন্ট হিসেবে। আর অন্য জায়গায় সেটা ৫৫ থেকে ৬৩ সেন্টের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে।”
ইউএস বাংলার প্রতিনিধি হাবিবুর রহমান আকন্দ বলেন, “যখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ছিল লিটার প্রতি ৯৫ সেন্ট, তখন আমাদের এখানে দাম নেওয়া হতো ১১১ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ৭৫ সেন্ট হওয়ার পরেও কিন্তু ১১১ টাকাই নেওয়া হতো। আরেকটা হচ্ছে এখানে আমরা যা কিনছি সবই সরাসরি ইম্পোর্টেড ফুয়েল। আর এখানে পারটেক্স পেট্রো বা আমাদের ইস্টার্ন রিফাইনারির জেট ফুয়েলের হিসাবটা কই।”
এসময় বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) এ টি এম সেলিম বলেন, “(জ্বালানি) শুধু একবারই দিয়েছিল পারেটক্স। এরপর তারা চেষ্টা করেছিল কিন্তু সেটা কোয়ালিটি মিট করে নাই।”
ইউএসবাংলার কর্মকর্তা হাবিবুর বলেন, “ইন্ডিয়াতে আন্তর্জাতিক বাজারের কাছাকাছি দরে ফুয়েল দিচ্ছে। কারণ তারা নিজেরা ক্রুড (অপরিশোধিত) এনে সেগুলোকে রিফাইন করে জেট ফুয়েল বানিয়ে কম টাকায় বাজারে আনতে পারছে। আমাদের এই রিফাইনারিগুলোকে যদি প্রমোট করা হয় তাহলে তারাও অবশ্যই পারবে।”
বিপিসির জিএম এ টি এম সেলিম বলেন, “এখন পর্যন্ত বিমানের তেলের দাম বাবদ ১৭০০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে বিপিসির কাছে। ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এই বকেয়া জমেছে। এখন বিমান নগদ অর্থে তেল কিনছে। আর প্রতি মাসে তারা ১৫-২০ টাকা বকেয়া হিসেবে পরিশোধ করছে বিমান।”
তেলের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে জনতাকে ঠকাতে নানা যুক্তি দেন কর্মকর্তারা এমন অভিযোগ তুলে সাংবাদিক সিরাজুল ইসলাম বলেন, “তেলের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে এতদিন পর্যন্ত বিপিসির কর্মকর্তারা ভারতের সঙ্গে তুলনা করে সেখানকার চেয়ে বেশি দাম নির্ধারণ করে আসছেন। তাদের যুক্তি ছিল, ভারতের চেয়ে বেশি দাম না হলে তেল পাচার হয়ে যাবে।
“কিন্তু চিনি, পেঁয়াজ বা অন্যান্য দ্রব্যের ক্ষেত্রে তো এমন হয় না। সেখানকার চিনি বা পেঁয়াজ পাচার হয়ে আসবে বা যাবে এমনতো কেউ ভাবছে না। পাবলিককে ঠকাতে যেভাবে যে কথা বললে সুবিধা হবে তারা সেখানে সেই কথা বলেন। কলকাতায় যাবে না আসবে এসব যেন বিবেচনায় নিয়ে জেট ফুয়েলের দাম নির্ধারণ করা না হয়।”
শুনানির শেষদিকে বিপিসির জিএম এ টি এম সেলিম অভিযোগ খণ্ডন করে বলেন, “কোভিডের সময় জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমে যায় কিন্তু বিপিসি দাম কমায়নি। আসল কথা হল বিপিসি যখন আমদানি করেছিল তখন তেলের দাম বেশি ছিল। কিন্তু কোভিডের সময় উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে সেই তেল বিক্রি হয়নি। পরে আগের বাড়তি দামেই সেই জ্বালানি বিক্রি করতে হয়েছে। যে কারণে সেই সময় অন্যান্য দেশের চেয়ে দাম কিছুটা বেশি ছিল।”
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার পরেও দেশে দাম না কমানোর ব্যাখ্যায় সেলিম বলেন, “সেটা হয় ডলার রেটের কারণে। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে ৯৫ সেন্ট ছিল তখন নিয়েছিল ১১১ টাকা। পরে সেটা দাম কমে ৭৫ সেন্ট হলেও ডলারের রেট বেড়ে ১২২ টাকা হয়ে যাওয়ায় এখানে দাম আরও ১ টাকা বেড়ে যায়। আরেকটা বিষয় হলো আমরা তেলটা আমদানি করি ডলারে। ডলার হিসাব করার সময় আমাকে দেওয়া হচ্ছে ১২২ টাকা রেটে। আমি কিন্তু পেমেন্ট করছি ১২৩ টাকায়। এখানে কিন্তু আমার এক টাকা করে লস হয়ে যাচ্ছে। এটা বিবেচনায় আনা দরকার।
“আমাদের জ্বালানি তেলের যে অবকাঠামো তাতে আমরা ৩০ দিন পর্যন্ত তেল মজুদ রাখতে পারি। আরেকটা পার্সেল সমুদ্র পথে আসতে আসতে তেলের মজুতটা কমে যায়। এখন প্রতিদিন ১৬০০ টন করে বিক্রি হচ্ছে। গত কয়েকমাসের ট্রেন্ড দেখলে আমরা বুঝতে পারি তেলের বিক্রি বেড়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো থার্ড টার্মিনাল চালু হলে আরও বেড়ে যাবে।”
তরল জ্বালানির দাম নির্ধারণ কমিশনের জন্য ‘নতুন শুরু’ উল্লেখ করে বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, “আমরা আশা করি এটা একটা নতুন শুরু। আমরা বিদ্যুতের দাম অনেক দিন থেকে করতেছি। গ্যাসের দাম ২০০৮ থেকেই হচ্ছে। এখন আমরা তরল জ্বালানির দাম নির্ধারণ শুরু করেছি। ফার্নেস ওয়েল ইজ ইন দ্য লাইন। তিনটা কোম্পানির প্রস্তাব আসলে পরে আমরা ফার্নেস ওয়েল নিয়ে আলোচনা করব।”