Published : 18 Feb 2017, 07:58 AM
ভাষাতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্ব গবেষকগণের মত অনুসারে, এখানে কলিঙ্গ দেশের সাথে একটি প্রাচীন রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়েছিল একদিন, যার নাম ছিল কমলিঙ্ক। কমলিঙ্ক রাজ্যটি পরে ব্রাহ্মণ্য প্রভাবধীনে এসে কমলাঙ্ক নাম ধারণ করে। খৃষ্টীয় সপ্তম শতকের দিকে দ্বিতীয় দশকে চৈনিক পরিব্রাজক যূয়ান চোয়াং তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে 'কিয়ামলংকিয়া' নামক একটি স্থানের নাম উল্লেখ করেন। কারো কারো মতে 'কিয়ামলংকিয়া'ই হচ্ছে কমলাঙ্ক। পণ্ডিতগণ বলেন এই সকল যাবতীয় নামসমূহ আধুনিক কুমিল্লার প্রাচীন নামেরই অপভ্রংশ। চতুর্দশ শতকের প্রথম দিকে হযরত শাহ্জালাল, তার মামা আহমদ কবীর কর্তৃক প্রদত্ত এক মুঠো মাটি নিয়ে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন। প্রথম দিন শহরের পূর্বদিকে অবস্থিত ঘিলাতলী নামীয় এক স্থানে উঁচু টিলার উপরে রাত্রি যাপন উদ্দেশ্যে তাঁবু ফেলেন তিনি। সাথে আগত চাশমী পীর তাঁদের বয়ে আনা মাটির সাথে অত্র এলাকার মাটির সাদৃশ্য খুঁজে পেয়ে উল্লাসে চিৎকার করে বলে উঠেন "কোহমিলা"। অনেকের মত এভাবেই জন্ম নেয় নাম কুমিল্লা।
কুমিল্লা ছিল একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চল অধীন, খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৩৩ইং সালে বাংলার নবাব সুজাউদ্দিন ত্রিপুরাকে সুবে বাংলার অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৭৬৫ ইং সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দখল নিয়ে নেয় কুমিল্লার। তখন নোয়াখালীও ছিল কুমিল্লার অন্তর্ভুক্ত। ১৭৮১ইং সালে নোয়াখালীকে কুমিল্লা থেকে পৃথক করা হয়।
'রাজমালা' গ্রন্থটি ত্রিপুরা ও তার রাজবংশের এক ইতিহাস কথা। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও শ্রীহট্ট যখন ত্রিপুরার রাজার অধীনস্থ ছিল, 'রাজমালা' সেই সময়কালের ইতিহাসকথা। রাজা প্রথম ধর্ম-মাণিক্যের রাজত্বকালে ১৪৩১ খ্রিস্টাব্দে বাংলা পদ্যে রাজমালা প্রথম রচিত হয়, পরে বিভিন্ন সময়ে নতুন তথ্য যোগে এটির হালনাগাদ করা হয়, সম্পাদনা করেছেন কালীপ্রসন্ন সেন বিদ্যাভূষণ।
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী যখন লক্ষ্মণসেনকে পরাজিত করে গৌড় অধিকার করেন , তখন ত্রিপুরার সিংহাসনে আসীন সিংহতুঙ্গ , মতান্তরে যার নাম ছিল কীর্তিধর বা ছেংথুম ফা, প্রথম রত্নমাণিক্য, ১২৭৯-১৩২৩ খ্রিঃ। সেই সময় হীরাবন্ত খাঁ নামে জনৈক ধনবান জমিদার ত্রিপুরেশ্বরের অধিকার সান্নিধ্যে বাস করতেন। মেহেরকুল নামীয় এলাকাটি যা পরবর্তীকালে একটি পরগণায় (অনেকগুলো গ্রাম নিয়ে গঠিত শাসন ব্যবস্থা) পরিগণিত হয়, কমলাঙ্ক বা কুমিল্লা অঞ্চলটি ছিল মূলত মেহেরকূলেরই অন্তর্গত। হীরাবন্ত খাঁ গৌরের নবাব থেকে মেহেরকুলের সনদ পেয়ে কর্তৃত্ব করতেন, সেজন্য নবাবকে করের পরিবর্তে এক নৌকা পরিমাণ বহুমূল্য দ্রব্য উপহার দিতেন। একসময় ত্রিপুররাজ জানতে পারলেন, হীরাবন্ত খাঁ মূল্যবান ধনরত্নসমূহ মূলত ত্রিপুরা রাজ্য থেকেই সংগ্ৰহ করে 'গৌরের নবাব'কে পাঠিয়েছেন। এই ঘটনায় ত্রিপুররাজ ক্রুদ্ধ হলেন এবং হীরাবন্ত খাঁ কে এরূপ না করতে নির্দেশ দিলেন। হীরাবন্ত খাঁ ত্রিপুরেশ্বরের আদেশ অবজ্ঞা করলেন। তাই ত্রিপুররাজ সৈন্যকুল নিয়ে মেহেরকুল (কুমিল্লা সহ আশপাশের অঞ্চল) আক্রমণ করে তার সর্বস্ব লুটে নিলেন। হীরাবন্ত খাঁ এরূপে ত্রিপুররাজ কর্তৃক পরাস্ত হয়ে গৌড়ের নবাবের নিকট ধন্না দিলেন। ত্রিপুররাজ উদ্ধার করে নিজ-ভাণ্ডারে নিয়ে আসলেন সকল রত্নসমূহ।
হীরাবন্ত খাঁ' গৌরের নবাব'কে যথাশীঘ্র ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমণ করা উচিত বলে মত দিলেন, নবাব তাতে সম্মত হলেন। ত্রিপুররাজের সাথে প্রবল প্রতাপ গৌড় নবাবের যুদ্ধ বেঁধে গেল। গৌড় নবাব প্রায় ২৷৩ লক্ষ সৈন্যসহ ত্রিপুরা সীমান্তে হানা দিতে উদ্যত হলেন। তখন ত্রিপুররাজ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন এবং উপায়ন্তর না দেখে গৌড় নবাবের সাথে সন্ধির করার পাঁয়তারায় নিয়োজিত হলেন ত্রিপুররাজ। রাজার এই ভীরুতার কথা রাজরাণীর কানে পৌঁছে গেল। রাণী ক্রোধে জ্বলে উঠলেন, স্বামীর কাছে জানতে চাইলেন- "হে নরনাথ, তুমি একি কথা কহিতেছ? পূর্বপুরুষের কীর্ত্তি লোপ করিতে চাও? ছি! ছি! যদি নবাবের সৈন্য দেখিয়া ভয় পাইয়া থাক তবে অন্তঃপুরে আরামে বাস কর, আমি রণে ঝাঁপাইয়া পড়িলাম।"
রাণীর প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় রাজার সন্ধি সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটে, প্রচণ্ড যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিলেন। সৈন্যদের কাছে জানতে চাইলেন "কি বল ত্রিপুরা সৈন্যগণ, তোমরা কি যুদ্ধ চাও, না চাও না? তোমাদের রাজা সিংহের কুলে শৃগাল হইয়া জন্মিয়াছে। ভয়ে ঘরের কোণে লুকাইয়া থাকিতে চায়। রাজা ভয়ে ভীত হউক আমি ভয় করি না। রাজ্যের মান রাখিতে আমি যুদ্ধে যাইব। তোমাদের প্রাণে যদি তিল মাত্র বল থাকে তবে আমার সঙ্গে চল।" রাণীর বচনে সৈন্যদের হৃদয়ে বল সঞ্চারিত হল। সকল সৈন্য সমস্বরে বলে উঠল "আমরা ভয় করি না মা, আমরা ভয় করিনা, তুমি মা হইয়া যদি যুদ্ধে চল আমরা সন্তান হইয়া তোমার পেছনে যাইব।" সীমাহীন আনন্দে আপ্লুত হলেন রাণী। রণরঙ্গিণী মূতিতে তিনি হস্তিপৃষ্ঠে অগণন সৈন্য সহ যুদ্ধ যাত্রা করলেন। উপায়ন্তর না পেয়ে ত্রিপুরা রাজাও আর ঘরে বসে না থেকে যুদ্ধে যোগ দিলেন অতঃপর। (রাজমালা, ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ/২)
রাণী'র রণরঙ্গিণী মূর্ত্তিতে হস্তিপৃষ্ঠে অগণন সৈন্য সহ যুদ্ধ যাত্রা।
ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা আলোড়ন তুলেছেন এবং পরিবর্তনের ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তাঁদের অনেকেই ঈশ্বর পাঠশালা কুমিল্লা মহেশাঙ্গনে সভা করেছেন, তন্মধ্যে অন্যতম- এ. রসুল, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নৃপেন বসু, বিপিন পাল, মহাত্মা গান্ধী, চিত্তরঞ্জন দাশ, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সিসি রায়, সুভাষচন্দ্র বসু, অরবিন্দ ঘোষ, কস্তুরীবাই গান্ধী, মৌলভী লিয়াকত হোসেন, রাজা গোপাল আচারিয়া, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ড.দীনেশচন্দ্র সেন, সরলাদেবী চৌধুরানী, নরেন্দ্রনাথ দেব, ড.নলিনী ভট্টশালী, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, ক্ষিতিমোহন সেন, কালীমোহন ঘোষ, মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, আশ্রাফ উদ্দিন চৌধুরী, ত্রিপুরার মহারাজা মাণিক্য বাহাদুর, সরোজিনী নাইডু, হেমপ্রভা মজুমদার, মহেন্দ্রনাথ দাস, ভীম ভবানী, রাম মূর্তি, এ.ভি. থাক্কার, প্রাণগোপাল গোস্বামী, রামদাস বাবাজী, ভোলানাথ গিরি, আলোক বাবা, মা আনন্দময়ী, শ্রীমং পুরুষোত্তমানন্দ অবধূত, শশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার, শ্রীমৎ সমাধিপ্রসাদ আরণ্য, শ্রীমৎ মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, প্যারীমোহন ভট্টাচার্য্য, ডাবলিউ. এম. ক্লার্ক, বিধূশেখর শাস্ত্রী, ড.নীহাররঞ্জন রায়, ড.ধীরেন্দ্রনাথ সেন, ড.সুধীর সেন, স্বামী প্রাণবানন্দ, সীমান্ত গান্ধী আবদুল গাফফার খান, আইসিএস আলী ব্রাদার্স, মেজর এ.সি. চ্যাটার্জী, আচার্য এ.বি.কৃপালনি, সুচেতা কৃপালনি, মেঘনাদ সাহা, আনন্দশঙ্কর রায়, হুমায়ুন কবির প্রমুখ।
কুমিল্লা মহেশাঙ্গন।
গুগুল সার্চ-ইঞ্জিনে চড়ে, নানা বিধ ইতিহাস এবং পরস্পর বিরোধী কেচ্ছা কাহিনী আবিষ্কার, আজ আর তেমন কোন কঠিন কাজ নয়। পরিকল্পনা মন্ত্রী কর্তৃক নতুন বিভাগ ঘোষণার সাথে সাথেই, ইতিহাসের পাতা পড়ে পড়ে মারাত্মক আকারের ইতিহাসবিদ হয়ে উঠলেন এক একজন। আমজনতা সবাই হয়ে গেলেন- বিপুল আকারে জ্ঞানলব্ধ ও বিদগ্ধ এবং জেনে ফেললেন কুমিল্লার আপাদমস্তক ইতিহাস, পায়ের নখ থেকে চুল পর্যন্ত। কিন্তু এভাবে ঘরে ঘরে, আচমকা হাজার হাজার ইতিহাসবিদ জন্মগ্রহণ করে ফেলায়, আল্টিমেটলি কাজের কাজ হয়েছে কি কিছু? কেউ কেউ বলছেন- আলবৎ হয়েছে! ডেফিনেটলী হয়েছে! কেউ বলছেন- ঘন্টা হইয়াছে! বিড়াল মারতে যাইয়া ব্যাঘ্র মারিয়া ফেলিয়াছে তাহারা! তবে এরই মধ্যে, রাজনীতি আর ইতিহাস মিলে, চন্দ্রবিন্দু যোগে জন্ম নিয়ে নিল নতুন শব্দ রাজহাঁস, (রাজনীতি+ইতিহাস=রাজহাঁস)। এখন এই রাজহাঁসটি 'বিভাগ' নামীয় একটি সোনার ডিম প্রসব করে দিলেই, আমরা পেয়ে যাবো আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয় এবং খেলা হয়ে যাবে ফাইনাল!
