বিপুল খেলাপি ঋণ ও শৃঙ্খলার অভাবে ব্যাংক খাত সরকারের যে মাথাব্যথার কারণ ঘটাচ্ছে, তা থেকে মুক্তির কোনো স্পষ্ট পরিকল্পনা নতুন অর্থবছরের বাজেটে ‘না থাকায়’ প্রশ্ন তুলেছেন কয়েকজন অর্থনীতিবিদ।
Published : 14 Jun 2019, 01:10 AM
বিদায়ী অর্থবছরে যেখানে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২২ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে, সেখানে এবার আরও বড় লক্ষ্য ঠিক করা বাস্তবসম্মত হল কি না, সেই প্রশ্নও এসেছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেন। টাকার অঙ্কে এই ব্যয়ের ফর্দ বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৮ শতাংশ বেশি।
দেশের অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক ইতিবাচক ধারায় থাকলেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যের তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে আছে। ফলে বিনিয়োগে স্থবিরতা কাঠছে না।
এই পরিস্থিতিতে আর্থিক খাতের সংস্কার, ব্যাংক খাতের সুশাসন, পুঞ্জিভূত খেলাপি ঋণ, বাড়তে থাকা আয় বৈষম্য, পুঁজিবাজারে আস্থার সঙ্কটের মত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মুস্তফা কামাল কী পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন সেটাই ছিল বাজেটের আগে অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টদের আগ্রহের মূল বিষয়।
অর্থমন্ত্রী কামাল এ বিষয়ে তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, “ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা সুদৃঢ় কার জন্য একটি ব্যাংক কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা আমরা দীর্ঘদিন শুনে আসছি। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।”
ব্যাংক খাতের সঙ্কটের একটি ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ব্যাংক খাতের গুরুত্বপূর্ণ কিছু জায়গায় এ পর্যন্ত কোনো সংস্কার হয়নি। ঋণ শোধে ব্যর্থ হলে সেই চক্র থেকে ঋণগ্রহিতার বেরিয়ে আসার কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
“আমরা এবার কার্যকর ইনসলভেন্সি আইন ও দেউলিয়া আইনের হাত ধরে ঋণ গ্রহিতাদের এক্সিটের ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
পাশাপাশি আর্থিক খাতের সংস্কারে পর্যায়ক্রমে ব্যাংকের মূলধনের পরিমাণ বাড়ানো, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা এবং বন্ড মার্কেটকে গতিশীল করার পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনার কথা বলেন কামাল।
কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ
“দেশের ব্যাংক খাত একটা বড় সমস্যা; সে বিষয়টি বাজেটে এসেছে, তবে আরও স্পষ্টভাবে সেটা আসতে পারত।”
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক জায়েদ বখত বলেন, “ব্যাংকিং খাতের উপর কিছু জেনারেল কথাবর্তা আছে, কিছু স্পেসিফিক কথাবার্তা আছে। তবে ডিটেইল কিছু নাই, হয়ত কৌশলগত কারণে নাই অথবা বাজেটে এত কথা বলা যায় না।”
সরকার ঋণখেলাপিদের যেসব সুবিধা দিতে চাইছে, তা নিয়ে অনেকের মতের সঙ্গে একমত নন জানিয়ে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, “গতবার এই সুবিধা নিয়ে ১১টি গ্রুপের মধ্যে দুটি গ্রুপ বের হয়ে আসতে পেরেছিল।”
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সেলিম রায়হান মনে করছেন, দুর্দশায় থাকা ব্যাংক খাত নিয়ে যতটা মনোযোগ দেওয়া উচিৎ ছিল, বাজেটে তা দেওয়া হয়নি।
আর সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, “ব্যাংক খাতের খারাপ অবস্থার কোনো স্বীকৃতি বাজেট বক্তব্যে ছিল না। ব্যাংক নিয়ে যা আছে তা খুবই সামান্য।”
কেমন বাজেট হল?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য
তার ভাষায়, ২০১৯-২০ সালের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের ‘অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন’ ঘটেনি।
এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ১৯ শতাংশের বেশি।
বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা, আদায় সন্তোষজনক না হওয়ায় তা সংশোধন করে ৩ লাখ ১৬৬১২ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
দেবপ্রিয় বলেন, “আগের অর্থবছরের কর সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা তিনি (সংশোধিত বাজেটে) ২২ হাজার কোটি টাকা কমিয়েছেন।… তাহলে এবারের কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা কিন্তু বাস্তবসম্মত হল না।”
নতুন বাজেটে আয়-ব্যয়ের সামগ্রিক ঘাটতি দেখানো হয়েছে এক লাখ ৪১ হাজার ২১২ কোটি টাকা। এই ঘাটতি মেটাতে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ১ লাখ ৪১ হাজার ২১২ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন তিনি, যার ৪৮ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা নেওয়া হবে ব্যাংক থেকে।
দেবপ্রিয় বলেন, “সরকার যে ব্যাংক খাত থেকে ওই ঋণ নেবে, সেক্ষেত্রে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা টাকা কোথা থেকে পাবে?”
