বুধবার গভর্নরের সঙ্গে বৈঠকে ১০ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি) তারল্য সহায়তা দিতে সম্মতি প্রকাশ করেছেন।
Published : 25 Sep 2024, 10:29 PM
নগদ টাকার সংকটে জেরবার দুর্বল ব্যাংকগুলোর লেনদেন কার্যক্রম স্বাভাবিক করতে আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজার থেকে তাদের সহায়তা দিতে আপত্তি নেই ১০টি ‘সবল’ ব্যাংকের।
দীর্ঘদিন তারল্য সংকটে ভোগা ডজনখানেক বাণিজ্যিক ব্যাংক রক্ষায় টাকা না ছাপিয়ে কীভাবে তাদের সংকট কাটানো যায়, তার উপায় হিসেবে এই ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিয়োগ দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
এই প্রক্রিয়ায় আসতে রাজি সবল ও দুর্বল ব্যাংকগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে এমন সুযোগ তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যারা তারল্য সহায়তা পেতে দুর্বল ব্যাংকের গ্যারান্টর বা জামিনদার হচ্ছে।
বুধবার গভর্নরের সঙ্গে বৈঠকে ১০ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি) তারল্য সহায়তা দিতে সম্মতি প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বিষয়টি অবহিত করে বলেছেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোর পাশে দাঁড়াতে রাজি হয়েছে সোনালী ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ব্র্যাক ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ডাচ বাংলা ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংক।
হুসনে আরা শিখা বলেন, কিছু ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে। এসব ব্যাংকের মধ্যে ৯টি ব্যাংকের আর্থিক হিসাবে ঘাটতি রয়েছে। এরই মধ্যে পাঁচটি ব্যাংককে গ্যারান্টি দিতে চুক্তি হয়েছে।
“তবে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে তহবিল পায়নি। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ১০টি ব্যাংকের সভা হয়েছে বুধবার। তারা আলোচনার মাধ্যমে সম্মতি দিয়েছেন, যাদের প্রয়োজন তাদের সেই সুবিধাটা (তারল্য সহায়তা) দেবেন তারা।”
তারল্য সহায়তা পাওয়ার শর্ত স্মরণ করিয়ে দিয়ে মুখপাত্র শিখা বলেন, ব্যাংকগুলো তিন মাসের জন্য আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজার থেকে নগদ টাকার সহায়তা পেতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টি সুবিধা পাবে। পরিশোধের জন্য যদি কারও আরও সময় লাগে, তাহলে তারা বাড়িয়ে মেয়াদটি ৯ মাস করতে পারবে।
“সুদের হার হবে স্পেশাল রেপো রেটে। আর ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী তাদের কত টাকার গ্যারান্টি দেওয়া হবে, তা বিবেচনা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।”
সর্বশেষ এই অগ্রগতির আগেই সংকটে থাকা সাতটি ব্যাংক তারল্য সহায়তা পেতে বাংলাদেশ ব্যাংককে গ্যারান্টর হওয়ার জন্য আবেদন করেছে। এই সাত ব্যাংক মিলে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি নগদ অর্থ সহায়তা চেয়েছে।
আবেদন করা সাত ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহায়তা চেয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, যারা সাত হাজার ৯০০ কোটি টাকার চাহিদা দিয়েছে।
ইসলামী ও ন্যাশনাল ব্যাংক পাঁচ হাজার কোটি করে, এক্সিম চার হাজার কোটি, গ্লোবাল ইসলামী তিন হাজার ৫০০ কোটি, স্যোশাল ইসলামী দুই হাজার কোটি এবং ইউনিয়ন ব্যাংক দেড় হাজার কোটি টাকা চেয়েছে।
তবে এখন পর্যন্ত পাঁচটি ব্যাংকের জামিনদার হওয়ার জন্য চুক্তি সই করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অবশ্য চূড়ান্তভাবে তারা কী পরিমাণ সহায়তা পাবে, তা এখনও ঠিক হয়নি; কেন্দ্রীয় ব্যাংকই তা নির্ধারণ করে দেবে, যা এখন প্রক্রিয়াধীন বলে তথ্য দিয়েছেন কর্মকর্তারা।
গত বৃহস্পতিবার ন্যাশনাল ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিপত্র সইয়ের পর রোববার সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের চুক্তি হয়।
যেসব ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে, তারা এখন আন্তঃব্যাংক বাজার থেকে তহবিল সংগ্রহ করে বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে গ্যারান্টির জন্য পাঠাবে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার দেওয়া গ্যারান্টির আওতায় কোন ব্যাংক কত টাকা নিতে পারবে, তা বিবেচনা করে অনুমতি দেবে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে সরকারের পতনের পর দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করা হয়। এসব ব্যাংকের বেশিরভাগই আলোচিত এস আলম গ্রুপের কব্জায় ছিল।
মোট ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এসব ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে এস আলম গ্রুপসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে পাচার করেছে বলে যে অভিযোগ রয়েছে, তা খতিয়ে দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন তদন্ত সংস্থা।
ব্যাংকগুলো থেকে ‘অবৈধভাবে’ ঋণের নামে টাকা বের করে নেওয়ায় তারা তীব্র তারল্য সংকট পড়ে যায়, যা নিয়ে দীর্ঘদিন কথা বলে আসছেন ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞরা।
এসব ব্যাংক মাসের পর মাস বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআরআর ও এসএলআর রাখতেও ব্যর্থ হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চলতি হিসাবেও ঘাটতি রয়েছে কিছু ব্যাংকের।
এসব ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার মুখে উপনীত হলেও সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার তাদের লেনদেন চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। টাকা ছাপিয়ে দেওয়া সেই বিশেষ সুবিধা দায়িত্ব পাওয়ার পর বন্ধ করে দেন আহসান মনসুর।
এ অবস্থায় সংকট কাটাতে সাময়িক সুবিধা হিসেবে আন্তঃব্যাংক মুদ্র বাজার থেকে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সহায়তা ছাড় করানোর আগে তাদের কাছ থেকে ‘ডিমান্ড প্রমিসরি (ডিপি) নোট নিয়ে রাখবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, কোনো ব্যাংক সংকটে পড়লে সাধারণভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ ধার দেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ধার দেওয়া মানে সরাসরি টাকা ছাপানোর মত ঘটনা। এতে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ পড়ে।
“এমনিতেই এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি, যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি টাকা ছাপিয়ে না দিয়ে অন্য ব্যাংক থেকে ধারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। এর মানে বাজারের টাকা এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে যাবে মাত্র। ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর বাড়তি প্রভাব পড়বে না।”
আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টির মানে হল, কোনো কারণে এসব ব্যাংক সহায়তার টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা পরিশোধ করে দেবে, বলেন ওই কর্মকর্তা।
আরেকজন ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, জামিনদার হওয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও একটি কমিশন পাওয়ার কথা।
তবে হার কেমন হবে বা কীভাবে সেই কমিশন নেওয়া হবে, সে বিষয়টি জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।