Published : 17 May 2017, 02:07 AM
আজকাল হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (Human Resource Management) আমাদের দেশের অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চালু করেছে। তবে এর প্রয়োগ এখনও ব্যাপক আকারে শুরু হয়নি। কর্মী নিয়োগ, ছাঁটাই, বেতন-বোনাস ইত্যাদি শুধু এই বিভাগটির দায়িত্ব নয়। কর্মীদের ভাল-মন্দ দেখাশোনা, আত্মসচেতনতা ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিও এর অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের জন্য এটি দরকারী এজন্য যে, কর্মচারীদের উন্নয়ন একটি প্রতিষ্ঠানের সফলতার পূর্বশর্ত। আর তাই সকল প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগের উচিত কর্মচারী উন্নয়নের উপর জোর দেয়া।
কর্মচারী উন্নয়নের কতগুলো স্বীকৃত পদ্ধতি রয়েছে। তার একটি হলো জোহারি উইন্ডো মডেল (Johari Window Model)। এটি এমন একটি পদ্ধতি যা দ্বারা আমাদের একে অপরের সাথে পারস্পরিক সম্পর্কটা ভালোভাবে বোঝা যায়। কর্মক্ষেত্রে এক সাথে কাজ করতে গেলে পারস্পরিক সম্পর্ক অনুধাবন করাটা জরুরি। এতে দলগত কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। আর আমরা জানি যে "Teamwork makes the dream work"।
আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী Joseph Luft এবং Harry Ingham ১৯৫৫ সালে এই মডেলের প্রবর্তন করেন। Joseph থেকে "Jo" আর Harry থেকে "hari" একত্র করে এর নামকরণ করা হয় Johari Window Model । এই মডেল মূলত একজনের সম্পর্কে অন্য সকলের ধারণা বৃদ্ধি করে, সেই সঙ্গে নিজের কিছু লুক্কায়িত, অজানা তথ্যও জানা সম্ভব।
জোহারি উইন্ডো-তে ৫৬টি বিশেষণের তালিকা (পরিশিষ্ট- ১) থাকে যা ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়। জোহারি উইন্ডো মডেল অনুশীলন এবং বোঝার জন্য একটি ঘরকে কল্পনা করা হয় যার চারটি সমান আকারের কক্ষ আছে। এগুলো ব্যক্তির নিজের এবং অন্যের কাছে জানা-অজানা বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য যেমন- দোষ, গুণ, অনুভূতি ইত্যাদি চারটি দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করে। এর দুটি কক্ষ নির্দেশ করে নিজের সম্পর্কিত জানা সকল তথ্য, আর বাকি দুটি নির্দেশ করে নিজের সম্পর্কিত অজানা তথ্য কিন্তু তা অন্যরা জানে।
পদ্ধতিটি অনুশীলনের পূর্বে সহকর্মীদের বিশেষণগুলোর তালিকা দেয়া হয়। অতঃপর তারা ব্যক্তি সম্পর্কে এর মাধ্যমে মন্তব্য প্রদান করে। একই সাথে ব্যক্তি নিজেও ঐ তালিকার মাধ্যমে নিজেকে বর্ণনা করে। উভয়ের বিশেষণগুলো দ্বারা পরবর্তীতে কক্ষগুলো পূরণ করতে হয়। এখন দেখা যাক জোহারি উইন্ডোর কক্ষগুলো কেমন?
