“সারা দেশে কত ব্যাটারিচালিত রিকশা যে আছে, তার হিসাবই কারও কাছে নেই। এদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই, সংখ্যায়ও অনেক। সরকার চাইলেই এদের উচ্ছেদ করতে পারবে না”, বলছেন ট্রাফিক পুলিশের এক কর্মকর্তা।
Published : 20 Feb 2024, 12:23 AM
রাজধানীর অলি গলিতে দাপিয়ে বেড়ানো ব্যাটারিচালিত রিকশা ‘বিপজ্জনক’ বলে অনেকে তা বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে; যদিও কেউ আবার বলছেন, পায়েচালিত রিকশার চেয়ে এগুলো ভালো, ছোটা যায় দূরের গন্তব্যে, সময়ও লাগে কম।
তবে গতি বাড়লেও এসব রিকশার ব্রেক বা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটেনি। অনেক সময় লক্কড়ঝক্কড় কাঠামো আর নড়বড়ে ব্রেকের এ বাহনগুলো পড়ছে দুর্ঘটনায়। আবার যে সড়কে চলাচলই নিষিদ্ধ, সেসব সড়কেও সোজা কিংবা উল্টোপথে চলছে এগুলো।
ঢাকার ট্রাফিক পুলিশ বলছে, আইন অনুযায়ী এগুলোর চলাচল বন্ধে কাজ করছে পুলিশ। তবে ‘মানবিকতার খাতিরেও’ কখনও কখনও ছাড় দিতে হচ্ছে।
অন্যদিকে চালক-মালিকরা বলছেন, মানবিকতা নয়, টাকা ছাড়া কেউ কোনো ছাড় দেয় না।
সড়ক থেকে নিয়মিত অবৈধ রিকশা উচ্ছেদে অভিযান চালানোর কথা তুলে ধরে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো অবৈধ হলেও ঢাকায় চলছে, এই সত্য অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
“আপনারা জানেন, এ বিষয়ে হাই কোর্টের রুলও আছে। কিন্তু আমাদের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। প্রধান হচ্ছে জনবল সংকট। আপনারা দেখবেন, আমাদের লোক শহরের ইন্টারসেকশন-কেন্দ্রিক মোতায়েন থাকে, সেটাও বড় বড় সড়কগুলোতে শুধু। প্রত্যেকটা অলিগলিতে কিন্তু আমরা লোক দিতে পারি না। এটা আমাদের পক্ষে সম্ভব না।”
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “ট্রাফিকের প্রত্যেকটা বিভাগে নির্দেশনা দেওয়া আছে যে, যখনই কোনো ব্যাটারিচালিত রিকশা দেখা যাবে, ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা এই বাহনগুলোকে ডাম্পিং করছি। প্রতিদিন গড়ে ১০০টির বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
“কিছু ক্ষেত্রে আমরা একটু সংবেদনশীল থাকি। এটা আপনাদের একটু জেনে রাখা দরকার। অনেক সময় দেখা যায় কিছু বিষয়ে ছাড় দিতে হয়। যেমন- মুমূর্ষু রোগীকে নিয়ে যখন হাসপাতালে যান কেউ, একজন মা যখন সন্তানকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নামাতে যান, অথবা একটা ওষুধের দোকানের সামনে যখন একজন রোগী রিকশা নিয়ে নামেন এবং সেগুলো যদি কোনো ট্রাফিক ইস্যু তৈরি না করে, সেসব ক্ষেত্রে মানবিক থাকার জন্য বলেছি আমরা।”
দুই কোটির বেশি মানুষের ঢাকা মহানগরে রাস্তার পরিমাণ যে অপ্রতুল, সেই বাস্তবতা তুলে ধরে মুনিবুর রহমান বলেন, “আছে সাত থেকে আট শতাংশ, থাকার কথা ২৫ শতাংশ। মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থাসহ সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই কিন্তু আমাদের আইনগত কাজগুলো চালিয়ে নিতে হয়।”
পুলিশ বলছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনের নাম করে এসব ব্যাটারিচালিত রিকশার অনুমোদন নিয়ে পরবর্তীতে এগুলো রাস্তায় নামানো হয়েছে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে দেওয়ার দাবিতে বনানী ১১ নম্বর সড়ক প্রায় ৪ ঘণ্টা অবরোধ করেন চালকরা। সেখানে ক্র্যাচ হাতে কয়েকজনকে দেখা যায়।
পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার আব্দুল মোমেন বলেন, “সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে দেওয়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পরিচয়ে ওইসব রিকশা চালানো হচ্ছে। কিন্তু এগুলো চালাচ্ছেন সুস্থ ব্যক্তিরাই। আবার পুলিশ এসব রিকশা আটকে আইনগত পদক্ষেপ নিতে গেলে তারা একজন কার্ডধারী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকেই পাঠাচ্ছেন।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, “সম্প্রতি কিছু বিশৃঙ্খলার পরিপ্রেক্ষিতে গুলশান-বনানী সোসাইটি ওই রিকশাগুলোকে চলতে না দেওয়ার বিষয়ে তাদের বক্তব্য জানিয়েছে। এরপর সোসাইটির সহায়তায় গত তিন সপ্তাহ ধরে তাদের আর প্রধান সড়কগুলোতে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না।”
গত এক বছরের মধ্যে মিরপুর, ডেমরা, গাবতলী, মোহাম্মদপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় একই দাবিতে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন, পুলিশ বক্সে হামলার মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন রিকশা চালকরা। সবশেষ গত ২ জানুয়ারি একই দাবিতে ধানমন্ডিতে একটি ট্রাফিক পুলিশ বক্সে হামলা ও ভাঙচুর চালান রিকশাচালকরা।
পুরো ঢাকাতেই এখন ‘হ-য-ব-র-ল’ অবস্থায় চলছে এসব রিকশা। ডেমরা, শ্যামপুর, বনশ্রী, রামপুরা থেকে শুরু করে ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, বসিলা এলাকার অলিগলি থেকে শুরু করে বড় রাস্তায়ও চলছে এই রিকশা।
‘কিউআর কোড দিয়ে রিকশায় চাঁদাবাজি’
ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে চাঁদা আদায় নিয়ে মিরপুরে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সঙ্গে চালকদের কয়েক দফা সংঘাত হয়েছে। রিকশা থেকে চাঁদা আদায়ে ওই এলাকায় আগে প্রতি মাসে ‘কিউআর কোড টোকেন’ দিত চাঁদাবাজরা।
কিন্তু ২০২১ সালের ১৬ মে পল্লবীতে ব্যবসায়ী সাহিন উদ্দীন খুন হলে সন্দেহভাজন হিসেবে চাঁদা আদায় চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানান পল্লবীর ব্যাটারিচালিত রিকশা মালিক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সাহিন উদ্দীন হত্যাকাণ্ডের পর চক্রের কয়েকজন গ্রেপ্তার হওয়ায় চাঁদাবাজিটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে থেকেই তারা আওয়াজ দিচ্ছিল যে, নির্বাচনের পরের মাস থেকে তাদের কাছ থেকে টোকেন কিনতে হবে।
“তারা গ্যারেজে গিয়ে গিয়ে চালক-মালিকদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। চালক-মালিকরা প্রতিবাদ করলে তারা হামলাও চালিয়েছে কয়েক দফায়।”
কিউআর কোড দিয়ে চাঁদাবাজি কীভাবে জানতে চাইলে খোরশেদ বলেন, “কিউআর টোকেন হচ্ছে একটি টিনের বোর্ড, যেখানে একটি কিউআর কোড থাকে শুধু। সেটি পাওয়ার জন্য মাস প্রতি রিকশা মালিককে ১ হাজার ৬০০ টাকা করে দিতে হয়। ওই টাকা দিলে কিউআর কোড সম্বলিত বোর্ডটি রিকশার সিটের নিচে লাগিয়ে দেওয়া হয়।
“তাদের লোকেরা রাস্তায় থাকে সবসময়। সন্দেহ হলে তারা রিকশা থামিয়ে সিট উল্টে কিউআর কোড মোবাইল ফোনে স্ক্যান করে নেয়। তাতেই রিকশার সব তথ্য চলে আসে, রিকশা মালিক চাঁদা দিয়ে হালনাগাদ আছে কিনা, তাও জানা যায়। মাসের চাঁদার টাকা পরিশোধ না করলে তারা রিকশার ব্যাটারির তার কেটে দেয়, রাস্তায় চলতে দেয় না।”
এবার কিউআর কোড টোকেনের দাম ২ হাজার টাকা করার কথা বলেছে জানিয়ে খোরশেদ বলেন, “এ নিয়ে রিকশাচালকরা বিরোধিতা করলে তারা কয়েক দফায় হামলা চালায় এবং তাদের হামলায় অন্তত ছয়জন রিকশাচালক আহত হন। গুরুতর আহত একজন এখনো পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি।”
খোরশেদের ভাষ্য, “স্থানীয় যুবলীগ নেতা বিহারী শেখ মোহাম্মদ আলী আড্ডু চাঁদার দাবিতে বাহিনী দিয়ে এসব করাচ্ছেন। পল্লবী এলাকায় প্রায় ৭ হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা চলে। এগুলোর সবগুলো থেকে যদি তারা ২ হাজার করে টাকা তুলতে পারে, তবে মাস শেষে শুধু পল্লবী থেকেই আসবে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা।”
