ব্রয়লার মুরগি: কাজীর উৎপাদন খরচ ১৩০, বাজারদর ২৫০

কাজী ফার্মসের প্রতিনিধির দাবি, বাজারের চাহিদা দাম ঠিক করে দেয়। এখন লাভ করলেও আগে লোকসান গুনেছেন তারা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 March 2023, 04:17 PM
Updated : 9 March 2023, 04:17 PM

বাজারে কেজি প্রতি আড়াই শ বা তার চেয়ে বেশি দরে বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ তার অর্ধেকের কাছাকাছি।

খামারিদের খরচ পড়ে কেজিতে ১৫০ থেকে ১৬৭ টাকা, আর করপোরেট কোম্পানির ক্ষেত্রে তা ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা বলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক সভায় প্রকাশ পেয়েছে।

পোলট্রি খাতে জড়িত সব পক্ষের অংশগ্রহণে এই মতবিনিময়ে এটাও প্রকাশ পেয়েছে, মুরগি উৎপাদনকারী বড় করপোরেট, পাইকার আর খুচরা ব্যবসায়ী, তিন পক্ষই মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা করছে। আর এই বিষয়টি যেন প্রকাশ না পায়, তাই কোনো পর্যায়েই কোনো রশিদ দেওয়া হয় না।

এই তথ্য জেনে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে সর্বোচ্চ দর ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবেন।

বৃহস্পতিবার ঢাকার কারওয়ার বাজারে টিসিবি ভবনে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কার্যালয়ে হয় এই মতবিনিময়।

খামারিদের সংগঠন পোল্ট্রি অ্যাসোশিয়েশনের অভিযোগ, করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছে ‘জিম্মি’ ছোট খামারিরা। সমিতির সভাপতির জানালেন, মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হয় এসএমএসের মাধ্যমে।

উৎপাদন খরচের প্রায় দ্বিগুণ দর খুচরায়

পাইকারিতে ২০৭ টাকা কেজিতে মুরগি কিনে মোহাম্মদপুর টাউন হল কাঁচাবাজারে আড়াই শ টাকা করে বিক্রি করেন ব্যবসায়ী বেলাল হোসেন। তার এই স্বীকারোক্তির পর বগুড়ার সরবরাহকারী মো. ইসরাফিলের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান।

ইসরাফিল জানান, তিনি বগুড়ায় কাজী ফার্মসের কাছ থেকে ২০৭ টাকা রেটে মুরগি কিনেছেন।

তখন সভায় উপস্থিত কাজী ফার্মসের এমডি ও ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী জাহিন হাসানের ব্যাখ্যা জানতে চান মহাপরিচালক।

কাজী জাহিনের তথ্য বলছে, তারা বাচ্চার উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন। এ কারণে দাম বেড়েছে।

কেন উৎপাদন কমালেন- সে ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “গত বছরের মে, জুন জুলাই ও আগস্ট এবং এ বছরের জানুয়ারিতে বাচ্চার চাহিদা ছিল না এবং সে সময় তা ৮ থেকে ৯ টাকায় নেমে আসে। ওই সময় আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি পোষানোর জন্য উৎপাদন কমানো হয়েছিল। বাচ্চার উৎপাদন কমে যাওয়ায় এখন ব্রয়লারের উৎপাদন কমে গেছে। ফলে দাম বেড়েছে।”

তিনি বলেন, “বাচ্চা উৎপাদনে খরচ এখন ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। আমরা বিক্রি করছি ৫৫ টাকায়। আবার বাচ্চার উৎপাদন বাড়লে দাম কমবে। তখন মুরগির দামও কমে আসবে। এটা একদিনে হবে না। আস্তে আস্তে হবে।”

বাচ্চাপ্রতি প্রায় ১৫ টাকা লাভ করা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ভোক্তা মহাপরিচালক। উত্তরে কাজী জাহিন হাসান বলেন, “এটা একটা ‘মার্কেট প্রাইস’, এখানে কোনো কারসাজি নাই। কারসাজি করলে কখনও বাচ্চা ৮ টাকায় বিক্রি হত না।”

মুরগির কেজি ২০৭ টাকা কীভাবে নির্ধারণ হয়- জানতে চাইলে কাজী জাহিন বলেন, “আমাদের বিভিন্ন মার্কেটে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়। গতকাল (বুধবার) রংপুরে আমাদের ‘প্রাইস’ (দর) ছিল ১৯০ থেকে ২০৭ টাকা।

“সাধারণ খামারির উৎপাদন খরচ হবে কেজিতে দেড়শ টাকা। আমাদের হবে এর থেকে ন্যূনতম ২০ টাকা কম। আমাদের খামারগুলো অনেক ইফিশিয়েন্ট।”

১৩০ টাকায় উৎপাদন করে ২০৭ টাকায় বিক্রি যৌক্তিক কি না- এই প্রশ্ন করে কাজী ফার্মসের কর্মকর্তার কোনো উত্তর পাননি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।

জবাব না পেয়ে হতাশ হয়ে তিনি বলেন, “উনাদের আর কী বলব?”

