তাজরীন ট্রাজেডির এক দশক: শ্রমিক নিরাপত্তায় এখনও উদাসীনতা

নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত এবং অগ্নিকাণ্ডে হতাহতদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দাবি এখনও উঠছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Nov 2022, 03:37 PM
Updated : 24 Nov 2022, 03:37 PM

বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানায় সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের এক দশক পূর্তির দিনটি স্মরণ করেছেন শ্রমিকরা। ১০ বছর আগের এই দিনে ঢাকার আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনসে আগুনে পুড়ে অন্তত ১১২ জনের মৃত্যু হয়।

বৃহস্পতিবার দিনটি উপলক্ষে তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা দেশে ও দেশের বাইরে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডে নিহত ও আহতদের ন্যায়বিচার এবং কারখানার নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আওয়াজ তুলেছেন বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে বিশ্বের তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর সবচেয়ে বড় জোট ক্লিন কদস ক্যাম্পেইন (সিসিসি)।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হলেও আরও অনেক কিছু করার বাকি। এর মধ্যে রয়েছে, ব্র্যান্ডগুলোর নিরাপত্তা চুক্তিতে সই করা, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

সিসিসি বলেছে, “২০১২ সালের ২৪ নভেম্বরের দুর্ভাগ্যজনক দিনটির ১০ বছর পূর্তিতে আমরা ওই ঘটনায় নিহতদের স্মরণ করছি এবং তাদের পরিবার ও ওই ঘটনায় আহতদের প্রতি আমাদের সমবেদনা জানাই, যারা এখনও সেই দুর্ঘটনার পরিনতি বয়ে চলেছেন।”

সিসিসি জানায়, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আরও রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে নামিদামি ব্র্যান্ডগুলো এবং কারখানা মালিকরাও জানেন যে এই খাতে শ্রমিকদের কী ধরনের ঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে হয়, অথচ তারপরেও তারা যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পিছিয়ে।

“রানা প্লাজা ভবন ধসের ঠিক ছয় মাস পরে বিশ্বের পরিচিত পোশাক ব্র্যান্ডগুলোর টনক নড়ে এবং বাংলাদেশে আগুন ও ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্পর্কিত চুক্তিতে সই করা ও এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ছোটাছুটি শুরু করে।”

কিন্তু তাজরীন ট্রাজেডির এক দশক পরেও এখনও অনেক নামি ব্র্যান্ড আছে, যারা এই অগ্নিকাণ্ড বা রানা প্লাজা ধসের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের সময় ওই কারখানার সঙ্গে যুক্ত ব্র্যান্ড যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ালমার্ট, সিয়ার্স ও ডিজনি এবং রানা প্লাজা ধসের সময় সেখানকার কারখানাগুলোতে জড়িত ব্র্যান্ড- ফরাসি সুপারমার্কেট চেইন অয়চান, জেসি পেনি, দ্য চিলড্রেন প্লেস ও ওয়ালমার্ট এখনও বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তিতে সই করেনি বলে জানিয়েছে ক্লিন কদস ক্যাম্পেইন।

শ্রমিক সংগঠন ও ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যকার এই আইনি বাধ্যবাধকতাসহ চুক্তিটি এরআগে প্রাথমিকভাবে সম্পাদিত বাংলাদেশ অ্যাকর্ডকে প্রতিস্থাপিত করেছে এবং শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের কার্যক্রম বজায় রাখতে বাংলাদেশের বাইরেও এই চুক্তির পরিধি বিস্তৃত হয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশের একতা গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের কামরুল হাসানকে উদ্ধৃত করে বিবৃতিতে বলা হয়, “১৮৬টি ব্র্যান্ড এই চুক্তি সই করলেও, এটা দুর্ভাগ্যজনক যে কিছু ব্র্যান্ড এখনও তা করেনি, যাদের পোশাক তৈরি করতে গিয়েই ওই শ্রমিকদের মৃত্যু হয়েছে। অথচ তারা শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের অঙ্গীকার করতে ব্যর্থ হয়েছে।”

এই দিনটি উপলক্ষে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর কনস্টিটিউশনাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (ইসিসিএইচআর) ও ফেমনেট বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোকে, যারা জার্মান সাপ্লাই চেইন আইনের অধীনে, নোটিস দিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। বাংলাদেশের অনেকগুলো শ্রমিক সংগঠন এই দুই বেসরকারি সংস্থাকে সমর্থন দিচ্ছে।

