Published : 24 Jul 2012, 04:30 PM
'রিলেসনশিপস থ্রু ভলান্টারিজম' এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় 'রিলেশনস ইন মোশন' নামের সংগঠনটি। এর উদ্যোক্তা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থীরা হলেও এই সংগঠনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়। বর্তমানে সংগঠনটিতে ঢাকা, জাহাঙ্গীনগর, জগন্নাথ, নর্থ সাউথ, স্টামফোর্ডসহ আরও কয়েকটি বিশ্বাবদ্যালয়ের মোট ৫০ জন শিক্ষার্থী সদস্য হিসেবে কাজ করছে। এই সংগঠনটির উদ্দেশ্য হল বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কাজে শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা তৈরি, যুব সমাজকে বিভিন্নভাবে কাউন্সেলিং দেওয়া, পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা তৈরি করা, প্রান্তিক ও ছিন্নমুল মানুষদের অধিকার ও সমস্যাগুলো তুলে ধরা এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার পাহাড়ি আদিবাসীদের সাথে বাঙ্গালীদের সুসম্পর্ক তৈরি করা ইত্যাদি। এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী মো. জান্নাতুল হাবীব এবং সেক্রেটারী একই বিভাগের শিক্ষার্থী ইমরান হাসনাত পলাশ। এই সংগঠনটির সার্বিক কার্যক্রমে সহায়তা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকাস্থ কূটনৈতিক মিশন। কয়েকদিন পূর্বে এই সংগঠনটি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় ফিল্ড ট্রিপ সম্পন্ন করেছে এবং তাদের সমস্যাগুলো অনুধাবন করা চেষ্টা করেছে। এই ফিল্ড ট্রিপের রিপোর্ট আগামী মাসে প্রকাশ করা হবে একটি সেমিনারের মাধ্যমে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ফিল্ড ট্রিপের বর্ণনাঃ
সমাজ সেবা এ সংগঠনের অন্যতম লক্ষ্য। যেসব যুবক শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে জাতির সেবা করতে চায় এবং জাতিকে ভবিষ্যতে আলোর পথ দেখাতে চায় তাদের প্লাটফর্ম হল রিলেশনস ইন মোশন। এই সংগঠনটি তাদের বিভিন্ন কার্যক্রম বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে তুলে ধরতে চায়। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সমস্যা অনুধাবন করা এবং বাঙ্গালীদের সাথে পাহাড়িদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে সংগঠনটি সর্বপ্রথম প্রজেক্ট হাতে নেয়। প্রজেক্ট এর অংশ হিসেবে গত কয়েক মাস যাবত সংগঠনটি এর সদস্যদেরকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ওয়ার্কশপ আয়োজন করে। এরপর প্রজেক্টের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে সংগঠনটি গত ১৪ জুলাই রাতে ৩৬ জন সদস্যকে নিয়ে ফিল্ড ট্রিপ করার উদ্দেশ্যে রাঙ্গামাটি অভিমুখে রওনা হয়। সেদিন সমস্ত রাত লেগে যায় রাঙ্গামাটি পৌছাতে। অতঃপর সকাল ১০টায় শুরু হয় আমাদের কর্মযজ্ঞ। প্রথমে আমরা রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজে যাই সে কলেজের শিক্ষক ও ছাত্রদের সাথে মত বিনিময় করার উদ্দেশ্যে। বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে মত বিনিময় করা হয়। তাদের সমস্যাগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়। সমস্ত আলোচনায় ভূমি কেন্দ্রিক সমস্যাটিকে প্রধান সমস্যা হিসেবে প্রতিপন্ন করা হয়। মতবিনিময়ের পাশাপাশি আমাদের প্রস্তাবনাগুলো তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়।
