“অহনকার পোলাপাইন আর বাউল গান, বাঁশি এসব শিখতে চায় না।”
Published : 19 Jan 2024, 07:59 PM
শৈশবে যাত্রাপালায় বাঁশির সুর শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন ঝিনাইদহের কমল সরকার। পরে নিজে হয়ে ওঠেন বংশীবাদক, বাঁশি তৈরির কারিগরও। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাঁশির সঙ্গে তার সখ্য।
তেজগাঁও লিংক রোডের কনভেনশন সেন্টার আলোকিতে আয়োজিত ‘খাদি উৎসবে’ পাওয়া গেলো কমল সরকারকে।
এই উৎসবে ‘বাঁশের বাঁশি’ নামে একটি স্টলে বসে আপনমনে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন কমল। তার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকেই ছবি তুলছিলেন, কেউবা মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করছিলেন।
এর ফাঁকেই কথা হয় অশীতিপর কমল সরকারের সঙ্গে। তিনি বললেন, “এখন আর বাঁশির সেই সুদিন নেই। বাঁশি বিক্রিও কমে গেছে। তরুণ প্রজন্মের মাঝে আর আগের মতো বাঁশি শোনার আগ্রহও নেই।”
বাঁশি শুনে তো এখনই অনেক তরুণ ছবি তুলছেন, ভিডিও করছেন; তাহলে তরুণদের আগ্রহ নেই বলছেন কেন? কমলের সোজাসাপ্টা জবাব, “অহন সবকিছু ওই মোবাইল ফোনেই।”
এ কথা বলেই ছোটবেলায় যাত্রাপালা দেখতে যাওয়ার দীর্ঘ স্মৃতিচারণ শুরু করলেন তিনি। যাত্রাপালায় বাঁশির সুর এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে- এরপর থেকে বাঁশির সঙ্গেই কমলের বসবাস।
এ বংশীবাদক বলেন, “অহন তো কেউ বাঁশি শুনতে চাইলে মোবাইল ফোনেই শোনে। আমাদের আর ডাকে না। আগে তো অনুষ্ঠান করেই টাইম পাইতাম না।”
তরুণদের মাঝে শেখার তেমন আগ্রহ নেই জানিয়ে কমল আক্ষেপ করে বললেন, “অহন তো বাউল গান বন্ধই হয়ে গেছে। অনেক জায়গাতেই আর বাউল গান নাই। আমাদেরও কেউ ডাকে না। অহনকার পোলাপাইন আর বাউল গান, বাঁশি এসব শিখতে চায় না।”
কমল সরকারের সঙ্গে যখন আলাপ জমে উঠেছে, ততক্ষণে আলোকিতেও ভিড় বেড়েছে দর্শনার্থীদের।
‘খাদি: দ্য ফিউচার ফেব্রিক শো’ প্রতিপাদ্য নিয়ে শুক্রবার সকাল থেকে আলোকিতে শুরু হয়েছে ‘খাদি উৎসব-২০২৪’।
সকাল থেকে লোক সমাগম কম থাকলেও বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই লোকজনের ভিড় বাড়তে থাকে, আমন্ত্রিত অনেকেও আসতে শুরু করেন।
ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশের (এফডিসিবি) আয়োজিত এ উৎসব চলবে শনিবার পর্যন্ত (সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা)।
উৎসবে রয়েছে বিভিন্ন স্টল। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বাঁশের বাঁশি, পটুয়া, শীতল পাটি, ট্যাপা পুতুল, শখের হাঁড়ি, সুতার হাতপাখা, শৈলী, বাঙলা সেলাই, মধুমাখা, রাণুবালা, জেসিয়া'স ক্রাফট, ট্রাইবাল ক্রাফটস, ক্ষুদাই আর্ট স্টুডিও, হ্যান্ড টাচ প্রভৃতি।
মতিঝিল থেকে উৎসবে এসেছেন নাবিলা ও তার বোন তামান্না। বিভিন্ন স্টলে ঘুরে বেড়ানোর ফাঁকে নাবিলা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ধরনের আয়োজন তো খুব বেশি দেখা যায় না। এখানে এসে ভালো লাগছে। বাঁশি, ট্যাপা পুতুলসহ নানা ঐতিহ্যবাহী পণ্য দেখছি। পছন্দের কিছু জিনিসও কিনেছি।”