নতুন এই আন্তর্জাতিক চুক্তি আগামী ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে, অথচ জার্মান ব্র্যান্ড টম টেইলর, ডাইশমান, সুইডিশ ব্র্যান্ড ইকেয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ড অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠান এই চুক্তি সই করেনি। এসব প্রতিষ্ঠানকেই নোটিস দিয়ে ওই চিঠি পাঠানো হয়েছে।

নোটিসে সতর্ক করা হয়েছে যদি এই কোম্পানিগুলো এই চুক্তিতে যোগ দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।

শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্র্যান্ডগুলোর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার মতো কার্যক্রমের দিকে যাওয়া উচিৎ হবে না বলে আন্দোলনকারীরা মনে করছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়। তারা আশা করছে, অ্যামাজন ও ইকেয়ার মতো ব্র্যান্ডগুলোকে এই চুক্তিতে সই করানোর জন্য এই চিঠি হয়ত একটি শেষ চেষ্টা, যা অন্য কোম্পানিগুলোকেও এই চুক্তিতে আসতে উৎসাহিত করবে।

সিসিসির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শ্রমিকের নিরাপত্তায় ব্র্যান্ড ও তাদের পণ্য সরবরাহকারীদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে এ ধরনের চুক্তি কাজ করে। এই খাতে বড় ধরনের প্রাণহানি রোধ এবং কারখানাগুলোকে উল্লেখযোগ্যভাবে নিরাপদ করেছে অ্যাকর্ড চুক্তি।

সিসিসি এবং এর বাংলাদেশি অংশীদারেরা ও আন্তর্জাতিক মিত্ররা অঙ্গীকার করেছে যে তারা অ্যাকর্ডের বাংলাদেশে কার্যক্রম নজরদারিতে রাখবে যাতে অ্যাকর্ড কর্তৃপক্ষ এদেশে তাদের সাফল্য ধরে রাখে এবং এই চুক্তি মেনে না চলা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। একইসঙ্গে তারা যাতে তাদের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা বজায় রাখে এবং শ্রমিকদের নির্ভয়ে তাদের কথা বলতে পারার পরিবেশের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে।

শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর এই জোটের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের এক দশকে যারাই বিভিন্ন কারখানায় দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বা আহত হয়েছেন, তাদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা জরুরি।

মালিকপক্ষ, শ্রমিক ইউনিয়ন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), জার্মানি ও নেদারল্যান্ডের সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকার এই বছর পরীক্ষামূলকভাবে গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য এমপ্লয়মেন্ট ইনজুরি ইন্সুরেন্স কর্মসূচি চালু করেছে যা আহত শ্রমিক ও পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা খরচ ও আয় বঞ্চিত হওয়ার ক্ষতিপূরণ দেবে।

সিসিসি জানায়, এই পরীক্ষামূলক বিমা কর্মসূচি সফল করতে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতাদের অংশগ্রহণ জরুরি। তাদের এটা নিশ্চিত করতে হবে যখন তারা কারখানাগুলোর সঙ্গে পোশাক সরবরাহের চুক্তি করবে তখনই তারা নিশ্চিত হবে যে নিয়োগকর্তা তাদের সব শ্রমিকের জন্য এই বিমার নিবন্ধন করেছে।

সিসিসি আরও আশা করে যে এই পাইলট কর্মসূচি থেকে বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ বিমা কর্মসূচি শুরু হবে, তবে গত এক দশকে যেসব শ্রমিক ও পরিবার এ ধরনের দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের কথাও ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না এবং তাদের জন্য ন্যয় বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

তাজরীন ট্রাজেডির কথা স্মরণ করে ন্যাশনাল গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি আমিন আমিরুল হক বলেন, “রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশনের মর্মান্তিক ঘটনার পর অনেক কিছুই বদলেছে কিন্তু একত্রিত হয়ে দর কষাকষি করার শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার পরিবেশ এখনও অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় অনুযায়ী ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করা ও জেন্ডার সমতা অর্জনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে।”

তৈরি পোশাক খাতের উন্নততর কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার চলমান উদ্যোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “ইউরোপীয় ইউনিয়নের আসন্ন ‘ডিউ ডিজিলেন্স’ আইনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে কাজ চলছে। অ্যাপারেল খাতে শ্রম আইন বাস্তবায়নে শ্রমিক ও শ্রমিকদের সংগঠনকে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এবং কমপ্ল্যায়েন্স কার্যক্রমে যুক্ত করতে হবে। সুশীল সমাজের অংশগ্রহণ ছাড়া শুধু ইইউ কর্তৃপক্ষ এই আইন প্রণয়ন করলে তা কার্যকর হবে না।”