ক্যালেন্ডারের সময়ের আগেই বাজারে এসেছে আম। সেগুলোর দাম বেশি হলেও স্বাদ ভালো না। পরিপক্বও হয়নি সেভাবে।
Published : 13 May 2024, 09:52 AM
মৌসুমের ‘আগে’ই বাজারে আম। দাম বাড়তি, তাতে চাষি আর বিক্রেতাদের লাভ। ক্রেতা-বিক্রেতা দুই পক্ষই বলছেন, সেই আমের স্বাদ ভালো না। তবু মৌসুমের শুরুতে মানুষ কিনছে সেগুলো।
এর মধ্যে আবার মাঝেমধ্যে প্রশাসন অভিযান চালাচ্ছে, জব্দ করা আম ধ্বংস করছে। হরমোন ব্যবহারের অভিযোগ এনে ধ্বংস করা হচ্ছে আমগুলো। তবে এই হরমোন ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে কি না, সে বিষয়ে মাঠ প্রশাসন ও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের মধ্যে মতের মিল নেই।
মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দাবি, এভাবে কৃত্রিমভাবে ফল পাকালে তাতে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে। তবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যান তত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ফল বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেছেন, এই হরমোন ব্যবহার করে সব দেশেই ফল পাকানো হয়।
কৃত্রিমভাবে ফল পাকানো নিয়ে প্রতি বছরই এ বিষয়টি দেখা যায়। কয়েক বছর আগে হরমোন ছাড়াও ফলে ‘ফরমালিন ব্যবহার’ নিয়েও নানা কথা ছড়ায়। ওই অভিযোগে কেবল আম নয়, অন্যান্য ফলও নানা সময় ধ্বংস করা হয়। কিন্তু পরে সরকারের তরফ থেকেই সেই ভুল ভাঙা হয়েছে। তবু নানা সময় প্রশাসনের কর্মকর্তারা ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে এই কাজ করছেন।
এতে ভোক্তাদের মনে যেমন ভুল ধারণা জন্ম দিচ্ছে, তেমনি ‘ফরমালিন মুক্ত’ দাবি করে বিভিন্ন এলাকায় ফল বিক্রি করা হয়, সেখানে দাম বেশি রাখা হয়।
২০২২ সালের ৭ জুলাই খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন রাজধানীর এক সেমিনারে বলেছিলেন, “ফরমালিন আছে ভেবে একসময় ট্রাকে ট্রাকে মাছ, শাকসবজি ও ফলমূল ধ্বংস করা হয়েছে। এখন শুনছি, যে যন্ত্র দিয়ে ফরমালিন পরীক্ষা করা হত, তাতেই ভেজাল ছিল।
“তাহলে যে মাছ ব্যবসায়ীর মাছ নষ্ট করেছি, তার ক্ষতিটা চিন্তা করেন। অথবা এর ফলে আমার–আপনার সন্তান মাছ খাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে। যা আমাদের সবার জন্য কষ্টের।”
‘অপরিপক্ব’ আম বাজারে
প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ও পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোয় পাওয়া যাচ্ছে পাকা আম। ক্রেতারা হলুদাভ রঙ দেখে কিনে ঠকছেন।
শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দেখা যায়, গোবিন্দভোগ, গোপাল ভোগ এমনকি হিমসাগর পাকা আম বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে।
তারা জানান, পাকা আমের মৌসুম এখনও শুরু হয়নি। আরও অন্তত ৫ দিন পর গোবিন্দভোগ আমের মৌসুম শুরু হবে।
আসলাম মিয়া নামে ক্রেতা বলেন, “মূলত কাঁচা আম নিতে এসেছিলাম। পাকা আম পেয়ে যাওয়ায় এক কেজি কিনলাম। মৌসুম শুরু হয় নাই, তাই দামটা একটু বেশি।”
সাতক্ষীরা থেকে মধ্যরাতে আম আনা হয় কারওয়ান বাজার আড়তে। পরদিন সকাল ৯টার ভেতরেই আড়ত থেকে বিক্রি শেষ হয়ে যায়। এরপর সারাদিন খুচরায় বিভিন্ন দামে বিক্রি চলে।
