ইউক্রেইনে যুদ্ধ এবং এর ফলে নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞায় পরিস্থিতি এখন আরও খারাপ হয়েছে, যা খাদ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে, বলেন তিনি।
Published : 17 Oct 2022, 09:46 PM
যুদ্ধ ও খাদ্য নিয়ে রাজনীতি বন্ধ এবং অপচয় রোধ করে খাদ্য ঘাটতি রয়েছে এমন এলাকা ও দুর্ভিক্ষপ্রবণ অঞ্চলে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিশ্বব্যাপী অস্ত্র তৈরিতে বিনিয়োগ করা অর্থের ‘সামান্য ভগ্নাংশ’ যদি খাদ্য উৎপাদন ও বিতরণে ব্যয় করা হয় তাহলে পৃথিবীতে কেউ ক্ষুধার্ত থাকবে না বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী।
“মানুষ হিসাবে, আমাদের অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে প্রত্যেকেরই খাবার খেয়ে বেঁচে থাকার এবং একটি সুন্দর জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে,” বলেন তিনি।
সোমবার বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যায় জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সদরদপ্তর থেকে ভার্চুয়ালি আয়োজিত বিশ্ব খাদ্য সম্মেলন ২০২২ এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছিলেন শেখ হাসিনা।
তিনি বক্তব্যের শুরুতে সম্মেলনের উদ্বোধন অধিবেশনে উপস্থিত থাকতে পেরে সন্তোষ প্রকাশ করেন। গুরুত্বপূর্ণ এ ফোরামে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য সংস্থার মহাপরিচালককে ধন্যবাদ জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, “অনুষ্ঠানটি এমন এক সময়ে হচ্ছে যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা এবং পাল্টা নিষেধাজ্ঞা, কোভিড-১৯ মহামারী এবং আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের খরার মত সংকটের মধ্যে বিশ্ব খাদ্য ব্যবস্থা ঘুরপাক খাচ্ছে।
“আমি আশা করি, এটি কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার পরিবর্তনে জরুরি সমাধান বয়ে আনতে যারা মূল ভূমিকায় রয়েছেন তাদের মধ্যে সংলাপকে উৎসাহিত করবে।”
বিশ্বের ৮০ কোটির বেশি মানুষ, যা মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ, নিয়মিত ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়- এই তথ্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ইউক্রেইনে যুদ্ধ এবং এর ফলে নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞায় পরিস্থিতি এখন আরও খারাপ হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাকে ব্যাহত করেছে এবং খাবারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
“আমাদের এই পৃথিবীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে অর্জিত সম্পদের প্রাচুর্যের মধ্যে এই বঞ্চনা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।”
‘বিশ্বে খাদ্য সংকট মানবসৃষ্ট’ মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “খাদ্য নিয়ে রাজনীতি ও ব্যবসায়িক স্বার্থ, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ এবং কীটনাশক ও রোগের আক্রমণ আমাদের কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।”
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সূচনাতেই ব্যাপক খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছিল এবং তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্যস্বাধীন দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে মনোযোগ দিয়েছিলেন। সেসময়কার ইতিহাস তুলে ধরেন তিনি।
জাতির পিতা ১৯৭৩ সালে এফএও-তে বাংলাদেশের যোগ দেওয়ার প্রক্রিয়া নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জানিয়ে দেশের কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন তিনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের প্রায় সব সদস্যসহ হত্যা করা হয়, যার ফলে কৃষি কর্মসূচি ও অন্যান্য উন্নয়ন উদ্যোগ স্থবির হয়ে পড়ে এবং পরের দুই দশকে দেশের অগ্রগতি হয়নি বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
এরপর গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকারের আদায়ের দীর্ঘ ২১ বছরের আন্দোলন সংগ্রাম শেষে ১৯৯৬ সালে একটি গণতান্ত্রিক, ধর্ম নিরপেক্ষ সরকার গঠন ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, তার বাবা যেখানে রেখে গিয়েছিলেন, সেখান থেকেই কাজ শুরু করেন তিনি এবং বঙ্গবন্ধুর স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিয়ে চলেন, বিশেষ করে কৃষিকে অগ্রাধিকার দেন তিনি, কারণ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন অন্য যেকোনো চাহিদার চেয়ে এগিয়ে।
