দুই ছিনতাইকারী ধরেও ফোন ফিরল না তরুণীর হাতে

“ছিনতাই হওয়ার পর কত চিৎকার করে ডাকছি, একটা লোক এগিয়ে আসেনি। এখন সবাই ভিডিও করতেছে,” বলছিলেন মেয়েটি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 July 2022, 02:06 PM
Updated : 22 July 2022, 02:06 PM

নিজের মোবাইল খুইয়ে দুই ছিনতাইকারীকে ধরে প্রশংসায় ভাসছেন এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী, তবে একদিনেও তার ফোনটি উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকার বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর বেশিরভাগ মন্তব্যকারী ওই ছাত্রীর সাহসিকতায় বাহবা দিয়েছেন।

শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত তার মোবাইল উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি জানিয়ে তেজগাঁও থানার ওসি অপূর্ব হাসান বিকেলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “থানায় দুজনকে (ছিনতাইকারী) ধরে দিলেও তিনি (ভুক্তভোগী) মামলা করতে রাজি হননি। পরে পুলিশ বাদী হয়ে ওই দুজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।”

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থী বৃহস্পতিবার বিকালে বাসে করে রাজধানীর মিরপুর থেকে পুরান ঢাকায় নিজের ক্যাম্পাস এলাকায় ফিরছিলেন। ফোনে কথা বলার সময় হঠাৎ কারওয়ান বাজার এলাকায় বাসের জানালার বাইরে থেকে এক ছিনতাইকারী তার মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে দৌড় দেয়।

সঙ্গে সঙ্গে ওই ছিনতাইকারীর পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে তিনি ধরে ফেলেন আরেক ছিনতাইয়ের সঙ্গে যুক্ত এক যুবককে। পরে ধরা পড়া ছিনতাইকারীর সহযোগীকেও ধরে ফেলেন ওই ছাত্রী।

এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন মানবজমিন পত্রিকার ফটো সাংবাদিক জীবন আহমেদ। কারওয়ান বাজারে দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক মানবজমিনের কার্যালয় যে ভবনে, তার নিচের গলিতে ঘটে ছিনতাইকারীকে ধরার ঘটনা।

ফটো সাংবাদিক জীবন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ওই তরুণী একটা গবেষণার কাজে মিরপুর চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলেন। কাজ শেষ করে এক বন্ধুর সঙ্গে বাসে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরছিলেন।

“বাসে বসে উনি বোনের সঙ্গে কথা বলছিলেন, হঠাৎ জানালা থেকে কালো টি-শার্ট পরা একটা ছেলে তার ফোনটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তিনিও ছিনতাইকারীর পেছন পেছন ছুটতে ছুটতে কারওয়ান বাজারে মানবজমিনের গলিতে ঢুকে পড়েন। কিন্তু ছিনতাইকারীকে পাননি “

জীবন বলেন, “ফোন হারিয়ে মেয়েটি খুব কাঁদছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে কারওয়ান বাজারের আড়তের শ্রমিকদের কাছে কালো গেঞ্জি পরা ছিনতাইকারীর হদিস জানতে চান। অনেককে জিজ্ঞেস করেন ছিনতাইকারীর বিষয়ে।

“এক পর্যায়ে সেখানে পার্ক করে রাখা একটি মোটরসাইকেলের ওপর বসে মেয়েটি চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন। এ সময়ই প্রধান সড়কের (কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ) দিক থেকে লোকজন হই হই করে আরেক ছিনতাইকারীকে ধাওয়া করছিলেন। ওই ছিনতাইকারীও মানবজমিনের গলিতে ঢুকে পড়ে। হইচই শুনে ওই তরুণী পালাতে থাকা ছিনতাইকারীকে জাপটে ধরে ফেলেন।”

তখন আশপাশে থাকা লোকজন ছিনতাইকারীকে একচোট মারধর করে। মারধরের চোটে মাটিতে শুয়ে পড়া ছিনতাইকারীর বুকের ওপর বসে ফোন ফেরত চান ওই ছাত্রী। চড়-থাপ্পড় দিতে দিতে তরুণী বলতে থাকেন, তার ফোন ছিনতাইকারীও একই চক্রের সদস্য।

