পাদুকা থেকে জামদানি, আরও অনেক বাহারি পণ্য নিয়ে এসেছেন হস্তশিল্পের কারিগররা।
Published : 26 Jun 2024, 09:31 AM
স্টলের পাশেই জামদানি শাড়ি বোনার কাজ করছিলেন কারিগর জাহাঙ্গীর আলম। প্রদর্শনী কেন্দ্রের এদিকে যারা এসেছেন তাদের অনেকেই ঢু মেরেছেন সেখানে। বুননের সময় তৈরি করতে থাকা শাড়ি নেড়েচেড়েও দেখেছেন কেউ কেউ। আর পাশেই তার সহকর্মীরা স্টলে দর্শনার্থী-ক্রেতাদের দেখাচ্ছিলেন রঙিন সব শাড়ি।
মঙ্গলবার বিকালে ঢাকার পূর্বাচলে হস্তশিল্প প্রদর্শনীতে গিয়ে দেখা মিলল জামদানির এ কারিগরের শাড়ি তৈরি করার কর্মযজ্ঞ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার নামে বাণিজ্য মেলার স্থায়ী কেন্দ্রে ৫ দিনের এ মেলার আয়োজন করেছে। মঙ্গলবার শুরু মেলা শনিবার পর্যন্ত চলবে। বিনা টিকেটে উন্মুক্ত এ মেলা প্রতিদিন খোলা থাকবে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা; সাপ্তাহিক ছুটির দিনে চলবে রাত ৮টা পর্যন্ত।
উদ্বোধনি দিনে মেলায় গিয়ে দেখা মিলল জামদানির কারিগর জাহাঙ্গীরের। তিনি যে জামদানি শাড়ি তৈরি করছেন সেটির আনুমানিক দাম হবে ৮৫ হাজার টাকা। আর বানাতে সময় লাগবে প্রায় দেড় মাস। অথচ মেলা চলবে মাত্র পাঁচদিন।
তবুও মেলায় শাড়ি তৈরির কাজ কেন করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্রেতা-দর্শনার্থীরা নিজে থেকে কাজ দেখে যাতে পণ্য কেনার সুযোগ পায়, সেজন্যই তার এ আয়োজন। আসল জামদানি কেমন, সেটা যে হাতে তৈরি হয় তা ক্রেতাদের বোঝাতে চান তিনি।
জাহাঙ্গীরের মতে, অনেক ক্রেতা জামদানি শাড়ি চেনে না। আবার কেউ কেউ ভাবেন মেশিন দিয়েও করা যায়। কিন্তু জামদানি শাড়ি হাতের কাজ ছাড়া হবে না। কাজ শেষ করতে কমপক্ষে আট দিন লাগবে। বাজারে এখন জামদানি নামে বিক্রি হওয়া অনেক শাড়িই জামদানি নয় বলে দাবি তার।
নাদিয়া জামদানি নামে এ স্টলে শাড়ি বানানো দেখছিলেন পলি গুহু। বললেন, এ শাড়ি বানানো সহজ কথা নয়। বেশ কষ্টসাধ্য বিষয়। তবে একটা আর্ট আছে কাজটাতে।
এ প্রদর্শনী কেন্দ্রের কাছের এলাকা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে এসেছেন জাহাঙ্গীর। নাদিয়া জামদানির মালিক নিজেই; কারিগরও তিনি। কাজটা শিখেছেন বাবার কাছ থেকে।
৪৫ বছর বয়সী জাহাঙ্গীর এ কাজ শুরু করেছেন ২৫ বছর বয়স থেকে। বাধ্য হয়ে করছেন বিষয়টি তেমনও না। মূলত দেশি পণ্য টিকিয়ে রাখা ও মানুষের কাছে জনপ্রিয় করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে তিনি শাড়ি বোনার কাজ করে যাচ্ছেন।
রূপগঞ্জে ছোট একটি কারখানাও অল্প কিছু কর্মী নিজে শাড়ি তৈরি করেন তিনি। হালের আমলে কর্মীদের বেতন ও সব খরচ মিলে দিনশেষে লাভ খুব বেশি একটা থাকে না তার। তবুও কাজটা করেন ভালোবেসেই।
বিডি ক্রিয়েশনের স্টলেও দেখা মিলল আরেক কারিগরের। সেখানে মো. জাকির জামদানি নয়, বানাচ্ছিলেন বেতের ঝুড়ি। মেলায় আসা ক্রেতা দর্শনার্থীদের বেশ কয়েকজন সেখানে দাঁড়িয়ে তার কাজ দেখছিলেন।
