Published : 19 Aug 2016, 05:37 AM
স্বৈরশাসন যে নিকৃষ্টতম একটি পন্থা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজতন্ত্রে যেমন তেমনি গণতন্ত্রেও স্বৈরাচাররা বিভীষিকাময় জীব হিসেবে আবির্ভূত হয়। অনির্বাচিতরাই যে শুধু স্বৈরাচার হয় তা নয়, বরং নির্বাচিতরাও অনেকসময় ভয়ংকর স্বৈরাশাসক হিসেবে দেখা দেয়। হয়তো এজন্যই বলা হয়েছে – গণতন্ত্রের গুণ যেমন বেশি দোষও তেমনি বেশি।
গণতন্ত্রে অযোগ্য ব্যক্তির নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। সুশাসক হওয়ার সামর্থ্য নেই এমন কেউ যদি নির্বাচিত হয়ে আসে তবে এর পরিণতি অনির্বাচিত স্বৈরাচারের অপশাসনের চেয়ে ভিন্ন কিছু হয় না। নির্বাচিত ও অনির্বাচিত স্বৈরাচারের মধ্যে চরিত্রগত কোনো পার্থক্য নেই, একমাত্র পার্থক্য হলো একজন বন্দুক দেখিয়ে ক্ষমতা দখল করে আর অন্যজন অপপ্রচারের আশ্রয় নিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে।
তুরস্কের নির্বাচিত স্বৈরাচার এরদোয়ানের কর্মকাণ্ড এখন হাস্যকর পর্যায়ে নেমে এসেছে। মাত্র কদিন আগেও যে এরদোয়ান আমেরিকার তল্পিবাহক ছিলেন, পশ্চিমাদের চামচামি করতে গিয়ে অকারণে রাশিয়ার সাথে বিরোধে জড়িয়েছেন, গুলি করে রাশিয়ান বিমান ভূপাতিত করেছেন সেই তিনি এখন জরুরী ভিতিতে রাশিয়া সফরে গিয়েছেন, বলেছেন – রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান পুতিন একজন 'শ্রদ্ধেয় ও ভালোবাসাময়' নেতা।
যেনতেনভাবে ক্ষমতা ধরে রাখাই স্বৈরাচারদের কাছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার বলে তার এমন ইউ-টার্ন নেয়া। এরদোয়ানের ক্ষমতার ভারকেন্দ্রে চাপ বাড়ছে, জনগণের একটি অংশ তার বিরোধিতায় নেমেছে। এদিকে পশ্চিমের পুঁজিবাদীরাও তার দিকে পিঠটান দিয়েছে। তাই বাধ্য হয়েই তিনি এখন পুতিনের সামনে গিয়ে নত হয়ে বসেছেন, রাশিয়ার সাহায্য পেতে উন্মুখ হয়ে উঠেছেন।
মজার ব্যাপার, এরদোয়ান শুধু প্রবল প্রতাপশালী রাশিয়ার কাছেই নত হন নি, বাংলাদেশের কাছেও হয়েছেন। সাম্প্রদায়িক অপরাজনীতির ঝানু ক্রীড়ানক এরদোয়ান বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিচারের বিরোধিতা করে আসছেন শুরু থেকে। বাংলাদেশ যখন যুদ্ধাপরাধীদের নেতা নিজামিকে ফাঁসি দেয় তখন এরদোয়ানের দিলে খুব আঘাত লাগে, তিনি বাংলাদেশ থেকে তার রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে নেন।
ফলে বাংলাদেশও তুরস্ক থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে আনে। কিন্তু রাশিয়া সফরে যাওয়ার দিনকয়েকের মধ্যেই এরদোয়ান বাংলাদেশে তার রাষ্ট্রদূতকে আবার ফেরত পাঠিয়েছেন। আর সেই রাষ্ট্রদূত এখানে এসে প্রথম সাক্ষাতকারেই বলেছেন, বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর কোনো ইচ্ছে তুরস্কের নেই।
রাশিয়া বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। বাংলাদেশের সাথে অকারণ শত্রুতা যে রাশিয়া পছন্দ করবে না তা বেশ উপলব্ধি করেছেন ক্ষমতালিপ্সু এরদোয়ান। এজন্যই বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার এ প্রচেষ্টা।
বাংলাদেশের ধর্মব্যবসায়ীরা এবং তাদের অনুসারীরা স্বভাবতই এরদোয়ানের সমর্থক। এরা নাকি ধর্মগত কারণেই এরদোয়ানের পক্ষে! এরদোয়ানের ব্যক্তিগত জীবনাচরণে ধর্মের কিছু আছে? তাছাড়া এরদোয়ান ইসলামের চরম শত্রু আমেরিকা ও ইস্রাইলের পদলেহন করে গেছেন দিনের পর দিন। মিশরের নির্বাচিত সরকার উৎখাতেও তিনি পশ্চিমাদের অনুগামী হয়ে কাজ করেছেন।
সম্প্রতি এরদোয়ানের বিরুদ্ধে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। আর এরদোয়ান অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার দুদিনের মধ্যেই অন্যান্যদের সাথে ১৫ হাজারেরও বেশি শিক্ষককেও চাকুরীচ্যুত করেছেন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া ভুল কিছু নয় কিন্তু মাত্র দুদিনেই এরদোয়ান কীভাবে এতজন শিক্ষকের অপরাধ সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন? ১৫ হাজার জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করার কাজ ১ দিনে শেষ, ২ দিনে শাস্তি! স্বৈরাচার বলে কথা।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নাম পরিবর্তন নিয়ে কথা হচ্ছে। নাম পরিবর্তন নিয়ে এমন শোরগোল সৃষ্টির পিছনের কারণটি জানা যাক।