তবে এসব আম যে পরিপক্ব না, সে তথ্য পাইকারি বিক্রেতারাও স্বীকার করলেন।
কারওয়ান বাজারে আমের পাইকারি দোকান মেসার্স শাহ আলী ফার্মের বিক্রেতা মো. ফারুক বলেন, “সত্যি বলতে এখনও আম পরিপক্ব হয়নি। তবুও আম ব্যবসায়ীরা অধিক লাভের জন্য বিক্রি করে দেয়। এরপর সরবরাহকারীরা আমাদের কাছে নিয়ে আসে।
“এগুলোকে মেডিসিন দিয়ে পাকানো হয়। প্রশাসন তো এখনো অনুমতি দেয় নাই। যেগুলো আসে এগুলো লুকিয়ে আনে। গতকাল এক জায়গায় ট্রাকভর্তি আম আটক করে সব নষ্ট করে দিছে।”
মেহেদী হাসান দেড় কেজি আম কিনেছেন ২১০ টাকা দিয়ে। তিনি বলেন, “জানি না কেমন হবে। শখ করে কিনলাম।”
ভ্যানে করে খুচরায় সাতক্ষীরার গোবিন্দভোগ আম ১৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন আক্তার হোসেন। তিনি বলেন, “কিছু বিক্রেতা আছে ১০ থেকে ১২ দিন ধরে বিক্রি করতেছে। আমি আজ প্রথম বেচতাছি। আমি কাউকে বলি না যে আমার আমের আঁটি পরিপক্ব হইছে। রেখে দিছি ভ্যানে, যে আসে কেনে। আম পরিপক্ব নাকি অপরিপক্ব সে দায়ভার আমার না।”
আপনি আম খেয়েছেন? এ প্রশ্নে আক্তার বলেন, “আমি খেয়েছি। কিছুটা মিষ্টি। কাস্টমার যদি বলে আম ভালো না, তাহলে আর আনব না।”
ভ্যান থেকে আম হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছিলেন হুমায়ুন কবির। এরপর নাকের কাছে দিয়ে দোকানিকে বললেন, “কী সব জিনিস দিয়া পাকাইছ, কী আর ঘ্রাণ হইব?
তবু তিনি ৫ কেজি আম কিনেছেন ৬৫০ টাকা দিয়ে। বললেন, “আমার মেয়ে আম খাওয়ার বায়না করেছে। তাই বছরের শুরুর আম কিনতেছি। পরিবারের সবাই মিলে খাব। তাই একটু বেশি করে কিনলাম।”
এসব আম কি পরিপক্ব হয়েছে মনে হয়? হুমায়ুন বলেন, “দেখেই বোঝা যাচ্ছে হয় নাই। তবে আমার ইচ্ছা হইল কেনার। পরিবারের সবাই মিলে খাব, এজন্যই কিনছি। আর খাওয়া যাবে না, এমনটাও দেখে মনে হচ্ছে না।”
১৮০ টাকা কেজিতে গোপালভোগ আম বিক্রি করছেন মো. খোকন। তিনি বলেন, “আমার আম মিষ্টি হইয়া গেছে। আমি খাইছি। তবে আঁটিটা পরিপক্ব হইতে আরও কিছুদিন সময় লাগব।”
ফরহাদুর রহমান হিমসাগর আম বিক্রি করছেন ২০০ টাকা কেজিতে। তিনি জানালেন, সাতক্ষীরা থেকে আনা হয়েছে হিমসাগর আম।
অথচ সরকারি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৭ মে থেকে হিমসাগর আম পরিপক্ব হিসেবে পাওয়া যাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
রাজশাহীতে আমের বাগান রয়েছে ইকবাল হোসেনের। তিনি বলেন, ভৌগোলিক কারণে অনেক জেলার আম ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পরিপক্ব হয়। যেমনটা সাতক্ষীরা নাম সবার আগে বাজারে আসে পর্যায়ক্রমে রাজশাহীর আম সাতক্ষীরা থেকে ২০ থেকে ২৫ দিন পরে ওঠে।
ছয় বছর ধরে অনলাইনে আম বিক্রি করেন মিঠুন খান। প্রতিবারেই রাজশাহীর আম দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করেন তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বর্তমান বাজারে এখন যেগুলো আম পাওয়া যাচ্ছে এই আমগুলো পরিপূর্ণ হয় নাই। তবে এখন দাম বেশি, তাই কিছু ব্যবসায়ী বেশি লাভের আশায় সেগুলো বিক্রি করছে।”
কৃত্রিমভাবে পাকানো কি খারাপ?