এ দুই স্টল ছাড়াও ক্ল্যাসিক্যাল হ্যান্ডমেইড প্রোডাক্টস, আধুনিকা, টুইংকেল ক্রাফট, কল্পতরু, মা এন্টারপ্রাইজের মত আরও অনেকে স্টলে হস্তশিল্পজাত পণ্য তৈরির প্রক্রিয়া উপস্থাপন করে দর্শনার্থীদের দেখার সুযোগ করে দিয়েছে এ মেলায়।
মেলায় এসে দেশের কারুশিল্প, মৃৎশিল্প, বাঁশ-বেত শিল্প, নকশিকাঁথা, শীতলপাটি, জামদানি, শতরঞ্জির সম্পর্কে জানার সুযোগ পাচ্ছে নগরে বেড়ে ওঠা অনেকেই।
মেলায় রয়েছে পাটজাত পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, জুতা, বেত ও বাঁশজাত পণ্য, তাঁত পণ্য, কারুপণ্য, হাতে তৈরি জুয়েলারি, মৃৎশিল্পজাত পণ্য।
মো. রাকিব হোসেন নামে এক ক্রেতা ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন স্টলে কীভাবে পণ্যগুলো তৈরি করা হচ্ছে তা দেখছেন।
তিনি বলেন, বেত ও বাঁশসহ পরিবেশবান্ধব যে উপাদানগুলো দিয়ে পণ্য তৈরির কাজ করে দেখাচ্ছেন শিল্পীরা। সেটা একটা দারুণ উদ্যোগ। এখানে এমন অনেক কিছু আছে যা কীভাবে তৈরি করে তা জানা ছিল না। মেলায় এসে দেখলাম বানানোর প্রক্রিয়া। তা দেখে হস্তশিল্পে আগ্রহ বেড়েছে।
সাসটেইনেবল বাংলাদেশ বুথের স্বত্বাধিকারী রুবিনা আক্তার বলেন, প্রতিটি পণ্য পরিবেশের কথা চিন্তা করে তৈরি করা হয়েছে। গার্মেন্টসের যে ঝুটগুলো হয়, সেগুলোও ফেলে না দিয়ে কাজে লাগানো হয়। ঝুড়ি, ব্যাগ অনেক কিছুতেই বাঁশ, পাটের সঙ্গে সেগুলো মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
তার মতে, মানুষ এগুলো যতি বেশি তৈরি করা দেখবে তত বেশি জানবে। তাই মানুষদের বেশি বেশি দেখার সুযোগ করে দিতে হবে।
দূরত্বের গ্যাড়াকল
নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা এবং দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ ভূমিকা রাখায় সরকার হস্তশিল্প পণ্যকে ‘বর্ষপণ্য-২০২৪’ ঘোষণা করেছে। এর অংশ হিসেবে এ মেলার আয়োজন করা হয়েছে।
নগরী থেকে দূরের এ কেন্দ্রে দর্শনার্থীদের যাতায়াতের সুবিধায় কুড়িল বিশ্বরোড হতে মেলা প্রাঙ্গণ পর্যন্ত বিআরটিসির ডেডিকেটেড শাটল বাস রয়েছে।
মেলায় দর্শনার্থীদের জন্য নানা আয়োজন থাকলেও দূরত্বের কারণে দর্শনার্থী বা ক্রেতা প্রত্যাশামত পাচ্ছেন না অংশগ্রহণকারীরা।
বেলা ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত এক ঘণ্টায় একজন ক্রেতাও জোটেনি জুট ফিউশিনের স্টলে। বিক্রেতা শফিক সিকদার ক্রেতা না আসায় মোবাইলে ফেইসবুকে চালাচ্ছিলেন। ৪টার পরে তার স্টলে দুইজন এলেও তারা ক্রেতা ছিলেন না।
তার মত অবস্থা অন্য স্টলের বিক্রেতাদেরও।
জুট ফিউশিনের স্বত্বাধিকারী কানিজ সুলতানা বলেন, মানুষকে জানানোটা বেশি জরুরি যে পাট দিয়ে শুধু বস্তা বা ব্যাগই হয় না। কাপড়ও তৈরি হয় আর সেই কাপড় স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহারও করা যায়। তাই এমন আয়োজন বেশি বেশি দরকার। তবে দূরত্বের কারণে এখানে কিছুটা ক্রেতা কম।