কিন্তু যে নাটক এখন চলছে, দর্শক হিসাবে যে নাটক আমরা দেখছি- বিহাইন্ড দ্য স্টেজ নাটকের কুশীলব গণের কর্মকাণ্ডে আমরা অবশ্য কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত দিন কাটাচ্ছি। কেননা ইতোমধ্যে রাজহাঁস ডিম পেড়ে দিয়েছে 'কুমিল্লা'র বদলে 'ময়নামতি'! তবে কী নাটকের শেষ দৃশ্যের আগেই- নেমে যেতে পারে মঞ্চের পর্দা, ঠিক যেমনটা ভাবা হয়েছিল! তাহলে আমাদের কী হতে পারে ভবিষ্যৎ? সুদীর্ঘ প্রতীক্ষাটির, আর অবসান কী হল না? একজন বললেন- খেলা খুব সিম্পল, দাদা ঝুলে গেল সব! কিংবা প্রলম্বিত হয়ে যাওয়ার পথে পুরো প্রক্রিয়া! একজন বললেন- পরস্পর কাওয়া ক্যাচালে এখন স্থিতাবস্থা জারি হয়ে যাবে, উইদাউট এনি ঘোষণ, এনি টাইম! রাজহাঁস'টি বলল- স্যরি ভাই এ যাত্রায় দ্বিতীয় বার ডিম দিতে আর পারবো নেকো, দুই হাজার বিশ সালে আবার চেষ্টা করে দেখবো। ভাই, বিদায়- বাই বাই!
মহান জাতীয় সংসদে, কুমিল্লা সদর আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার প্রদত্ত একটি বক্তব্য থেকে জানা যায়, ১৯৮৬ সালে কুমিল্লা'কে বিভাগ করার জন্য আন্দোলন শুরু করে কুমিল্লাবাসী। কিন্তু সেই প্রত্যাশাটি দূরাশাই থেকে যায়। বিভাগ হয়ে যায় বরিশাল, বিভাগ হয়ে যায় সিলেট, বিভাগ হয়ে যায় রংপুর। কুমিল্লার মত ইতিহাস সমৃদ্ধ জনবহুল জেলাটির কপালে জুটে বঞ্চনা। তাই পরবর্তীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কেবিনেটে কুমিল্লাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবিটি অর্থাৎ কুমিল্লাকে বিভাগ করার কথা তুলে ধরায়, মাননীয় সংসদ সদস্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানান।
সেই বক্তব্যে তিনি এটাও বলেন, কুমিল্লার বর্তমান যা ইনফ্রাস্ট্রাকচার আছে তাতে এখন একজন বিভাগীয় কমিশনার আর একজন ডিআইজি বসিয়ে দিলেই বিরাট কোন কিছু করা ছাড়াই 'কুমিল্লা' বিভাগ হিসাবে কার্যক্রম শুরু করতে সক্ষম যে কোন সময়।
বিভাগ হয়ে যাওয়া মাত্রই, কুমিল্লাবাসীর জীবন যাত্রায় নেমে আসবে আমূল এক পরিবর্তন! আমার ক্ষুদ্র বিবেচনা বলে- এটি নিতান্তই একটি দিবা স্বপন, এই স্বপন আমি দেখি না, এই স্বপনে আমি বিশ্বাসীও নই। অঞ্চল ভিত্তিক উন্নয়ন অর্থাৎ নিজ জেলার পরিবর্তন হয়ে গেলেই দেশের উন্নতি সাধিত হয়- এই জাতীয় পক্ষপাতমূলক একচক্ষু ইজমবাদ আমি সমর্থন করিনা এবং এই মতবাদের আমি পৃষ্ঠপোষকও নই। সমগ্র দেশ তথা বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন হোক সেটাই আমার প্রত্যাশা!