কক্ষ নং ১: এটি কে মুক্ত এলাকা বা এরেনা (Open area or arena) বলা হয়। সাধারণত, একসাথে দৈনন্দিন কাজের মাঝে আমরা একজন আরেকজনকে জানতে পারি। এই অংশটিতে ব্যক্তি সম্পর্কিত সেই সকল তথ্য থাকে যা সহকর্মীদের এবং ব্যক্তির নিজের, উভয়ের কাছেই তা জানা। একে অপরকে যত বেশি জানা যাবে নিজেদের ভিতর অজানা তথ্যের পরিমাণ কমে আসবে। সহকর্মীদের সাথে সম্পর্কটাও তত কার্যকর ও গতিশীল হবে। চিত্র-১ এ মুক্ত এলাকার দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ যত বাড়বে পার্শ্ববর্তী কক্ষগুলো তত ছোট হবে।
কক্ষ নং ২: এই কক্ষটিকে বলা হয় অন্ধ এলাকা (Blind Spot)। এটি নির্দেশ করে ব্যক্তি সম্পর্কিত সে সকল তথ্য যা তার সহকর্মীরা জানে কিন্তু তার কাছে অজানা। আমরা এরকম অনেক কিছুই জানিনা যা আমাদের সম্পর্কে অন্যরা জানে। স্বাভাবিক ভাবেই অন্যরা আমাদের সম্পর্কে ভিন্ন ধারণা পোষণ করতেই পারে যা আমরা কখনো ভাবতে পারি না। ব্লাইন্ড স্পট কমাতে হলে সহকর্মীদের কাছ থেকে নিজের সম্পর্কে জানতে হবে।
কক্ষ নং ৩: এটি হচ্ছে গুপ্ত এলাকা (Hidden Area or Facade)। আমাদের মাঝে অনেকেই আছে যারা নিজেদের গুটিয়ে রাখে। অনেক কিছুই তারা জানে কিন্তু তা শুধু নিজেদের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখে, অন্যদেরকে জানতে দেয় না। এই কক্ষটি সেসকল তথ্য ধারণ করে। উদাহরণ স্বরূপ, গোপন অনুভূতি, অতীত অভিজ্ঞতা ইত্যাদি, ভয়, লজ্জা বা সংকোচ এর কারণে আমরা লুকিয়ে রাখি যা কর্মক্ষেত্রে এমনকি দৈনন্দিন জীবনেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। এই কক্ষটিকে ছোট করার জন্য অজানা তথ্যগুলোকে মুক্ত এলাকায় স্থানান্তরিত করতে হবে।
কক্ষ নং ৪: এই অংশটির নাম অজ্ঞাত এলাকা (Unknown Area)। এই অংশটিতে ব্যক্তির সেই সকল তথ্যগুলি থাকে যা তার নিজের কাছে এবং একই সাথে অন্যের কাছেও অজানা। যেমন- লুক্কায়িত ক্ষমতা বা প্রতিভা যা অপ্রকাশিত থাকার কারণে সারা জীবনের জন্যই অজানা থেকে যেতে পারে। এসকল লুক্কায়িত গুণাবলি এবং দক্ষতা নিজের অথবা অন্যের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত তা নিজের কিংবা সবার কাছেই অজানা থেকে যায়। আবার তাৎক্ষণিক অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনায়ও লুক্কায়িত প্রতিভার প্রকাশ হতে পারে।
এখন একটি ছোট উদাহরণ দিয়ে পুরো মডেলটি সংক্ষেপে বর্ণনা করা হবে।
শাহানা কিছুদিন হয় একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে অফিস সহকারী হিসাবে যোগ দেয়। নতুন বলে সহকর্মীরা তার সম্পর্কে খুব কমই জানে। এক্ষেত্রে শাহানার Unknown এবং Hidden area, Open area থেকে অনেক বড় হবে, যা চিত্র- ২ এর মতো দেখাবে।
শাহানা সংকোচের কারণে সবার সাথে তেমন মিশতে পারছিলনা আবার তার সহকর্মীরাও লক্ষ্য করল সে একটু লাজুক প্রকৃতির। শাহানা জোহারি উইন্ডো মডেল সম্পর্কে জানতো। সে কাজের অবসরে নিজের সম্পর্কে সকল তথ্য গল্প আকারে লিখে সহকর্মীদেরকে একটি করে কপি দিল সাথে বিশেষণের তালিকা দিয়ে তাদের কাছ থেকেও নিজের সম্পর্কে মতামত চাইলো। তার লেখা পড়ে সবাই বুঝতে পারলো তার লেখার হাত বেশ ভালো। শাহানা সব মতামত সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করল এবং জানতে পারলো তার লাজুক স্বভাবের কথা যা তার অজানা ছিল। আর অবাক ব্যাপার হলো সে যে এত ভালো লিখতে পারে এই প্রতিভা আগে অন্যরা তো দূরের কথা সে নিজও জানতো না কিন্তু এখন তা প্রকাশ পেল। এখন শাহানার Open Area, Unknown এবং Hidden area থেকে অনেক বড় হবে যা চিত্র- ৩ এর মতো দেখাবে।
শাহানার এই উদ্যোগ তার সহকর্মীদের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরী করে যা তাদের দলগত কাজের দক্ষতা বাড়িয়ে দেয়। আর এটা তার প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদ বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মানবসম্পদ বিভাগের ম্যানেজার পরবর্তীতে কর্মচারী উন্নয়নের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিলেন তার প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মচারীই এখন থেকে নিয়মিত পারস্পরিক তথ্য আদান-প্রদান করবে।
পরিশিষ্ট- ১: জোহারি উইন্ডো বিশেষণের তালিকা
Source: Miller, B. (2017) An Introduction to the Johari Window, Executive Velocity.