এরপর দেড়টায় আমরা ফিরে আসি রাঙ্গামাটির প্রিন্স নামক এক আবাসিক হোটেলে। এখানে এসে মধ্যহ্ন ভোজনসহ বিশ্রাম নিয়ে সেই দিনই বিকাল ৩.৫০ মিনিটে আমরা বান্দরবানের উদ্দেশ্যে রওনা হই। আকা বাকা উচু নীচু সাপের লেজের মত পাহাড়ী রাস্তা ভেদ করে আমরা রাত্রী ৮টায় পৌছে যায় বান্দরবানের হোটেল থ্রি স্টারে। সমস্ত রাত সেখানে অবস্থানের পর পরদিন সকালে আমরা আবার ক্যাম্পেইন শুরু করি। এখানে আমরা বান্দরবান সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে মত বিনিময় করি। এরপর আমরা কয়েকটি স্কুলে ক্যাম্পেইন করি। এছাড়াও আমরা বেশ কয়েকটি শিশু সদনে গিয়ে তাদের সমস্যা, ভবিষ্যৎ জীবনের লক্ষ্য, পড়ালেখার বিষয়ে বিভিন্ন খোঁজ খবর নেই। এরপর হোটেলে গিয়ে বিশ্রামের পর বিকালে বান্দরবান প্রেসক্লাবে আমরা সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করি এবং স্থানীয় প্রতিনিধিদের সাথে উন্মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করি। আলোচনায় অংশ নেন বান্দরবান প্রেস ক্লাবের সেক্রেটারী আমিনুল ইসলাম বাচ্চু, কালের কণ্ঠের স্টাফ রিপোর্টার মনিরুল ইসলাম এবং এই অঞ্চলের বিখ্যাত আইনজীবি অধ্যাপক মোহাম্মদ ওসমান গণিসহ আদিবাসী জনগণের কিছু স্থানীয় প্রতিনিধি। মুক্ত আলোচনায় রিলেশনস ইন মোশনের আরাফাত নোমান, মাহফুজুর রহমান, মোর্শেদুল ইসলাম, শামীম, শাওন, লিঠু ও সোহানসহ আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী আলোচকদের নিকট প্রশ্ন করেন এবং তাদের বিভিন্ন মতামত তুলে ধরেন। মুক্ত আলোচনা শেষে শপিং এর সকলকে কিছুটা সময় দেওয়া হয়। শপিং শেষে সকলে আবার ফেরেন হোটেল থ্রি স্টারে। এভাবে আমরা আমাদের দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচী শেষ করি।
তৃতীয় দিনে ফরমাল কোন কর্মসূচী ছিলনা। মূলত এ দিন বরাদ্দ রাখা হয়েছিল বান্দরবানের পাহাড়ি সৌন্দর্য্য অবলোকন করতে। এদিন সকালে আমরা শৈলকূপা প্রপাতের উদ্দেশ্যে রওনা হই। শৈলকূপা প্রপাতে যাওয়ার পথে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে ছোট্ট রাস্তাগুলো দেখে আমরা শিউরে উঠি। আরো বেশি ভয় পাই যখন ওই সরু রাস্তাগুলো দিয়ে আমাদের গাড়ী প্রবেশ করে। মনে হয় এ অন্য এক জগৎ। সরু রাস্তার পাশে খাড়া পাহাড় আর সবুজ ছায়া ঘেরা পাহাড়ি চূড়া দেখে আমরা বিমোহিত হই। আরাফাত, জামাল, বাপ্পী উঠাতে থাকে একের পর এক ছবি। এখান থেকে চলে গেলেও, যাতে এই স্মৃতি মুছে না যায় সেজন্যই নাকি ছবি তোলার প্রতিযোগিতা বললেন আরাফাত। শৈলকূপা প্রপাতে নেমেই পাহাড়ের সাথে জলের খেলা আর পাথরের উপর অবিরাম জলস্রোত দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। শাপলা বলে ওঠে এইখানে না আসলে জীবনের একটা অংশ অপূর্ণাঙ্গ থেকে যেত। মেফতাউল, হাবীব, শামীম, সোহান, মাহফুজ, মোর্শেদ, আয়াজুদ্দিন, শুভ, আতিক,সাদ্দাম এরা সবাই পাহাড়ের পাশ দিয়ে জলপ্রপাতের সাথে বহুদূর পর্যন্ত যায়। মাহফুজ ও মোর্শেদ এতেই ক্ষান্ত না থেকে পাহাড়ের উপর উঠতে থাকে। কিন্তু ঝির ঝির বৃষ্টি থাকায় এবং পাহাড়ের গা পিচ্ছিল থাকায় তারা পাহাড়ের উপর উঠতে ব্যর্থ হয়। এভাবে দুই ঘন্টা পাহাড় আর সবুজ শ্যামল দৃশ্যের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে, অবশেষে এখানকার মায়া ত্যাগ করে আবার হোটেলে ফিরে আসি। দুপুরের খাবার শেষ করে সকলেই আবার দ্রুত বের হই স্বর্ণ মন্দির, মেঘলা ও নীলাচলের সৌন্দর্য অবলোকনের জন্য। স্বর্ণ মন্দিরের কারুকার্য দেখে চোখ ধাধিয়ে যায়। শারমিন বলে কিভাবে সম্ভব মানুষের দ্বারা এত সুন্দর মন্দির তৈরি করা। কেউ কেউ বোদ্ধার অনুকরণে ছবি উঠার জন্য পোজ দিতে চাইলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি না থাকায় ব্যর্থ হয়। এখান থেকে যাওয়া হয় মেঘলায়। মেঘলাতে ক্যাবল কারে চড়ার অনুভূতি নাকি কখনও ভুলবে না মাহফুজ। কিন্তু খলিল ব্যথিত হয় এখানকার চিড়িয়াখানার বেহাল অবস্থা দেখে। মেঘলা থেকে আমরা আবার ছুটতে থাকি নীলাচলের উদ্দেশ্যে। নীলাচলে গিয়ে আমার কাছে মেঘ কি জিনিস তা স্পষ্ট হয়। আমরা যেন সবাই মেঘের সাথে মিশে যাই। আরাফাত বলে উঠে আমি এই স্থানে থাকতে চাই অন্তত আজকের রাতটি। কিন্তু তা কেমন করে হয়, আজই যে আমাদের ফিরতে হবে ঢাকাতে। নীলাচল থেকে আমরা হোটেলে গিয়ে লাগেজ গুছিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই। এভাবে রোমাঞ্চকর ও বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের ফিল্ড ট্রিপ শেষ হয়।