কাজী জাহিনকে তখন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, “আপনার উৎপাদন খরচ কত, তা অফিসে জিজ্ঞেস করে আবার কনফার্ম (নিশ্চিত) করুন।”

পরে আবার কাজী জাহিন হাসান বলেন, “এর উৎপাদন খরচ হবে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা।”

এভাবে ‘জেরা’ চলতে থাকায় কিছুটা বিরক্তির সুরে তিনি বলেন, “এক্সকিউজ মি, এটা একটা মার্কেট প্রাইস। মার্কেট প্রাইস এখন হাই (বেশি), এখন আমরা প্রফিট (লাভ) করছি। মার্কেট প্রাইস যখন লো (কম) ছিল, তখন আমরা লোকসান করেছি।”

তার এই বক্তব্যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, “বাজারের সরবরাহ-চাহিদার ওপর ভিত্তি করে সবসময় বাজার নির্ধারণ করতে গেলে কিন্তু কৃষি বিপণন আইনের ব্যত্যয় ঘটবে। আইনে স্পষ্ট লেখা আছে, উৎপাদন ও খরচের পর কত লাভ করতে পারবে। সব লেখা আছে। আপনাদের কথা শুনেই মনে হচ্ছে এগুলো আপনারা অনুসরণ করছেন না।”

বাজার নিয়ন্ত্রণ ‘এসএমএসে’

সভায় পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার অভিযোগ করেন, “ব্রয়লার মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হয় এসএমএসের মাধ্যমে।”

তিনি বলেন, “যখন প্রান্তিক খামারিদের হাতে মুরগি থাকে, তখন করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো দাম কমিয়ে দিয়ে আমাদের ধ্বংস করে দেয়। আর যখন আমাদের হাতে পণ্য থাকে না, তখন তারা দাম বাড়িয়ে দেয়।

“এখন আমাদের হাতে পণ্য নেই, এখন মুরগির কেজিপ্রতি দাম ২৫০ টাকা। সরকার ডিম ও মুরগির দাম নির্ধারণ করলে বাজার স্থিতিশীল থাকবে। কিন্তু গুটিকয়েক করপোরেট কোম্পানির হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ থাকায় মুরগির বাজার এখন অস্থিতিশীল। মূল সমস্যা করপোরেটের এই মেসেজ, ফেসবুক গ্রুপ, এটা বন্ধ করতে হবে।”

সভায় কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রতিনিধি কাজী আব্দুল হান্নান বলেন, “যেই উৎপাদন করুক, আমি কেন তা ২৫০ টাকায় খাব, প্রায় দ্বিগুণ দামে কেন খেতে হবে? প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর উৎপাদককে ‘প্রটেকশন’ (সুরক্ষা) দিতে গিয়ে আমাদের এই জায়গায় নিয়ে এসেছে।”

তিনি বলেন, “এখানে যে এসএমএস সিস্টেম চলছে এটিই বলে দেয় যে বাজারে সিন্ডিকেট আছে। সিন্ডিকেট মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করছে। খামারির নিজস্ব উৎপাদন খরচের ভিত্তিতে একেক জায়গায় একেক রেট হওয়ার কথা। কিন্তু সারাদেশে যখন এক রেট হয়ে যায় তখন সেটাই সিন্ডিকেশন। সিন্ডিকেশন মানেই অবৈধ কাজ।”

এই বক্তব্যের সমর্থনে মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান বলেন, “আমাদের কাছেও সেই তথ্য আছে, এসএমসের মাধ্যমে সারাদেশের পোল্ট্রির বাজার নিয়ন্ত্রণ হয়। এখানে মার্কেট হবে ওপেন, সেখানে সরকারকে কেন হস্তক্ষেপ করতে হবে? ভোক্তার কেন কাপ্তান বাজারে গিয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হতে হবে?”

তিনি খুচরা ও পাইকারি মুরগি ব্যবসায়ীদের পাকা রশিদ রাখার পরামর্শ দেন তিনি।

জবাবে মোহাম্মদপুর টাউনহল কাঁচাবাজার সমিতির সভাপতি মোসলেম উদ্দিন শিকদার বলেন, “আমরা বলি পাকা ভাউচার দিতে। কিন্তু তারা যে কত তালবাহানা করে! রাতে খোলাবাজারে দুই গাড়ি, তিন গাড়ি মাল আসে, এদের একেকরকমের ভাউচার, আমরা চাইলে ভাউচার দেয় না।”

দর নির্ধারণের প্রস্তাব

ভোক্তা অধিকারের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান বলেন, “কাজী সাহেব বললেন, উৎপাদন ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা, ছোট খামারে ১৬৭ টাকা পর্যন্ত, কিন্তু বাজারে সেটা ২৫০ কেন? এখানে কোথাও না কোথাও কারচুপি হচ্ছে। হতে পারে এসএমএসে, হতে পারে যিনি ২০৭ টাকায় কিনে ২৫০ টাকায় বিক্রি করছেন, হতে পারে যে কেউ, এখানেই আমাদের কাজ করতে হবে।

“এখানে এফবিসিসিআই আছে, ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন আছে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে একটা ‘রেইট’ (দর) ঠিক করে দিলে ভোক্তা অধিকার সেটা দেখবে।”

আমদানির নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়ার দাবি

পোলট্রি পণ্য আমদানির নিষেধাজ্ঞা সেগুলো তুলে দেওয়ার পরামর্শ দেন ক্যাবের কাজী হান্নান। তিনি বলেন, “উৎপাদককে সুরক্ষার দরকার নেই। আমরা আমদানি করে আনি, তারা বাইরের সাপ্লাইয়ারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করুক।”

তবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সম্প্রসারণ বিভাগের পরিচালক শাহিনুর আলম বলেন, “আমদানি খুলে দিলে এই শিল্প টিকবে না। সবদিকেই আমাদের দেখতে হবে।”