তিনি জানান, তার প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের সময় দেশে চালের ঘাটতি ছিল ৪০ লাখ টন এবং ওই মেয়াদের শেষে তিনি যখন দায়িত্ব ছাড়েন তখন দেশে উদ্বৃত্ত ছিল ২৬ লাখ টন চাল।
তিনি বলেন, “আমার বর্তমান মেয়াদে, আমরা চাল উৎপাদনে আবারও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি। মোট ধান উৎপাদন ২০০৮ সালের ২ কোটি ৯৯ লাখ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে গত বছর ৩ কোটি ৮০ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের বাস্তবধর্মী নীতি, শক্তিশালী প্রণোদনা এবং সর্বোপরি আমাদের দেশের কঠোর পরিশ্রমী কৃষকদের অবদানের কারণে।”
দেশের কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও কৃষকদের কল্যাণে ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত সবার কাছে পৌঁছে দিতে ‘কৃষি বাতায়ন’ ওয়েবপেইজ এবং ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন নির্মাণের কথাও তুলে ধরেন তিনি।
তিনি বলেন, “এত ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার পরও বাংলাদেশের কৃষি খাত জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের চ্যালেঞ্জের মুখে। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন টেকসই কৃষির জন্য একটি বড় হুমকি। তারপরও বাংলাদেশ এবং এর সহনশীল জনগণ জীবনের সর্বক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছে।”
কৃষিপণ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশ শাকসবজি, মাছ ও অন্যান্য কৃষিনির্ভর পণ্যের উৎপাদন বাড়াতেও সফল, যার বেশির ভাগই রপ্তানি করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “বিশ্বে বাংলাদেশ আজ পাট ও স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয়, চাল ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চা উৎপাদনে চতুর্থ এবং ১১টি ইলিশ মাছ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে।”
মঙ্গলবার ইনভেস্টমেন্ট ফোরামে যে ২০ দেশের প্রদর্শনী হবে তার মধ্যে বাংলাদেশ থাকবে এবং এদেশে বিনিয়োগের যে আকর্ষণীয় সুযোগ রয়েছে তা সেখানে তুলে ধরা হবে বলেও জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “আমাদের কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার দিকেও মনোযোগ দেব এবং অন্যান্য ব্যবসার সুযোগের কথা তুলে ধরব।”
তিনি জানান, বাংলাদেশ এখন সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য এবং এদেশের উদার নীতি ও আইন বিনিয়োগের জন্য উপযোগী।
বাংলাদেশের এফডিআই সম্পর্কিত আর্থিক নীতি, কর সুবিধা, রপ্তানির জন্য প্রণোদনা সুবিধাসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ ও সুবিধার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। আমি বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এ খাতে বিনিয়োগে আমন্ত্রণ জানাতে চাই।”
বাংলাদেশকে খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে পরিণত করতে এফএও এর অবদানের কথা তুলে ধরে এ সংস্থার ধারাবাহিক সহযোগিতার জন্য তাদের ধন্যবাদও জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “আমি আশা করি, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এই সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে, বিশেষ করে কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর, পুষ্টি এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে।”
বক্তব্যের শেষের অংশে তিনি ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে জাতির পিতার প্রথম ভাষণকে উদ্ধৃত করেন, যেখানে জাতির পিতা বলেছিলেন, “আসুন আমরা একসাথে এমন একটি বিশ্ব তৈরি করি যা দারিদ্র্য, ক্ষুধা, যুদ্ধ এবং মানুষের দুর্ভোগ দূর করতে পারে এবং মানবতার কল্যাণে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জন করতে পারে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “আমিও ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত এমন একটি পৃথিবী কামনা করি।”