উৎসব প্রাঙ্গণে দুই শিশুকে ছুটে বেড়াতে দেখা যায়। বিভিন্ন স্টলে গিয়ে তারা ছবিও তুলছিলেন। কথা বলে জানা গেল, এই দুই শিশুর নাম মেহনূর ও গুলনাহার। তাদের পুরো পরিবার এসেছে উৎসবে।
কাঠের পুতুল সাজিয়ে বসেছেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থেকে আসা আশুতোষ চন্দ্র সূত্রধর। তার স্টলে রয়েছে কাঠের ঘোড়া, হাতি, পালঙ্ক, পুতুলসহ নানা পণ্য।
আশুতোষ বললেন, “দাদার আমল থেকেই আমরা কাঠের কাজ করি। সোনারগাঁ জাদুঘরের ভেতরে আমাদের স্টল আছে। সারা দেশে পাইকারি এবং খুচরা বিক্রি করি।"
স্টলে বসেই হাতপাখায় নকশা আঁকছিলেন বাসন্তী রাণী সূত্রধর। তিনিও সোনারগাঁ থেকে খাদি উৎসবে অংশ নিতে এসেছেন বলে জানালেন।
বাসন্তী বললেন, “কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় জয়নুল উৎসবেও অংশ নিয়েছি। এখন সোনারগাঁতে কারুশিল্প মেলা হচ্ছে, সেখানে আমার স্টল আছে। এরকম মেলায় আসলে বিক্রি বেশি হয়, প্রচারও হয়।"
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরার প্রয়াস
বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরতেই ‘খাদি উৎসব’ আয়োজন করার কথা জানিয়েছে ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ (এফডিসিবি)।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কাউন্সিল বলেছে, এই প্রদর্শনীর লক্ষ্য হল, ঐতিহ্যবাহী ও পরিবেশবান্ধব খাদি পোশাকের প্রসার নিশ্চিত করার পাশাপাশি খাদি কাপড় থেকে তৈরি বিভিন্ন পণ্যের বৈশিষ্ট্য সর্বসাধারণকে জানানো।
“শুধু পোশাক বা ফ্যাশনের অনুষঙ্গ হিসেবে নয়, এর বাইরেও দৈনন্দিন জীবনে খাদি কাপড়ের বহুমাত্রিক ব্যবহার ও স্থায়ীত্ব নির্ধারণে এই উৎসব-প্রদর্শনী বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে আমরা আশাবাদী।”
দুদিনের এ আয়োজনে সন্ধ্যার পর কেবল আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য অনুষ্ঠিত হচ্ছে ফ্যাশন শো। এ শো’তে ডিজাইনাররা তাদের খাদি-অনুপ্রাণিত সংগ্রহ উপস্থাপন করছেন।
প্রথম দিন যাদের নকশা করা পোশাক-পণ্য প্রদর্শন করা হচ্ছে, তারা হলেন- জাকিয়া ও মায়শা; আবির ও তাজবীর; ফাইজা আহমেদ, তেনজিং চাকমা, ইবালারিহুন, আফসানা ফেরদৌসী, ইমাম হাসান, সাদিয়া রশিদ চৌধুরী ও অভিষেক রায়।
দ্বিতীয় দিন শৈবাল সাহা, চার্লি, মাহিন খান, শাহরুখ আমিন, কুহু, নওশীন খায়ের, সায়ন্তন সরকার, লিপি খন্দকার ও চন্দনা দেওয়ানের নকশা করা পণ্য প্রদর্শিত হবে।
বাংলাদেশ ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিলের সভাপতি মাহিন খান বলেন, “ফ্যাশন ডিজাইনের প্রতি টেকসই এবং সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার জন্যই এই আয়োজন। এছাড়া একটি পরিবেশবান্ধব ভবিষ্যতের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা প্রকাশে এই আয়োজন সহায়ক হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।”