Published : 02 Jun 2011, 11:50 PM
জগতে মানুষের মর্যাদাগত অবস্থানটি ঠিক না করে মানুষের জন্য কোনো ধর্ম বা আদর্শ তৈরি করা যায় না। মানুষের মর্যাদা কী হতে পারে? মানুষের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মর্যাদা কী হতে পারে? আমরা এ প্রসঙ্গে নানা বিকল্প মত পাই। নিজের বা নিজেদের জন্য ঈশ্বরত্বের দাবীও নতুন কিছু নয়। অতীতে অনেক রাজাও এ দাবী করেছে। কিন্তু এ দাবী হাস্যকর। যে এক সময় ছিল না, যে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না, যে জানে না তার ভবিষ্যৎ কী, সে কিভাবে ভাবে যে, সে নিজেই ঈশ্বর বা তাঁর অংশ?
আদি কাল থেকে ঈশ্বরের উপাসকেরা বলে এসেছেন যে, মানুষ ঈশ্বরের বাছাই করা সত্ত্বা যার মধ্যে আত্মসচেতনতা, জ্ঞান, বেছে নেয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি তিনি দিয়েছেন; এবং এই সূত্রে সে ঈশ্বরের প্রতিনিধি। ঈশ্বর মানব সন্তানদেরকে সম্মানিত করেছেন। মানুষের জন্য এটি একটি বড় মর্যাদা, যা বস্তুবাদ বা সুখবাদ থেকে পাওয়া যায় না। মানুষের এই মর্যাদায় সকল মানুষই সমান এবং ভাই ভাই।
মানুষ ঈশ্বরের প্রতিনিধি—এটিই হতে পারে মানুষের জন্য সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মর্যাদা। এটিই হতে পারে জগতে মানুষের একমাত্র অনন্য মর্যাদা। এ মর্যাদা দেশ, কাল ও জাতি নির্বিশেষে সকলের মধ্যে ঐক্যসূত্র হিসেবে কাজ করতে সক্ষম। এ ছাড়া আর সব ধারণাই জীবনকে খণ্ডিত করে, মানব জাতিকে খণ্ডিত করে। আর খণ্ড থেকে আসে খণ্ডিত আদর্শ।
মানব জাতি বড় হয়েছে কালে কালে। একসময় ছিল শৈশব, তারপর কৈশোর। শৈশবে কৈশোরে পিতার উপর নিশ্চিন্ত নির্ভরতা নিয়ে জীবন যাপনই সন্তানদের কাজ হয়ে থাকে। এখানে সমস্যা চকলেটের সমস্যা, পেন্সিলের সমস্যা। পিতা বলেন: ভাবিত হয়ো না, যতগুলো চকলেট তোমার ভাই তোমার কাছ থেকে চুরি করে নেবে, আমি ততগুলো তোমাকে আবার ফিরিয়ে দেব।
সন্তান কৈশোরে এসে পা দিলে পিতা আবার বলেন: ও আমার সন্তানেরা, ভালবাসতে শেখ, ভালবাস, তবেই না তুমি পিতার ভালবাসা পাবে; তোমার দুটো পেন্সিল তোমার অন্য ভাই কেড়ে নিতে চাইলে তাকে আরও দুটো দিয়ে দাও; ভাবনা করো না, আমি তোমাকে দেব একেবারে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে কোচর পূর্ণ করে।
তারপর দিন গেলে, বছর গেলে সন্তান এক সময় সাবালক হয়। নিজের ব্যক্তিসত্তাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার সময় আসে। চকলেটের পেন্সিলের ভাবনার দিন শেষ হয়। এবার নিজেকে নিয়ে চিন্তা করার পালা। নিজের জীবন নিজে পরিচালনা করার পালা। এবারের ভাবনার বিষয় আর চকলেট-পেন্সিল না, চিন্তা আরও বিরাট কিছু নিয়ে। সে যে বিপুল কর্মের ভার!
এবার কী বলা যায়? এবার যে নতুন জীবনের উদ্বোধনের সময়! এবার মানব সন্তান হয়ে উঠলো ঈশ্বরের প্রতিনিধি। এবার মানুষ হলো ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্বকারী সেবক।
ও মানুষ! ও আদমের সন্তানেরা! চিন্তা কর। ভেবে দেখ। তোমার অস্তিত্বের ইতিহাস। তোমাকে ঈশ্বর শিখিয়েছেন যা তুমি জানতে না। শিখিয়েছেন তোমারই হাতের কলম দিয়ে। ভেবে দেখ তোমার প্রতিপালকের ঐশ্বর্যমণ্ডিত বিশালতা।
যারা নিজেকে আচ্ছাদিত করে রেখেছ! দাঁড়াও নিজের পায়ে, সচেতন হও। ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠত্বকে অনুভব কর। মানুষের সাথে নিজেকে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ কর। নিজেকে পরিশুদ্ধ কর। অনাচার থেকে নিজেকে পৃথক কর। বেশী পাওয়ার আশায় অন্যকে দিও না। ধৈর্যশীল হও, তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে।
যারা নিজেকে আড়াল করে রেখেছ! ঈশ্বরের সামনে এসো, রাতের নিস্তব্ধতায়। তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ হও। তাঁর বাণী বোঝার চেষ্টা কর। দিনের বেলা তোমার যে অনেক কাজ!
ঈশ্বর মানুষকে মনোনীত করেছেন; তাকে দিয়েছেন তাঁর প্রতিনিধিত্বের দায়ভার। এই উচ্চ মর্যাদায় মানুষ যেন নিজেকে উন্নীত করতে পারে ও সেখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে সেজন্য তাঁর বাণীর বাহক ও বাণীর রূপকার হিসেবে বেছে নিয়েছেন মুহাম্মদকে এবং মানুষকে দিয়েছেন কোরান।
মানুষ তার চিন্তা ও কর্মের কর্তা হিসেবে, নৈতিক আচরণের সংঘটক হিসেবে নিছক একটি যন্ত্র নয়, বা একটি প্রাণী নয়; সে জগতে ঈশ্বরের ইচ্ছার রূপায়নে সম্ভাবনাময় এক অতিজাগতিক সত্ত্বা, যাকে দেয়া হয়েছে আত্মসচেতনতা, দরকারি সব জ্ঞানের বৃত্তি ও কাজের শক্তি।
নিজেকে বস্তুর একটি পিণ্ড বলে ভেবো না, আর কাদা-পাঁকের এটমিক মডেলে জীবনের মহিমা খুঁজে বেড়িয়ে নিরুদ্দেশ হয়ো না। নিজেকে মাংসের একটি পিণ্ড ভেবো না, আর জীব কোষের জেনেটিক কোডে জীবনের মহিমা অন্বেষণে বৃথাই চেষ্টা করে বেড়িও না।
জীবনের প্রকৃত মহিমার সন্ধানী হও, ঈশ্বরের নিকট নিজেকে সমর্পণ কর, তাঁর সেবক হয়ে জগতে তাঁর প্রতিনিধিত্ব কর। মমতাময় করুণাময় ঈশ্বরের রঙে নিজেকে রঙিন করে তোল, সকলের প্রতি ভালবাসায় আর মমতায় নিজেকে বিস্তৃত কর।