Published : 17 Aug 2023, 11:30 PM
দেশে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে থাকার দাবি করলেও নতুন নতুন জঙ্গি সংগঠনের কর্মকাণ্ড উদ্বেগে ফেলছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের।
বিগত বছরগুলোতে দেশে জঙ্গিবাদের যে দুটি ধারা চলছিল, তার একটি ‘নব্য জেএমবি’ এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। তবে আনসার আল ইসলামের তৎপরতা থামানো যায়নি।
‘ওসমান গণি’ নামের এক ব্যক্তির নেতৃত্বে সদস্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে সাংগঠনিক কার্ক্রম চালিয়ে যাচ্ছে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনটি।
সম্প্রতি পাহাড়ে জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সঙ্গে আনসার আল ইসলামের যোগাযোগের ঘটনাতেও চিন্তার রেখা পড়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের কপালে।
২০০৫ সালের ১৭ অগাস্ট দেশের ৬২টি জেলায় জঙ্গিদের একযোগে বোমা হামলা প্রত্যক্ষ করেছিল বাংলাদেশ। ওই ঘটনায় যুক্ত নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) অনেক সদস্য এখনো জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত।
পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, ওই ঘটনায় মোট ১৫৯টি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে ১১৬টি মামলার বিচার শেষ হলেও এখনো ৪৩টি মামলা বিচারধীন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য বলছে, জেএমবির এই অংশটির নেতৃত্বে আছেন সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি। সালেহীনের নেতৃত্বে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টের বোমা হামলা চালানো হয় বলেই তথ্য আছে।
২০১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে জেএমবির আরও দুই শীর্ষ নেতাসহ পালান সালেহীন। এখনও ধরা যায়নি তাকে। তিনি ভারতে অবস্থান করছেন বলে ধারণা করছেন কর্মকর্তারা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলছেন, “সালেহীন ভারতে গ্রেপ্তার হয়েছে এমন কোনো তথ্যও পাওয়া যায়নি।”
কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, এখন পুরনো জেএমবির নেতৃত্ব সালেহীনের হাতে। তাদের সঙ্গে আনসার আল ইসলামের যোগাযোগের খবরও তারা পাচ্ছেন।
জেএমবির কিছু শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তারের পর সংগঠনটির তৎপরতা কমে আসে। এর মধ্যেই ১০ বছর আগে ২০১৩ সালে লেখক ও ব্লগার হত্যার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে আনসার আল ইসলাম। নিজেদের আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদার অনুসারী হিসেবে দাবি করে আসছে সংগঠনটি।
এই জঙ্গি সংগঠনের উত্থানের মধ্যেই দেশে আবার জঙ্গিবাদের আরেক ধারা শুরু করে ‘নব্য জেএমবি’। নিজেদের ইরাক-সিরিয়া ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অনুসারী হিসেবে দাবি করে একের পর এক রক্তপাত ঘটায় তারা। দেশ প্রত্যক্ষ করে হোলি আর্টিজান হামলা।
তবে সিটিটিসির প্রধান আসাদুজ্জামান বলছেন, নব্য জেএমবির (বা র্যাবের ভাষায় জেএমবির ‘তামিম-সারোয়ার’ গ্রুপ) কোনো তৎপরতা এখন নেই বললেই চলে বলে। তাদের অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন, বাকিদের কোনো হদিস নেই।
কর্মকর্তারা বলছেন, সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের পতনের পর নব্য জেএমবিও ঝিমিয়ে পড়ে। হোলি আর্টিজান হামলা পরবর্তী নিরাপত্তা বাহিনীর ১৫টি অভিযানে নব্য জেএমবির ৬৪ জন জঙ্গি নিহত হন। যার মধ্যে তামিম চৌধুরী, মেজর জাহিদ, সারোয়ার জাহান ওরফে মানিকসহ প্রথম সারির নেতারা রয়েছেন।