গত শুক্রবার সাতক্ষীরায় পৌনে এক টন আম জব্দ করে ধ্বংসের নির্দেশ দেন সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অতীশ সরকার। তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে এই সিদ্ধান্ত জানান, যেখানে উপস্থিত ছিলেন উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মনির হোসেনও।
সেদিন ৩১ ক্রেট আম জব্দ করে ৭২০ কেজি আম পৌরসভার পিটিআই মাঠে নিয়ে নষ্ট করা হয়। আম ব্যবসায়ী আমিনুর রহমানকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়।
কেন আমগুলো ধ্বংস করা হয়- এই প্রশ্নে অতীশ সরকার বলেন, “এগুলো কেমিক্যাল দিয়ে পাকিয়ে ঢাকা পাঠানো হচ্ছিল। এগুলো শরীরের জন্য ক্ষতিকর।”
এগুলো যে ক্ষতিকর সে কীভাবে জানলেন? এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “যখন ক্ষতিকর কিছু পুশ করা হয়, এটা তো অবশ্যই বেআইনি।”
হরমোন দিয়ে ফল পাকানো হয়, সেটি মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কি না, সেই প্রশ্নের জবাব পেতে এর আগেই বিডিনিউজ কথা বলে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যান তত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ফল বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শরফ উদ্দিনের সঙ্গে।
তিনি বলেন, “রাইপেনিং হরমন দিয়ে কৃত্রিমভাবে আম পাকানো হয়। এই হরমোন বাংলাদেশে অনুমোদিত না। এটি ব্যবহার করলে অপরিপক্ব আমে পুষ্টিমান থাকবে না, কাঙ্ক্ষিত স্বাদ পাবে না। তবে এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি নাই। বিদেশে খাওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে অনুমোদন দেওয়া হয়নি।”
শরফ উদ্দিনের এই বক্তব্য জানালে আম ধ্বংসের নির্দেশ দাতা অতীশ সরকার বলেন, “উনি কী বলেছেন আমি জানি না। এটা উনার ব্যক্তিগত মন্তব্য থাকতেই পারে। সবার মন্তব্য এক হবে বিষয়টা তো আসলে সে রকম না। আমার এখানে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা যিনি ছিলেন, তিনি এ বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন, এরপর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
সেই উপজেলার কৃষি কর্মকর্তার নাম মো. মনির হোসেন। অতীশের পরামর্শে যোগাযোগ করা হয় তার সঙ্গে।
তিনি বলেন, “এভাবে কেমিক্যাল ব্যবহার তো তো শরীরের জন্য উপকারী হওয়ার কথা না। তবে এভাবে তো পাকানো যাবে না।”
এই হরমোন ক্ষতিকর, সেটা কি আপনারা পরীক্ষা করেছেন?- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “এখানে তো ভোক্তা অধিকারের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা জানেন। তারা তো এটা ইয়ে করেই নেন।”
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যান তত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ফল বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শরফ উদ্দিনের বক্তব্যটি জানানো হয়। পাল্টে যায় মনির হোসেনের বক্তব্য।
তখন তিনি বলেন, “অপরিপক্ব আমে কেমিক্যাল দিয়ে পাকায় সেটা ঝুঁকিপূর্ণ কিনা আমার জানা নেই। তবে আমার ডেটের আগে আম ভাঙা নিষেধ।
“আমের জন্য জেলা প্রশাসকের নির্ধারিত একটা ক্যালেন্ডার করা আছে। সেই ডেট মেনে আম পাড়তে হবে। সেই ডেট মেনে আম পারলে তো কেমিক্যাল দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মুনির উদ্দিন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আম পাকাতে কোন প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়, সেটা হলো আসল বিষয়।
“ইথোফেনযুক্ত পানিতে যদি ফল ডুবিয়ে পাকানোর চেষ্টা করা হয়, তাহলে অন্য ঝুঁকি আছে। আর এটা যদি চারটি পাত্র ঘরের চার কোণে রেখে ঘরকে আবদ্ধ করে যদি মাঝে ফলটা রাখা হয়, তখন ফল থেকে যে জলীয় বাষ্প বের হয়, সেটা ইথোফেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে তখন এই ফলটাকে পাকায়। এটা করা যেতে পারে।
“গ্যাস ব্যবহার করে আম পাকানো যেতে পারে। যেটা আমেরিকাতে করে। তারা গ্যাস স্প্রে করে, এরপর পাকানোর পরে আবার ওয়াশ করে। এখন আমাদের দেশে এই কাজটা ঠিক কীভাবে করে তা আমি স্পষ্ট জানি না।”
‘আমের ক্যালেন্ডারে’ কী বলে?
বাংলাদেশে রপ্তানিযোগ্য আম সংগ্রহের সময়পঞ্জি (ক্যালেন্ডার) প্রকাশ করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। গবেষণা করে সময় নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের। যা চলতি বছরের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়েছে।
এতে গোবিন্দভোগ আমের সময়কাল বলা হয়েছে ১৫ মে থেকে, হিমসাগর বা খিরসাপাত ২৬ মে থেকে।
ল্যাংড়া আম ১০ জুন, লক্ষ্মণভোগ ১৬ জুন, আম্রপালি ১৭ জুন, ফজলি ২৩ জুন, হাঁড়িভাঙা ২০ জুন ও ব্যানানা ম্যাঙ্গু ৭ জুন থেকে রপ্তানিযোগ্য শুরুর সময়কাল বলা হয়েছে।