দিনকয়েক আগে ভারতের রাষ্ট্রপতি দেশের সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে এক সভা করেন। সেখানে রাজ্যের নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী মুখ্যমন্ত্রীরা পর্যায়ক্রমে বক্তব্য রাখেন। সেই পর্যায়ক্রম অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে সবার শেষে বক্তব্য রাখতে হয়। কারণ পশ্চিমবঙ্গের ইংরেজি নামের শুরু W দিয়ে, অন্য কোনো রাজ্যের নাম W এর পরের কোনো অক্ষর দিয়ে শুরু নয়।
মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি সবার শেষে সুযোগ পাবেন? এ অপমান মেনে নেয়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব হয় নি। রাজ্যের নাম W দিয়ে শুরু হওয়ায় উন্নয়নকাজ কীভাবে 'বাধাগ্রস্ত' হচ্ছে রাজ্যে ফিরে এসেই তিনি তা তার সভাসদদের বোঝান। তাই তিনি যখন রাজ্যের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব দেন মন্ত্রীসভা তা নির্দ্বিধায় পাশ করে দেয়। নতুন নাম Bangla রাখার কথাও বলা হয় যাতে মুখ্যমন্ত্রী সবার আগে বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ পান।
তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর এ খায়েশ সহজে পূরণ হবার নয়। নাম পরিবর্তনের জন্য লোকসভার অনুমোদনও যে লাগবে।
উইকিলিক্স এর প্রকাশ করা নথি থেকে জানা যায়, আমাদের দেশের প্রথম সামরিক স্বৈরাচার জিয়া তার নিজের রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য সামরিক ছাউনিতে বসে যে সভা করেন তাতে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূতও উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রদূত পরে তার দাপ্তরিক তারবার্তায় লিখেন যে, ঐ সভায় জিয়া সরকারী গাড়িতে করে সরকারী কর্মচারীকে পাঠিয়ে সরকারী টাকায় শেরাটন থেকে খাদ্যদ্রব্য আনিয়ে সবাইকে আপ্যায়ন করান।
সরকারী সম্পদকে যে জিয়া ইচ্ছেমত নিজের কাজে ব্যবহার করেছেন তা বলা বাহুল্য। খাল কাটলেই দেশ উন্নত হয়ে যাবে- এমন 'যুগান্তকারী' তত্ত্বের আবিষ্কারক এ স্বৈরাচার। তাই সুযোগমতো তিনি জিন্স, টিশার্ট, সানগ্লাস আর ক্যাপ পরে কোনো এক খালে নেমে পড়ে কোদাল দিয়ে দুতিন কোপ মেরে মুখে গাইতেন- 'প্রথম বাংলাদেশ আমার, শেষ বাংলাদেশ'। মনে মনে তিনি নিশ্চয়ই গাইতেন- 'প্রথম প্রভু আমার পাকিস্তান, শেষ প্রভু আমার মার্কিনীস্থান'।
দেশের আরেক স্বৈরাচার এরশাদের স্বৈরশাসন ক্রমাগত মজাদার কাহিনীর জন্ম দিয়ে গিয়েছে। এরশাদ প্রায়ই বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে হাজির হতেন, মুসল্লিদের বলতেন- তিনি আগের রাতে স্বপ্নে দেখেছেন যে, পরদিন তিনি এখানে জুম্মার নামাজ আদায় করছেন। মানুষ তখন অবাক হতো এই ভেবে যে, তিনি যদি আগের রাতেই স্বপ্ন দেখে এসে থাকেন তাহলে আর্মি কেনো এক সপ্তাহ আগে থেকে মসজিদটিকে ঘিরে রেখেছিলো?
জিয়ার মতো এরশাদও দীর্ঘদিন একইসাথে রাষ্ট্রপতি পদ ও সেনাবাহিনী প্রধানের পদ দখল করে রাখেন অর্থাৎ তারা ছিলেন নিজেই নিজের কর্মচারী। ছিলেন Chief Marshal Law Administrator বা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকও। তখন Chief Marshal Law Administrator এর সংক্ষেপ CMLA এর যে ব্যাখ্যা মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠে তা হলো Cancel my last announcement, এমনই ছিলো স্বৈরাচারদের পল্টিবাজির ধরণ।
স্বৈরশাসকরা দরকার হলে নিজেদের প্রকৃত জন্মতারিখকেও অস্বীকার করতে পারে, নিজেরাই নিজেদের জন্মপরিচয়কে বিতর্কিত করে তুলতে পারে। ১৯৯১ এ প্রধানমন্ত্রী হয়ে খালেদা সরকারী নথিতে ঘোষনা করেন যে, তার জন্মতারিখ ১৯ই আগস্ট। আর এখন ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে তিনি জন্মদিন পালন করেন ১৫ই আগস্টে, যিনি তাকে রক্ষা করেছিলেন সেই মহামানবের মৃত্যুকে পরিহাস করে।
তাই বলতে হয়, এমন অবাঞ্ছিতরা নিপাত যাক।