তৎপর আনসার আল ইসলাম
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ভারতের জম্মু ও কাশ্মির, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে সক্রিয় হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী দল আল কায়েদা তাদের আঞ্চলিক মিত্রদলগুলোকে আবারও ‘সংগঠিত’ করছে। এ বিষয়ে বলে সতর্কবার্তাও এসেছে।
ইন্ডিয়া টুডে জানিয়েছে, জুলাইয়ের শেষ সপ্তায় প্রকাশিত দ্য অ্যানালিটিকাল সাপোর্ট অ্যান্ড স্যাংশন্স মনিটরিং টিম অব দ্য ১২৬৭ আইএসআইএল (দায়েশ) এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আল-কায়েদা স্যাংশন্স কমিটির ৩২তম প্রতিবেদনে ওই সতর্কবার্তা এসেছে।
জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আল কায়েদা এখন একিউআইএসকে (আল-কায়েদা ইন দ্য ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট) সংগঠিত করছে, তাদের লক্ষ্য বাংলাদেশ, জম্মু ও কাশ্মির এবং মিয়ানমারে কার্যক্রম বিস্তৃত করা।
বাংলাদেশেও আল কায়েদার অনুসারী আনসার আল ইসলামের তৎপরতা বাড়ার খবর জানাচ্ছেন আইন-শঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।
সিটিটিসর প্রধান আসাদুজ্জামান বলছেন, “আনসার আল ইসলাম তৎপর রয়েছে। ওসমান গণি নামের এক ব্যক্তি এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি দেশেই রয়েছেন।”
তার বিস্তারিত পরিচয় জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান বলেন, “এটি তার সাংগঠনিক নামও হতে পারে। এছাড়া ওবায়দুল্লাহসহ আরও কয়েকজন শীর্ষ নেতার নাম জানা যাচ্ছে।”
আনসার আল ইসলামের আলোচিত নেতা বহিষ্কৃত মেজর জিয়াউল হককেও এখনো ধরা যায়নি।
আসাদুজ্জামান বলছেন, “তাকে ধরার চেষ্টা চলছে। তবে জিয়াউল আনসারের শীর্ষ নেতা নন। তাকে সংগঠনটির প্রথম ১০ জনের একজন বলা যায়।”
গত বছরের নভেম্বরে ঢাকার আদালত পাড়া থেকে মৃতুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান এবং আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাবকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাদের সহযোগীরা। ওই দুই জঙ্গিও এখনো ধরা পড়েনি।
সিটিটিসি প্রধান বলছেন, তাদেরকে ধরতে সব রকম চেষ্টা চলছে।
সিটিটিসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানাচ্ছেন, পালানোর ১৫দিন পর্যন্ত ওই দুই জঙ্গি আদালতের দুই কিলোমিটার সীমানার মধ্যেই ছিলেন। একটি অভিযানে খুব কাছে গিয়েও তাদের ধরা যায়নি।
সর্বশেষ পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রশিক্ষণ ক্যাম্পগুলো উচ্ছেদের পর সেখান থেকেও তাদের সঙ্গে আনসার আল ইসলামের জোড়ালো সম্পর্কের বিষয়টি জানতে পেরেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী কুকি চিন আর্মি বা বম পার্টির তত্ত্বাবধানে সেখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল জামাতুল আনসারের সদস্যরা।
র্যাব বলছে, হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি এবং আনসার আল ইসলামের বেশ কিছু সদস্য ২০১৭ সালে নতুন এই উগ্রবাদী সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে। পরে ২০১৯ সালে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে।
জামাতুল আনসারের ‘আমির’ আনিসুর রহমান মাহমুদকে গ্রেপ্তারের পর গত ২৪ জুলাই র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, আনসার আল ইসলামের নেতা, সেনাবাহিনীর বরখাস্ত মেজর জিয়া বেশ কয়েকবার বান্দরবানে গিয়ে জামাতুল আনসারের আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদের সঙ্গে দেখা করেছেন।