কিন্তু সেই সাথে আমি এই কথাটিও দ্ব্যর্থহীণ স্বীকার করতে চাই- যে শহরের আলো-বাতাসে কেটেছে আমার কৈশোর, যেখানে আমার জন্ম, যে ধূলোয় আমি খেলেছি, আমার উদ্দাম যুবাকাল, আমার স্কুল আমার কলেজ, দূরন্ত সেই সব দিন- যেখানে ফেলে এসেছি- আমার প্রথম প্রেম, আমার প্রথম সিগারেট, আমার বখাটে জীবন, কবিতা গল্প কিংবা মিছিলে শ্লোগান, মরতে চাই যে মাটিতে- আমার সেই শহরের নামটি কিন্তু 'কুমিল্লা'। একসময়, ঠিক কতগুলো বেওয়ারিশ কুকুর ঘুরে বেড়াত শহরময়, আর কতগুলো ল্যাম্পপোস্টের লাইট আদৌ জ্বলেনি কোনদিন, আমার সব ডেটা ছিল মুখস্থ। কুমিল্লা শহরের প্রতিটি সাইনবোর্ডকে এঁকেছে চিত্রপুরী, কারুকার না মনির আর্ট- আমি তা জানতাম। তাই আমার সেন্টিমেন্টটি যখন অবমূল্যায়িত হয়- তখন আঞ্চলিকতা ভর করে আমার মগজে- আমি বেদনাহত হই, কুমিল্লার জন্য।
আমি আবেগায়িত হই কারণ কিংবা অকারণেই! এই ঢাকায় যদিও আমি থাকি, যে শহরে আমার জন্ম সেই শহর নিয়ে কটু কথা আমি শুনি, আপনি শোনান, আবার সেই আমার পেছনেই কর্মোদ্ধারে, ঘুরে বেড়াতে দ্বিধাগ্রস্ত হন না আপনি, আমি কিন্তু তখন নীরব থাকি। কেননা আমি জানি আমার জেলার লোকজন খুব ফেরেশতা টাইপ নয়। জাতির পিতাকে হত্যা করবার কাজে নিয়োজিত ছিল যারা, সব মির্জাফরের দল, তারা ছিল আমার জেলারই কুলাঙ্গার সন্তান সকলে, অবশ্য আপনারা তখন কেউ কেউ ছিলেন উল্লাসে! সেই কুকুরদের জন্য মাথা হেট করে ঘুরে বেড়াই- তবু উচ্চ কণ্ঠে বলিনি, কেউ কেউ ছিল সূর্য সন্তান, যাদের নাম নিতে পারতাম অনায়াসে! তবুও আমার কপালেই কেন নির্দিষ্ট হয় এই নিয়তি? বিভাগ না হলে, তেমন কিছু যায় আসে না, এ আর এমন কী ক্ষতি? তবু ময়নামতি কিংবা আয়নামতি নিয়ে এই ভানুমতীর খেলা, চাই বন্ধ হোক! বন্ধ হোক এই অবজ্ঞা-নীতি, বেঁচে থাকুক ময়নামতি এবং বেঁচে থাকুক শুধু রাজনীতি।
কুমিল্লাবাসীর দীর্ঘ প্রতীক্ষা যখন অনুমোদনের পথে, তখন তাদেরই মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জন্ম দিয়ে- 'ময়নামতি' নামীয় নতুন এই উদ্যোগটির কী মানে, বুঝতে পারি না হায়! ক্যালকাটা হয় কোলকাতা, কিন্তু সেখানে ধর্ষণ, হত্যা কমে গিয়ে আমজনতার কপালে উপচে পড়েছে সুখ- তা শুনিনি তো ভাই! যমুনা ব্রিজ না হয়ে, সেতু অব যমুনা হলেই বা কী? আগে সময় লাগত বেশি, এখন সাঁই