তিনি বলেন, আগে সম্পদের পরিমাণ আড়াই কোটি টাকার নিচে হলে সার চার্জ দিতে হত না। অর্থমন্ত্রী এখন সেই সীমা বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা করার কথা বলেছেন।
“বিত্তশালীদের অনেকে এমনেই তো অনেক টাকার সম্পদ কম দেখাচ্ছে। যেখানে বৈষম্য এত বাড়ছে, সেখানে এটা কেন করা হল সোট বোধগম্য না,” বলেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো।
তিনি বলেন, “বাজেটে নতুনত্ব নেই। এটা ধারাবাহিক বাজেট। বাজেট নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী হয়নি। এক কথায় বাজেটে বস্তবতার প্রতিফলন হয়নি।”
তবে কাজী খলীকুজ্জমানের মতে, অর্থমন্ত্রী হিসেবে মুস্তফা কামালের বাজেট ‘মোটামুটি’ হয়েছে।
“আওয়ামী লীগের ইশতেহারে যেসব কথা বলা হয়েছিল তার কিছু প্রতিফলন বাজেটে দেখা গেছে, যেমন গ্রামে শহরের সুবিধা দেওয়া, তরুণদের কাজে লাগানো…। এই বাজেটে শিক্ষা এবং প্রযুক্তির উপর জোর দেওয়া হয়েছে, বৈষম্য কমানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, দারিদ্র্য বিমোচনের কথা আছে।”
পিকেএসএফ চেয়ারম্যান বলেন, বাজেট বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে শুরু থেকেই। তা না হলে এর সুফল পাওয়ার আশা থাকবে না।
“আনেক সময় দেখা যায় প্রথমে খুব আস্তে আস্তে বাস্তবায়ন হয়, পরে গিয়ে দ্রুত বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়। এটা খুব ভাল ফলাফল দেয় না।
“সরকারকে রাজস্ব আহরণে জোর দিতে হবে। করদাতা ১ কোটিতে উন্নীত করার কথা বলা হচ্ছে, সেটা কিভাবে হবে সে বিষয়টির দিকে খেয়াল রাখতে হবে।”
জায়েদ বখত
অর্থনীতির অধ্যাপক সেলিম রায়হান নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে বর্ণনা করতে চান একটি ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষী’ বাজেট হিসেবে। তবে এ বাজেট বাস্তবায়নের জন্য স্পষ্ট কোনো দিক নির্দেশনা তিনি অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় দেখতে পাচ্ছেন না।
“বাজেট বাস্তবায়নের দুর্বলতা যেন ইদানিং একটি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে। সরকারের মন্ত্রণালয়গুলোর বাজেট বাস্তবায়নের দক্ষতা কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে।”
এবারের বাজেটে সবার জন্য পেনশন, সরকারী কর্মচারীদের বীমা, ওয়েলথ ট্যাক্স, যানবাহনের নিবন্ধন কর বৃদ্ধি, রেমিটেন্সে প্রণোদনা এবং উপজেলা পর্যায়ে এনবিআরের অফিস করার উদ্যোগকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবেই দেখছেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম।
“তবে অতীতে নেওয়া অনেক ভালো পদক্ষেপ কেন বাস্তবায়ন করা যায়নি, তার কোনো মূল্যায়ন এখানে নেই। এই মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকাটা জরুরি। তা না হলে অনেক ভালো উদ্যোগই কেবল কথার মধ্যে থেকে যাবে।”
সেলিম রায়হান
তিনি বলেন, শাস্তি বা সংশোধনমূলক ব্যবস্থা না রেখে রাজনৈতিক বিবেচনায় এ ধরনের সুযোগ দেওয়া হলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
সেলিম রায়হান বলছেন, রপ্তানি বাড়াতে হলে এখন তৈরি পোশাক খাতের চেয়ে অন্যান্য খাতে বেশি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন, প্রস্তাবিত বাজেটে তা অনুপস্থিত।
বিদ্যমান কর কাঠামো ও আইন দিয়ে দেশের কর-জিডিপি অনুপাতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি সম্ভব বলেও তিনি মনে করেন না।
অধ্যাপক সেলিমের মতে, ব্যাংক খাতের মত দেশের কৃষি খাতও অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাবে কাঙ্ক্ষিত মনোযোগ পায়নি।