চলতি মাসেই জামাতুল আনসারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার।
জামাতুল আনসারের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে সিটিটিসি। এই সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা বলছেন, পাহাড়ে জামাতুল আনসারের প্রশিক্ষণের জন্য টাকা-পয়সা দিয়েছে আনসার আল ইসলাম। এটা তাদের একধরনের বিনিয়োগ।
আনসার আল ইসলামের শীর্ষ নেতাদের কথা মতই চলতেন জামাতুল আনসারের নেতারা। এখন আনসার আল ইসলাম আরও কোন ‘তৃতীয় পক্ষকে’ এভাবে বিনিয়োগ করেছে কী না সেটা চিন্তার বিষয়।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক গত বুধবার বলেন, “১৭ আগস্টে বোমা হামলা চালানো জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের কর্মকাণ্ড আগের চেয়ে কিছুটা কম ছিল। গত বছর জেএমবির স্বঘোষিত আমির উজ্জ্বল মাস্টারকে ব্যাংক ডাকাতির সময় আটক করা হয় ময়মনসিংহ থেকে।
“তখন আমরা যে তথ্য পেয়েছিলাম যে তারা অর্থ সংকটে ভুগছে এবং তাদের মধ্যে নেতৃত্ব সংকট রয়েছে। যার কারণে পুরনো জঙ্গি সংগঠনের যারা একসঙ্গে কাজ করতে চান তারা বিভিন্ন সময় বসে সাম্প্রতিক সময়ে নিষিদ্ধ হওয়া জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াতে তারা যুক্ত হয়েছিল।
“এই সংগঠনটি আনসার আল ইসলাম থেকে অর্থায়ন পেয়ে তাদের কাজ শুরু করে। এর আমিরসহ অনেককেই আমরা আইনের আওতায় এনেছি। আমাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক সময়ে নিষিদ্ধ হয়েছে।”
সর্বশেষ চলতি মাসে ঢাকা ও মৌলভীবাজারের কুলাউড়া থেকে নতুন আরেকটি জঙ্গি সংগঠনের ৩৮ জনকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি। ইমাম মাহমুদের কাফেলা নামের ওই জঙ্গি সংগঠনটির মদদদাতা কারা তা এখনো স্পষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন সিটিটিসির প্রধান আসাদুজ্জামান।
একজন প্রবাসী অর্থদাতাকে শনাক্ত করা গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “তিনি কোনো সংগঠনের কি না, তা এখনো জানা যায়নি।”
জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
জঙ্গিবাদ নির্মূল না হলেও নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে বলে দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।
বুধবার সাংবাদিকদের প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, “বাংলা ভাই, শায়েখ আব্দুর রহমানের মত অনেক জঙ্গি দেখেছেন। তৎকালীন সরকার (বিএনপি) বলত, ‘এগুলো মিডিয়ার সৃষ্টি। কিন্তু পরবর্তীতে আপনারাই দেখেছেন সত্যিকারের জঙ্গির উত্থান।
“২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে বোমা হামলার ঘটনা ঘটায় জঙ্গিরা। এ হামলার মধ্য দিয়ে তারা জানান দিয়েছে যে দেশে জঙ্গি আছে।”
দেশে এখন জঙ্গিবাদের হুমকি আছে কি না- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমরা বলেছি জঙ্গিদের আমরা নিয়ন্ত্রণ করেছি, আমরা কখনো বলি নাই যে, তাদের নির্মূল করেছি। জঙ্গিরা মাঝে মাঝে তাদের অবস্থান প্রকাশ করার জন্য চেষ্টা করে এবং এগুলো সবই ব্যর্থ চেষ্টা।
“আমাদের যে গোয়েন্দা বাহিনী, নিরাপত্তা বাহিনী তারা সবসময় সক্রিয় আছে। কিছুদিন আগে মৌলভীবাজারে যে ঘটনা (জঙ্গি অভিযান) ঘটেছে তা আপনারা দেখেছেন। এজন্য আমি বলি জঙ্গিরা দু-একসময় মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দিতে চাইলেও আমাদের পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনী তৎপর আছে।”