জার্মানিতে ‘দেশি গার্লসের’ আয়োজনে মেলায় সারাদিন

ঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুলঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুল
Published : 13 July 2022, 12:33 PM
Updated : 22 July 2022, 07:26 AM

স্টুটগার্টে বেশ কিছুদিন থেকেই চলছিল বৈশাখী মেলার আয়োজন। ফারজানা ভাবী তো সেই দু'মাস আগেই আমাকে বলে রেখেছিলেন যেন কোনভাবেই মিস না করি। তাই যখন করোনায় আক্রান্ত হলাম, এবং বেশ ভয়াবহভাবেই; তখন মাঝেমাঝেই মনে হচ্ছিল, সবাই বুঝি অনেক মজা করে ফেলবে; আর আমি বাসা থেকে বের হতেই পারবো না।

কোভিড নেগেটিভ আসার পরেও শরীর ভালো নয়; ভাবছি শুধু প্রায় ২৫০ কিলোমিটার ড্রাইভ করে যাওয়া উচিৎ হবে কিনা এই শরীর নিয়ে। কারণ আমার বর ও পুত্রও কেবলমাত্র সেরে উঠছে। এদিকে মেলা শুরু হবার অনেক আগে থেকেই যেন একটা উৎসব-উৎসব-ভাব শুরু হয়ে গিয়েছিল। মূলত 'দেশী গার্লস' এর উৎদ্যোগেই এই মেলা আয়োজিত হয়েছিল।

স্টুটগার্টে বাস করা বাংলাদেশি প্রবাসী নারীদের নিয়েই প্রথমে এই গ্রুপটি খোলা হয়েছিল। পরে জার্মানিতে থাকা সব প্রবাসী বাংলাদেশি নারীই যুক্ত হতে শুরু করলো।

বেশ কিছুদিন প্ল্যানিং করার পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, সবাই মিলে বিদেশের মাটিতেই বৈশাখী আমেজ তৈরী করা হবে। সাজ সাজ রব পরে গেলো যেন সবার মাঝেই। কীভাবে সাজানো হবে, কী কী স্টল থাকবে, কোন কোন খাবারের ব্যবস্থা করা হবে, কী ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে, সবার যেন উৎসাহ বাঁধ মানছিলই না।

জার্মানিতে তো আজ থেকে কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশি কোন পোশাক, গহনা কিংবা বাড়ির সাজসজ্জার পণ্যই পাওয়া যেতো না, গেলেও খুব হাতে গোনা। আমার মা তখন বিশাল বড় বাক্সে বাংলাদেশ থেকে আমার আর আমাদের জন্য বাংলাদেশি পোশাকসহ অনেক কিছু পাঠাতেন। আর এখন তো বাংলাদেশি কিংবা আরও বড় করে বললে সাউথ এশিয়ান ট্রাডিশনাল পণ্য পাওয়া যায়! তবে সবই অনলাইনে হওয়ায় বিক্রেতা  ও ক্রেতা-দুই প্রবাসী বাংলাদেশিদের যেন কিছুতেই সামনাসামনি দেশীয় তরিকায় গল্পে মেতে ওঠার সুযোগ হচ্ছিল না। সেই সুযোগ এনে দিলো দেশি গার্লসের ব্যানারে 'বৈশাখী মেলা'। যেখানে সকল প্রবাসী উদ্যোক্তা একই ছাদের নিচে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করার সুযোগ পেলো। জার্মানির নানা শহর থেকে এক হতে থাকলো সবাই এই মেলাকে উদযাপন করার জন্য। গ্যালারী বাই নুসরাত, শাড়িকথন বাই নিনিয়া, বাংলার অঙ্গন কিংবা দেশীয় মিষ্টি স্বাদের মিষ্টি ভান্ডার ফানুস- সকলেই চলে এলো নিজ নিজ পণ্য নিয়ে।

অবশেষে ঠিক করলাম,  এত রঙিন আয়োজনের অংশ না হতে পারলে তো কিছুতেই চলবে না। উপরন্তু গ্যালারী বাই নুসরাতে ভলান্টারি সার্ভিস দেব বলে ঠিক করলাম। ছোট বোন বলে কথা। এক সপ্তাহ ধরে কীভাবে স্টল সাজাবো, কী কী নেব ইত্যাদির প্ল্যানিং করলাম আমরা।

