কৃষকদের সেচের খরচ অনেকটাই কমে এসেছে।
Published : 06 Dec 2024, 10:49 AM
রংপুরে রবি শস্য আবাদে কৃষকদের সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় সেচ নিয়ে। এ মৌসুমে পাম্প মেশিন চালাতে প্রয়োজনের সময় প্রায়ই বিদ্যুৎ পান না তারা।
আবার বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে জ্বালানি তেল ব্যবহার করলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। পাম্প মেশিন এক জায়গায় থেকে আরেক জায়গায় টানাটানি করার ভোগান্তিও আছে।
এসব ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেতে রংপুরের অনেক কৃষক ঝুঁকছেন সোলার বা সৌর পাম্পে। এরই মধ্যে বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকজন কৃষক এ পাম্পের সুফল পাওয়ার গল্প শুনিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে।
বদরগঞ্জ উপজেলার দিলালপুর গ্রামের মিনহাজুল ইসলাম (৫৬) তার জমির প্রায় ৩ শতাংশ জায়গা একটি সোলার পাম্প বসানোর জন্য বরাদ্দ করেছেন।
তিনি বলেন, “আমরা বৈদ্যুতিক পাম্পের মাধ্যমে শান্তিতে জমিতে সেচ দিতে পারতাম না। বিদ্যুৎ থাকতো না, অনেকে মিলে একটা মেশিন চালাতে হত বলে প্রায়ই নষ্ট হয়ে যেত। মেশিন আনা-নেওয়া করাও অনেক কঠিন।
“সোলার পাম্প বসানোর পর নিশ্চিন্তে আলু-পটল থেকে শুরু করে আমন ধানও চাষ করা যাবে বলে আশা করছি।”
স্বামীর সঙ্গে কৃষিকাজ করেন একই এলাকার মোসাম্মত আরজু বানু (৩৫)। দুজনের কৃষিকাজের আয় দিয়েই চলে সংসার।
আরজু বানু বলেন, “সোলার পাম্পে সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, আমাদের বিদ্যুৎ বিল দেয়া লাগে না। আগে আমরা অন্যের মোটর থেকে পানি নিতাম, তাও ঠিকমত পানি পেতাম না। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক আমাদের সোলার পাম্প দিয়েছে। এতে আমার সেচের খরচ প্রায় ৫ হাজার টাকা কমে গেছে।”
একই এলাকার আরেক বাসিন্দা মোহাম্মদ একরামুল ইসলাম (৬০) এবার বেগুনের আবাদ করেছেন। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগে প্রত্যেকবার ২০০ টাকার বেশি টাকা খরচ করে ক্ষেতে পানি দিতাম। এখন ১৫০ টাকায় দিচ্ছি। এতে চলতি মৌসুমে প্রায় এক হাজার টাকা খরচ কমবে।”
রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার ২৮টি সোলার পাম্প দিয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। এতে অর্থায়ন করেছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। এর মধ্যে রংপুরে ৯টি, দিনাজপুরে ১১, নীলফামারিতে ৪, কুড়িগ্রামে ৩ ও লালমনিরহাটে ১টি সোলার পাম্প বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
একেকটি সোলার পাম্প ৫ জন করে কৃষককে দেয়া হয়, যাদের সবাই ব্র্যাকের সঙ্গে যুক্ত। তারা চাইলে নিজেদের জমির পাশাপাশি অন্যদেরও পানি সরবরাহ করতে পারেন।
অন্যের জমিতে পানি সরবরাহের মধ্য দিয়ে যে টাকা আসে, তা ব্র্যাকের মাধ্যমে ওই পাঁচ কৃষকের একটি যৌথ তহবিলে জমা থাকে।
মো. ইব্রাহিম (৫৪) ১২ শতক জমিতে আলু চাষ করছেন। তিনি সোলার পাম্প প্রকল্পের প্যানেল সদস্য নন, তবে ব্র্যাকের সদস্য হওয়ায় প্যানেল সদস্যদের কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে পানি নিতে পারেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগে আমরা পানি পেতে অনেক সমস্যায় পড়তাম। বিদ্যুৎ পাওয়া যেত না। এখন আশা করছি এসব সমস্যা হবে না। টাকাও কম খরচ হবে।”
আরিফা বেগম (৩০) ও আলতাফ হোসেন (৪০) দম্পতি ৯০ শতক জমিতে ধান, ফুলকপি ও তামাক আবাদ করেছেন। তারা জানান, সৌরবিদ্যুতের পাম্প পাওয়া যাওয়ায় তাদের কষ্ট অনেকটাই লাঘব হয়েছে।
আলতাফ হোসেন বলেন, “আগে মানুষের কাছে পানির জন্য গেলে বলত আজ দেব, কাল দেব। শেষ পর্যন্ত পেতাম না। ঘাড়ে করে মেশিন নিয়ে আসা লাগত। এখন সেই ঝামেলা নেই।
“পানির অভাবে প্রায়ই ক্ষেত নষ্ট হত। ছয় মাস আগেও আমার একটি ধান ক্ষেত পানির অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। আরেকজনের কাছে পানি চেয়েও পাইনি। কারণ তখন চৈত্র মাস ছিল, সবারই মেশিন নিয়ে টানাটানি; তার ওপর আবার বিদ্যুৎ থাকত না।”
রংপুরে ব্র্যাকের স্থানীয় পরিচালক শহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সবচেয়ে গরীব অথবা যার সবচেয়ে বেশি পানির প্রয়োজন, তাদের নিয়ে পাঁচজনের প্যানেল তৈরি করি।
“তারা নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে অন্যদের টাকার বিনিময়ে পানি সরবরাহ করেন এবং সেই টাকা ব্র্যাক ব্যাংকে জমা হয়। কৃষকরা এ জমানো টাকা দিয়ে যেন স্বাবলম্বী হতে পারেন, সেজন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
শহিদুল ইসলাম জানান, প্রতি পাঁচজন চাষীর একটি প্যানেলে জমি থাকে প্রায় ১৬ বিঘা। প্রতিটিতে দেয়া হয়েছে ৩৫৫ ওয়াট। ১৬ বিঘায় মোট ৫৬৮০ ওয়াট আছে।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ব্র্যান্ড অ্যান্ড মার্কেটিংয়ের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স প্রধান বিটোপী দাস চৌধুরী বলেন, “বিদেশি ব্যাংক হলেও বাংলাদেশে সিএসআরের (করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা) মাধ্যমে ২০১০ থেকেই কাজ করে আসছি। ২০২২ থেকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা শুরু হয়েছে।”
তিনি জানান, মূলত চারটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করে বহুজাতিক এ ব্যাংক। এগুলো হলো যান্ত্রিকীকরণ, উৎপাদন বৃদ্ধি, গবেষণা ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা।
বিটোপী দাস বলেন, “কৃষক নিজে যেন বেশি সুবিধা পান, সেটা নিয়ে কাজ করছি। উত্তরাঞ্চলে বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছি। ভবিষ্যতে তাদের চাহিদা বাড়লে আমরা পদক্ষেপ নেব।”