ঢাকা-১ আসনের ভোটারদের বাড়ি থেকে আনার চেষ্টা করতেও দেখা গেছে কোনো কোনো জায়গায়।
Published : 07 Jan 2024, 04:32 PM
নৌকা এবং লাঙ্গল প্রতীকের দুই প্রার্থীর পাল্টাপাল্টি অভিযোগ এবং তুলনামূলক কম ভোটার উপস্থিতি নিয়েই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১ আসনের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। তবে দিনজুড়ে নির্বাচনি পরিবেশ শান্তিপূর্ণই ছিল।
রোববার দুপুরের পর নারী ভোটারের উপস্থিতি বাড়বে বলে ধারণা করা হলেও ভোটগ্রহণ শুরুর পর থেকে শেষ পর্যন্ত এ আসনের কেন্দ্র কেন্দ্রে নারী ভোটারদের লাইন দীর্ঘ হতে দেখা যায়নি।
সকাল থেকে নির্বাচনি এলাকার দুই উপজেলা দোহার ও নবাবগঞ্জের কয়েকটি ভোটকেন্দ্র ঘুরে আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টির কর্মী সমর্থকদের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে। ভোটারদের বাড়ি থেকে আনার চেষ্টাও হয়েছে কোনো কোনো জায়গায়।
বিভিন্ন কেন্দ্রে লাঙ্গল প্রতীকের এজেন্টদের ঢুকতে না দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী সালমা ইসলাম।
তার অভিযোগ ‘ভুয়া’ মন্তব্য করে নৌকার প্রার্থী প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেছেন, “সবাই ভোট দিতে এসেছেন। আপনারাও দেখছেন এখানে ভোটাররা আসছেন। তারা ভোট দিচ্ছেন।”
নৌকা এবং লঙ্গলের প্রার্থী ছাড়াও তৃণমূল বিএনপির মফিদ খান, আব্দুল হাকিম আম, মো. করম আলী হাতুড়ি, শেখ মো. আলী মাছ, শামসুজ্জামান চৌধুরী একতারা প্রতীক নিয়ে এ আসনে নির্বাচন করেন।
ভোটারদের বাড়ি থেকে আনার চেষ্টা
বেলা ১২টায় কামারখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী সালমা ইসলাম।
ওই কেন্দ্রে মোট ভোটার ১৯২৮টি, বেলা ১২টা পর্যন্ত এই কেন্দ্রে ৪৯৮টি ভোট পড়েছে বলে জানিয়েছেন প্রিজাইডিং অফিসার মো. আনোয়ার হোসেন।
দুর্গাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, এই কেন্দ্রের ৭ নম্বর বুথে ৪৬৪ জন ভোটার। এর মধ্যে বেলা বেলা ১টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ১০৩টি। ৮ নম্বর বুথে ৪১২ জন ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৮০ জন।
ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো. আল আমিন খন্দকার জানান, এই কেন্দ্রের ৩ হাজার ৫৮৮ জন ভোটারের মধ্যে বেলা একটা পর্যন্ত ৭৫০ জন তাদের ভোট দিয়েছেন। সে হিসাবে ওই কেন্দ্রে ২০ দশমিক ৯০ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।
আগলা ইউনিয়নের মহাকবি কায়কোবাদ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে দুটি কেন্দ্র। এরমধ্যে উত্তর কেন্দ্রে ২৮০৪টি ভোটের মধ্যে বেলা ১২ টা পর্যন্ত ৫১৭টি ভোট পড়েছে জানিয়েছেন প্রিজাইডিং অফিসার নাজমুন নাহার।
এই কর্মকর্তা বলেন, “ভোটার উপস্থিতি সকালে মোটামুটি একটু ভালো ছিল, এখন একটু কমেছে। দুপুরের আবার আসবে হয়ত।
এই কেন্দ্রে ভোটারের কম উপস্থিতি নিয়ে আলাপ করছিলেন লাঙ্গল প্রতীকের দুজন এজেন্ট।
তাদের একজন বলেন, বিএনপি ভোটে আসে না, লাঙ্গলের লোকজনও তেমন মাঠে নামতে পারছে না। আর আওয়ামী লীগের লোকজন মনে করছে এমনিতেই পাস, ভোটে কেন্দ্রে যাওয়ার দরকার কি!
দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভোটারদের বাড়ি থেকে আনার চেষ্টা করছেন। অনেকে রিকশা পাঠাচ্ছেন, কেউ ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে যাচ্ছেন ভোটারদের আনতে।
ভোটারদের উপস্থিতি কম কেন– এমন প্রশ্নে শাহাদাত হোসেন নামে নৌকার প্রার্থীর একজন কর্মী বলেন, “সকালের দিকে ভোটার ছিল, দুপুরের পর মহিলারা বেশি আসেন। তারা রান্নাবান্না শেষ করে আসবেন। আশা করছি ভোটার আরও আসবে।”
আগলা ইউনিয়নের চৌকিঘাটা জনমঙ্গল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনেও নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ভালো। তবে ভোটার কম।
স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, নানা কারণে মানুষ ভোট দিতে আগ্রহ হারিয়েছে।
ঢাকা-১: সালমার অভিযোগ, সালমান বললেন ‘ভুয়া’
“ভোট দিলেও যা, না দিলেও তা। এই চিন্তা কইরা মানুষ কেন্দ্র আসছে না। আমাদের কেন্দ্রে সাড়ে তিন হাজার ভোট, কিন্তু দেড় হাজার ভোটার আনা যাইব না। আমাদের মহল্লায় মহিলা ভোটার ৫০০ মত। কাউকে আনা যাচ্ছে না।”
ছোট বক্সনগর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের মহিলাদের ১ নম্বর বুথে ৪৩১ জন ভোটারের মধ্যে বেলা ২টা পর্যন্ত ৯৮ জন ভোটার ভোট দিয়েছেন। ভোট পড়ার হার ২২ দশমিক ৭২ শতাংশ। পুরুষদের ৫ নম্বর বুথে ৫৭৩ ভোট, বেলা সোয়া দুইটা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ১৬২টি। অর্থাৎ ২৮ দশমিক ২৭ শতাংশ।
লাঠিতে ভর দিয়ে ভোটকেন্দ্রে
কম ভোটার উপস্থিতির মধ্যেও নজর কেড়েছেন বক্সনগর এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা সিরাজউদ্দিন আহমেদ। ঠিকমত হাঁটতে পারেন না তিনি। তবে দুপুরে লাঠিতে ভর করে, মেয়ে রিক্তা আহমেদের সঙ্গে ভোট দিতে এসেছেন।
রিক্তা আহমেদ বলেন, তার বাবা কখনোই ভোট দেওয়া বাদ দেন না।
“উনি অসুস্থ, কিন্তু বলছে আমার সঙ্গে ভোট দিতে আসবেন। দুপুরের খাবারও খায়নি। বলছে ভোট দিয়ে বাসায় গিয়ে খাবেন। আবার ভোট পাঁচ বছর পর, ততদিন বাঁচনে কি মারা যান তো জানেন না, এজন্যই এসেছেন। আব্বা মনে করেন এটা তার নাগরিক অধিকার।”
আওয়ামী লীগের প্রার্থী সালমান এফ রহমানের নিজের বাড়ির কেন্দ্র সাইনপুকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সকালে এই কেন্দ্রে ভোটারদের মোটামুটি উপস্থিতি দেখা গেছে।
এই কেন্দ্রের ৩৩২০ জন ভোটারের মধ্যে সকাল ৯টা ১০ মিনিট পর্যন্ত ১৯৫টি ভোট পড়েছে। অর্থাৎ এক ঘণ্টা ১০ মিনিটে ভোট পড়েছে ৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
দোহারের পূর্বচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট ভোটার ১৮৬৫ জন। বেলা ১১টা পর্যন্ত এই কেন্দ্রে মোট ৩৯৪টি ভোট পড়েছে। ওই সময় ভোট পড়ার হার ২১ দশমিক ১৭ শতাংশ।
অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ
ঢাকা-১ আসনের বিভিন্ন কেন্দ্রে লাঙ্গল প্রতীকের এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়ার অভিযোগ করেছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী সালমা ইসলাম। আর ওই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সালমান এফ রহমান বলেছেন, নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতেই এসব অভিযোগ করেছেন সালমা ইসলাম।
দোহারের সাইনপুকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেন ঢাকা ১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সালমান এফ রহমান।
বেলা পৌনে ১০টায় গ্রামের বাড়ির এই কেন্দ্রে ভোট দিতে আসেন তিনি।
ভোটদান শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ ভালো। সবাই ভোট দিতে এসেছেন।
"আপনারাও দেখছেন এখানে ভোটাররা আসছেন। তারা ভোট দিচ্ছেন।"
বিভিন্ন কেন্দ্রে লাঙ্গলের প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগ এসেছে– সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “লাঙ্গলের প্রার্থী গত নির্বাচনেও এই কাজ করেছেন। আমার তো মনে হচ্ছে এবারও তিনি তাই করবেন। আপনারা দেখবেন, ১২টা-১টার দিকে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেবেন। উনি জানেন, নির্বাচনে জিততে পারবেন না। তিনি ভুয়া অভিযোগ করেন।"
ভোটদান শেষে নির্বাচনি এলাকার বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে দেখেন সালমান এফ রহমান।
রোববার ১২টার দিকে নবাবগঞ্জের কামারখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী সকালে সালমা ইসলাম।
ভোটদান শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বিভিন্ন স্থানে তার নির্বাচনি এজেন্টদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। এজেন্টদের মারধর করা হয়েছে। অনেকের বাড়িঘর ভেঙে ফেলেছে। এজন্য ভয়ে তারা কেন্দ্রে আসতে পারেনি।"
সালমান এফ রহমানের মন্তব্যের জবাবে সালমা ইসলাম বলেন, “উনি (সালমান এফ রহমান) কীভাবে জানলেন আমি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াব। উনাকে কে শিখিয়ে দিয়েছে? উনি কীভাবে ভাবলেন আমার জানতে ইচ্ছা হয়। তার মানে তিনি সবকিছু সেটআপ করে ফেলেছেন। আমার লোকজনকে আরও মারবে, তার জন্য আমি চলে যাব।”
এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দিয়েছেন কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি অভিযোগ করেছি। আমি সব সময়ই তাদের সঙ্গে কথাটথা বলি। তিনি যে বলেছেন এটা দেশের মানুষ দেখেছে। এই আইনের লঙ্ঘন। উনার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
নবাবগঞ্জ উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন এবং দোহার উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এই আসনের ভোটার সংখ্যা ৫ লাখ ১৩ হাজার ৬০৯ জন।
এর মধ্যে নারী ভোটার ২ লাখ ৫৪ হাজার ১৬৩ জন; পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৫৯ হাজার ৪৪৩ জন এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার তিনজন। এছাড়া ১৮৪টি ভোট কেন্দ্রে কক্ষ ছিল ১১৭২টি।