একে তো আমি ফাঁকিবাজ, সেই সঙ্গে অসুস্থ; তাই কায়িক শ্রম প্রায় কিছুই দিতে পারলাম না। সব গিয়ে পড়লো, নুসরাতের কাঁধে। আমি কিন্তু মহা উৎসাহ দিয়ে বলেই যেতে থাকলাম,'নো টেনশন, আমি আছি।' কিন্তু ঠিক কোন কাজে আছি সেটা বলা মুসকিল।

মেলার দিন সকালবেলা সবাই পৌঁছে দেখলাম ঢোকার মুখে রিসিপশন সাজানো হয়েছে। যারা অংশগ্রহণ করবেন তাদেরকে পাঁচ ইউরো দিয়ে রেজিষ্ট্রেশন করতে হয়েছিল। আমাদের দেশি গার্লসের ব্যাজ ও স্যুভেনিরসহ উপহার দেওয়া হল শিশু ও অতিথিদের।

যে যার স্টল সাজাচ্ছেন। ভার্চুয়ালি দেখা মুখগুলো সামনাসামনি দেখে একে অন্যের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করল।দারুণ আড্ডায় মেতে উঠল সবাই নিমিষেই। দেখলাম দু'টি বিশেষ স্টল, একটির নাম 'চিকি মাঙ্কি' এখানে বাচ্চাদের খেলনা পাওয়া যাচ্ছে আর অন্যটি 'শাওন ভাবীর স্টল'।

বিশেষ কেন বললাম? কারণ এখানে এমন সব পোশাক কিংবা খেলনা পাওয়া যাচ্ছিল যা কিনা তাদের সন্তানদের ব্যবহার করা; কিন্তু একদম নতুন। একবার পরা হয়েছে কিংবা একবার খেলে বাচ্চা আর খেলেনি। এখন সেসব সবার সাথে শেয়ার করছেন।

জার্মানিতে এটি একটি ট্রাডিশন, তারা তাদের ভাল জিনিসপত্র, পোশাক, খেলনা কিংবা বই, এমন অনেক কিছুই যা আর তারা ব্যবহার করবেন না অথচ অন্যের ব্যবহারযোগ্য রয়েছে ফেলে না দিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দেন। যার প্রয়োজন বা যিনি নিতে চান নিয়ে যান। ঠিক সেই কায়দাতেই একসাথে অনেক কিছু নিয়ে সবার সাথে শেয়ার করার আগ্রহকে বিশেষ বলতেই হয়।

মেলায় আরও ছিল কিছু খাবার স্টল। কোনোটাতে ঘরে বানানো মুখরোচক কেক, কোনোটাতে কলিজা সিঙ্গারা গরম গরম কিংবা লাবরার সাথে লুচি ভাজা। কোনটা ছেড়ে কোন খাবো ভাবতে ভাবতেই দেখলাম রিমা আর সোমেশ তাদের দেশি চটপটি, ফুচকা আর দই ফুচকার আইটেম নিয়ে হাজির হয়ে গেলো।

আমি হলাম ভোজনরসিক, সহজ বাংলায় একজন পেটুক। সবাই পে-পালের সাহায্যে পেমেন্ট করে দিচ্ছে আর খাচ্ছে। আর পাশাপাশি মুক্তমঞ্চে রয়েছে গানের আয়োজন। বাংলার গান গেয়ে যাচ্ছেন। সে এক মোহিত বাংলাদেশি পরিবেশ।

এই বৈশাখী মেলার বেশ কিছু বিশেষত্ব ছিল। প্রথমত, প্রবাসীদের মিলনমেলা; দ্বিতীয়ত, সকল বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের একই ছাদের নিচে সকলের মাঝে এনে উৎসাহ দেওয়া ও বাস্তব দেশিয় কেনাকাটার অনুভব দেওয়া এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণটি হলো, আয়োজনের পরে বাড়তি অর্থ বাংলাদেশ থ্যালাসামিয়া ফাউন্ডেশনে দিয়ে দেবার উদ্যোগ।

দিন গড়িয়ে হাসি-আড্ডা-গান আর কেনাকাটায় সন্ধ্যে হয়ে গেলো। এবার বাড়ি ফেরার পালা। গোধূলীর আলো এগিয়ে চললাম নিজের শহরে; সাথে করে নিয়ে নিয়েছিলাম একটি আনন্দঘন, আতিথেয়তাপূর্ণ ও ভালবাসাময় দিনের স্মৃতি।