সাঁই বেগে ছুটে চলে রাতের নাইট কোচ। তখন সময়ের চেয়ে জীবন ছিল দামী- এখন ব্রিজে চড়ার আগেই মারাত্মক সব দুর্ঘটনায় মরছে কত হাজার হাজার, কে রাখে কার খবর? আমরা ভাই আম নাগরিক। রাজনীতি করে খাই না, কিংবা খেয়েও রাজনীতি আমরা করি না! বড় সাধ ছিল মনে, বিভাগ হলে লিখতাম, বাসা ২/ক, হোল্ডিং নং ১১৫, মদিনা মসজিদ রোড, জেলা কুমিল্লা, বিভাগ কুমিল্লা, বাংলাদেশ। জাস্ট এতটুকুই ছিল চাওয়া! আর যেহেতু আপনারাও বলেন, কুমিল্লা'র লোক কু মতলব বাজ, জানি সব জানি! তাই ফলাফল আমাদের জন্য সু না হয়ে যখন কু হয়ে যায়- তখন দেখি, চেকনে কিন্তু দান মেরে দিয়েছেন তিনি! তখন লজ্জায় অবনত হই, আজকাল কে দেয় কার দাম! আর কেই বা নেয় ধীরেন্দ্রনাথ, ফয়জুন্নেসা কিংবা শান্তি সুনীতির নাম!
যারা যারা ময়নামতি'র ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে মাঠ গরম কর্মে নিয়োজিত, আপনাদের শুধু একটা কথা বলি ভাই- ময়নামতির ইতিহাস নিয়ে আমাদের কানের কাছে এসে যখন ঘ্যানর ঘ্যানর করেন- তখন সম্ভবত ভুলে যান, আপনি করছেন মায়ের কাছেই মাসির পুরানা গল্প! আমাদের তখন মেজাজ গরম হয়, যদিও তা প্রকাশ করি খুব অল্প! দিন ভর চিক্কুরাচ্ছেন, ভাবখান কিছুই আপনি জানেন না, কী আপনার ধান্দা, কেন আপনি চিক্কুরান এবং ভাবেন আমরা কিছুই বুঝি না!
ময়নামতি, একটি পুরনো শহরের ধ্বংসাবশেষ, যা ইতিহাস দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে প্রাচীনতম কুমিল্লারই অংশ বিশেষ হিসাবে। কিন্তু বর্তমানে ময়নামতি শুধুমাত্র এক সমৃদ্ধ প্রত্নতত্ত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়। আর কুমিল্লা! ধ্বংস-প্রায় মৃত কোন শহরের নাম নয়। কুমিল্লা, ইতিহাসের এক সমৃদ্ধ নগর- সুবিশাল এবং সুবিস্তৃত। কুমিল্লা জীবিত প্রাণবন্ত হয়ে বর্তমানে যথাযথ অবস্থায় বিদ্যমান, তাই ময়নামতির পাল্লা দিয়ে কুমিল্লাকে মাপা-মাপি করার এই প্রক্রিয়াটি- প্রথমত ভুল, যদি তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়ে থাকে, আর দ্বিতীয়ত এক কূট কৌশলের রাজনীতি, যদি তা উদ্দেশ্যমূলক হয়ে থাকে। এই রাজনীতি সরকারের জন্য ভীষণ অশুভ।
সূত্রঃ
বাংলা একাডেমি , "বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা, কুমিল্লা" প্রকাশ কাল মার্চ ২০১৪।