২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুইফট সিস্টেমে ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে নিউ ইয়র্ক ফেড থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়।
Published : 02 Mar 2024, 11:48 PM
নিউ ইয়র্ক ফেড থেকে বাংলাদেশের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকটি অভিযোগ খারিজ করে দিলেও ফিলিপিন্সের ব্যাংক রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন-আরসিবিসি’র বিরুদ্ধে মামলা চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত।
নিউ ইয়র্ক কাউন্টি সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, আরসিবিসির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়ের করা মামলা চলার মত যথেষ্ট ‘মেরিট’ রয়েছে।
রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সালের ২৭ মে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে যে মামলা দায়ের করে, সেখানে ১৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বিবাদী করা হয়। এরপর সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়ে আপিল করে আরসিবিসি।
ফিলিপিন্সের সংবাদমাধ্যম ইনকোয়ারার এক প্রতিবেদনে জানায়, নিউ ইয়র্ক কাউন্টি সুপ্রিম কোর্ট গত ১৪ জানুয়ারি এক আদেশে ব্লুমবেরি ও ইস্টার্ন হাওয়াই নামে দুটি ক্যাসিনোকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।
আরসিবিসিসহ বিবাদীদের বিরুদ্ধে অর্থ রূপান্তর, চুরি, আত্মসাৎ, তাতে সহায়তা, জালিয়াতি বা প্ররোচনার তিনটি অভিযোগ থেকে আরসিবিসি ও চার কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া ইসমায়েল রেয়েস, ব্রিজিত ক্যাপিনা, রোমুয়ালদো আগারাদো ও নেস্তর পিনেদা নামের চার ব্যক্তিকেও মামলা থেকে রেহাই দিয়েছে আদালত।
তবে আরসিবিসি এবং বাকি বিবাদীদের বিরুদ্ধে অন্য অভিযোগগুলোর বিচার চলতে পারে বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছে নিউ ইয়র্কের কাউন্টি সুপ্রিম কোর্ট।
আরসিবিসি ফিলিপিন্সের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি। গত ১ মার্চ স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক ডিসক্লোজারে ব্যাংকটি জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়ের করা অভিযোগ বাতিল এবং কর্মকর্তাদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়ে আরসিবিসির আবেদন খারিজ করেছে নিউ ইয়র্কের আদালত।
ওই আদেশের কপি গত ১ মার্চ হাতে পেয়েছে আরসিবিসি। সেখানে বলা হয়েছে, “আদালত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মামলা চলতে পারে।”
আদালতের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না, সে বিষয়ে আরসিবিসি এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি জানিয়ে ডিসক্লোজারে বলা হয়, কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তা স্টকএক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাইবার চুরির ঘটনায় নাম জড়িয়ে ‘মানহানির’ অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে এর আগে মামলা করেছিল আরসিবিসি। সেই মামলা খারিজ করে দিয়েছিল ফিলিপিন্সের আদালত।
গত ২০২২ সালের ৩০ জুন ফিলিপিন্সের আদালতে ওই রায় হওয়ার পর সেই নথিপত্র ১৪ দিন পরে হাতে পেয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুইফট সিস্টেম ব্যবহার করে ৩৫টি ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে (ফেড) রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়।
এর মধ্যে একটি মেসেজের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কায় একটি ‘ভুয়া’ এনজিওর নামে ২০ মিলিয়ন ডলার সরিয়ে নেওয়া হলেও বানান ভুলের কারণে সন্দেহ হওয়ায় শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়।
বাকি চারটি মেসেজের মাধ্যমে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার সরিয়ে নেওয়া হয় ফিলিপিন্সের মাকাতি শহরে রিজল কমার্সিয়াল ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখায় ‘ভুয়া তথ্য’ দিয়ে খোলা চারটি অ্যাকাউন্টে।
অল্প সময়ের মধ্যে ওই অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়া হয়, ফিলরেম মানি রেমিটেন্স কোম্পানির মাধ্যমে স্থানীয় মুদ্রা পেসোর আকারে সেই অর্থ চলে যায় তিনটি ক্যাসিনোর কাছে।
এর মধ্যে একটি ক্যাসিনোর মালিকের কাছ থেকে দেড় কোটি ডলার উদ্ধার করে বাংলাদেশ সরকারকে বুঝিয়ে দেওয়া হলেও বাকি অর্থ উদ্ধারে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। জুয়ার টেবিলে হাতবদল হয়ে ওই টাকা শেষ পর্যন্ত কোথায় গেছে, তারও কোনো হদিস মেলেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সে সময় বলেছিল, রিজার্ভের অর্থ চুরির কাজে ‘অজ্ঞাতনামা উত্তর কোরীয় হ্যাকারদের’ সহায়তা নেয় আসামিরা। ‘নেস্টেগ’ ও ‘ম্যাকট্রাক’ এর মত ম্যালওয়্যার পাঠিয়ে হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট নেটওয়ার্কে ঢোকার জন্য পথ বের করে। পরে নিউ ইয়র্ক ফেড থেকে টাকা সরিয়ে নেওয়া হয় নিউ ইয়র্ক ও ফিলিপিন্সে আরসিবিসির অ্যাকাউন্টে।
চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারের আশায় ২০১৯ সালের ২ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে আরসিবিসির বিরুদ্ধে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে বলা হয়, ওই অ্যাকাউন্টগুলোর ওপর আরসিবিসি এবং এর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। কী ধরনের অপরাধ হচ্ছে জেনেও অ্যাকাউন্ট খোলা, বিপুল পরিমাণ অর্থ স্থানান্তর এবং পরে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়গুলো ঘটতে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ মামলা করার দুই দিনের মাথায় ৬ মার্চ ফিলিপিন্সের সিভিল কোর্টে আরসিবিসির পাল্টা মানহানির মামলা করে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১০ কোটি পেসো (১৯ লাখ ডলার) দাবি করা হয় সেখানে।
ফিলিপিন্সের ব্যাংকটির মামলায় বলা হয়, টাকা আদায় করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ‘বিরাট এক ষড়যন্ত্র’ শুরু করেছে, সেজন্য তারা আরসিবিসির ‘সুনাম ক্ষুণ্ন করতে, ভাবমূর্তি নষ্ট করতে’ উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু যে টাকার জন্য এটা তারা করছে, তা কখনোই আরসিবিসির কাছে ছিল না, ওই টাকার ‘দায়ও আরসিবিসির নয়’।
আরসিবিসি মামলা করার পর আইনি লড়াইয়ের জন্য ম্যানিলার ‘বারনাস ল অফিস’কে দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর ফিলিপিন্সের আদালতের আরসিবিসির পক্ষে সিদ্ধান্ত দিলে বাংলাদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন করে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালের জুন মাসে আরসিবিসির মানহানি মামলা খারিজ করে দেয় ফিলিপিন্সের আদালত।
রায়ে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংককে বিচারের আওতায় আনার এখতিয়ার ফিলিপিন্সের ওই আদালতের নেই। সে কারণে আরসিবিসির মামলাটি খারিজ করা হল।
নিউ ইয়র্কের আদালতে আরসিবিসির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ যে মামলা করেছিল, ২০২৩ সালের এপ্রিলে তা খারিজ হয়ে যায়। নিউ ইয়র্কের সুপ্রিম কোর্টের রায়েও বলা হয়, ওই মামলা বিচারের ‘পর্যাপ্ত এখতিয়ার’ তাদের নেই।
পরে বাংলাদেশ বাংকের পক্ষ থেকে নিউ ইয়র্কের ‘এখতিয়ারভুক্ত’ আদালতে মামলা করা হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটি চলতে পারে বলে সিদ্ধান্ত দিল নিউ ইয়র্ক কাউন্টি সুপ্রিম কোর্ট।
রিজার্ভ চুরির ওই ঘটনা বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারে এক মাস পর, ফিলিন্সের সংবাদ মাধ্যমের খবরে। সে সময় বিষয়টি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলে।
ওই ঘটনার জেরে তখনকার গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে পদত্যাগ করতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পদে রদবদল আনা হয়। দুই ডেপুটি গভর্নরকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
কিন্তু রিজার্ভ সংরক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এখনো কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।
রিজার্ভ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যেই একজন মতিঝিল থানায় মামলা দায়ের করেছিলেন রিজার্ভ চুরির ঘটনায়। সেই মামলার এখনো অভিযোগপত্র দেয়নি পুলিশ।
রিজার্ভ চুরির ওই ঘটনা তদন্ত করতে সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি কমিটি করা হয় ওই বছরের ১৫ মার্চ।
তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির অপর দুই সদস্য ছিলেন- বুয়েটের কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব গকুল চাঁদ দাস।
২০১৬ সালের ২০ এপ্রিল অর্থমন্ত্রীর কাছে অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন জমা দেয় ফরাসউদ্দিনের কমিটি। এরপর ৩০ মে পুরো প্রতিবেদন জমা দেন তারা।
অন্তবর্তীকালীন প্রতিবেদনে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি না এলেও চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তা উঠে আসে।
ফরাসউদ্দিন সেদিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাইরের কোন ‘সাইবার অপরাধী’ এ ঘটনায় দায়ী, তা নির্ধারণ করা তদন্ত কমিটির পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কতোটা সম্পৃক্ততা সেখানে ছিল, তা অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করেছেন তারা।
তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো তা জনসম্মুখে আসেনি।