একপর্যায়ে ধরা পড়া ছিনতাইকারী স্বীকার করেন, তারা সবাই একই চক্রের লোক। তার পকেট তল্লাশি করে একটি ফিচার ফোন পান উপস্থিত লোকজন। সেই ফোন দিয়ে নিজের দলের সদস্যদের ডেকে আনতে চাপ তৈরি করা হয় ওই ছিনতাইকারীকে। এক পর্যায়ে ওই যুবক ফোন করতে সম্মত হয়।

ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, ছাত্রীর মারধরের পর ওই ছিনতাইকারী শুয়ে শুয়েই নিজের মোবাইল ফোনে শান্ত স্বরে কথা বলছেন। তার ঠোঁটের কোণা দিয়ে হালকা রক্তের ধারাও দেখা যাচ্ছে।

প্রত্যক্ষদর্শী জীবন জানান, ছিনতাইকারী ফোন করে জিজ্ঞেস করে ‘তুই কই?’ তখন ওপাশ থেকে জানতে চাওয়া হয়, ‘কী মামা, কট খাইছস নাকি?’ কথোপকথনের একপর্যায়ে ধরা পড়া ছিনতাইকারীর সহযোগী কারওয়ান বাজারে ‘এরশাদ বিল্ডিং’ বলে পরিচিত ভবনটির সামনে আসছে বলে জানায়।

জীবন বলেন, “ওই ছেলেটি কালো টি-শার্ট আর লুঙ্গি পরে আছে বলে আমরা জানতে পারি। পরে আমি ওই ছাত্রীসহ উপস্থিত জনতাকে বললাম, আমরা আগে একটু দূর থেকে দেখি সেখানে এরকম পোশাকের কেউ এসছে কি না। ছিনতাইকারীর কাছ থেকে পাওয়া ফোনটি ছিল সেই ছাত্রীর হাতেই।

“আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি- কালো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা একটা ছেলে দাঁড়িয়ে। মেয়েটি আগের নম্বরে ডায়াল করতেই ছেলেটার ফোন বেজে উঠলো। এরপরই আমরা গিয়ে তাকে ধরে ফেলি।”

থানা-পুলিশ পর্ব

পুলিশ এলে তাদের হাতে আটক দুজনকে তুলে দেওয়া হয় জানিয়ে জীবন বলেন, “পুলিশের সঙ্গে আমরাও তাদের নিয়ে থানায় যাই। পুলিশকে মেয়েটি বারবার বলছিলেন, ‘আমি দুজনকে ধরে দিতে পারলে, আপনারা আমার ফোনটা উদ্ধার করতে পারছেন না কেন?’

“থানায় যাওয়ার পর ডিউটি অফিসার বেশ হেল্পফুল ছিল। তবে একজন কর্মকর্তা এসে মেয়েটিকে জেরা শুরু করেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি কিভাবে বুঝবো যে, এই দুজন ছিনতাইকারী। কারো গায়ে তো ছিনতাইকারী লেখা থাকে না।’”

জীবনের ভাষ্য, পুলিশের জেরায় মেয়েটি ভড়কে যায়। থানা থেকে মামলা করতে বললে তখন আর সাহস করতে পারছিলেন না ওই তরুণী।

“পুলিশের লোকেরা বারবারই বলছিলেন, ‘আপনারা জানলার পাশে বসে কেন যে কথা বলেন!’”

তবে ওই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে বলে জানিয়েছেন তেজগাঁও থানার ওসি অপূর্ব হাসান।

ছিনতাইকারীদের ধরার পর নিরাপত্তা নিয়ে কোনো শঙ্কাবোধ করছেন কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে জীবন বলেন, “আমি এখন ভাবছি ওই ছিনতাইকারীদের কাছে ছুরিও থাকতে পারত। তারা ধরা পড়া এড়াতে ছুরিও মারতে পারত।

“বাস থেকে মোবাইল ছিনতাই এই এলাকার নিত্য ঘটনা। কিন্তু ঘটনার শিকার হওয়ার পর সবাই যেমন মন খারাপ করে বাড়ি চলে যান, এই মেয়েটি তা করেনি। তার সাহসের কারণেই আসলে সবাই এগিয়ে এসেছিল।”

ছিনতাইকারী ধরা পড়ার পর চারদিক থেকে সবাই যখন ঘিরে ধরে ভিডিও করছিলেন, তখনকার চিত্র বলতে গিয়ে জীবন বললেন, “মেয়েটি বলছিল, ‘ছিনতাই হওয়ার পর কত চিৎকার করে ডাকছি, একটা লোক এগিয়ে আসেনি। এখন সবাই ভিডিও করতেছে।’”