তবে যুবলীগ নেতা আড্ডু বলছেন, ‘সামাজিক দায়বদ্ধতার’ জায়গা থেকে এই রিকশাগুলোর এলোমেলো চলাচল নিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি।
তার ভাষ্য, “এ রিকশাগুলোর ব্রেক কাজ করে না। প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। অথচ পুরো পল্লবী এলাকায় এরা গিজগিজ করছে। এসবের প্রতিবাদ জানাতে গিয়েই উল্টো হয়রানির শিকার হচ্ছি।”
জানতে চাইলে পল্লবী থানার ওসি অপূর্ব হাসান বলেন, “রিকশাচালকদের এ বিষয় নিয়ে অনেক সাংবাদিক আমাকে ফোন করেছেন, কিন্তু অভিযোগ নিয়ে কেউ আসেনি। তবে আমি বলতে পারি আমার থানা এলাকায় এখন কোনো রিকশা থেকে চাঁদাবাজি হয় না। একটা চক্র অপচেষ্টা করেছিল, পুলিশের হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়েছে।”
যুবলীগ নেতা আড্ডুর বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, “তার বিরুদ্ধে আগের কোনো মামলা নেই।”
ঝোঁক বেশি ব্যাটারির রিকশাতেই
আগে পায়েচালিত রিকশা চালালেও এখন ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান শ্যামলী এলাকার মো. জোহা। দিন শেষে তাকে মালিককে দিতে হয় ৩০০ টাকা। যদিও প্যাডেলের রিকশায় আগে দিতেন ১০০ টাকা।
জোহার ভাষ্য, “ইলেকট্রিক রিকশা আসার পর চালকেরা বেশি জমা দিয়ে হলেও ব্যাটারির রিকশাই খোঁজেন। কারণ এতে দূরে যাওয়া যায়, সিএনজির মতই ভাড়া হাঁকা যায়। ২-৩টা দূরের খেপ পেলেই চলে।”
এক লাখ টাকার মধ্যে তিন থেকে চার ব্যাটারির একটা রিকশা পাওয়া যায় জানিয়ে তিনি বলেন, “মালিক প্রতিদিনের জমা থেকে গ্যারেজ ভাড়া দেন, সেখানেই রিকশাগুলো চার্জ হয়। গ্যারেজ ভাড়া শ্যামলী এলাকায় ৩ হাজার টাকা, আবার মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধের ওপারে ২ হাজারের গ্যারেজও আছে। গ্যারেজে রিকশাচালকদের বিনামূল্যে থাকা ও নামমাত্র মূল্যে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।”
ব্যাটারির রিকশা থেকে চালকদের আয়ও বেশি। চালকরা বলছেন, দিনভর চালালে আটশ থেকে হাজার টাকা উপার্জন করা যায়। কোনো কোনো এলাকায় রোজগার এরও বেশি।
কী হবে তাহলে!
ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে প্রায়ই লেখালেখি দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে। এই বাহনগুলো বন্ধের দাবি জানাতে দেখা যায় বিভিন্ন পেইজ বা গ্রুপে ।
ফেইসবুক গ্রুপ ‘ট্রাফিক অ্যালার্টে’ ব্যাটারিচালিত রিকশার জটলার ভিডিও দিয়ে গত বুধবার মারুফুর রহমান খান নামের একজন লিখেছেন, “ব্যাটারিচালিত রিকশার কোনো লাইসেন্স লাগে না, এদের চালকদেরও কোনো লাইসেন্স লাগে না। এদের দাপট ঢাকার প্রতিটি মহল্লায়।”
একদিন আগে একই গ্রুপে সরদার কাওসার নামে আরেকজন লিখেন, “ঢাকার মেইন রাস্তায় রিকশা সমস্যা কী কোনোভাবেই সমাধান করা সম্ভব না? এটা নিয়ে কী জাতীয় পর্যায়ে কারো মাথাব্যাথা নেই?”
বিষয়টি নিয়ে ঢাকার ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “সরকারের একজন মন্ত্রী সম্প্রতি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাগুলোকে ‘বাংলার টেসলা’ বলেছেন। ঢাকার যেখানেই অটোরিকশা বন্ধ করতে চায় পুলিশ, সেখানেই স্থানীয় রাজনীতিকদের কাছে গিয়ে হাজির হয় চালক-মালিকরা। আর রাজনীতিবিদরাও তো হুট করে এতগুলো লোকের জীবিকার পথ বন্ধের সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। তাই আমরা ওদের বিরুদ্ধে খুব কঠোরও হতে পারছি না।”
সরকারের হাতে এই রিকশাগুলোকে এখন বৈধ করা ছাড়া ‘আর কোনো গতি নেই’ মন্তব্য করে এই কর্মকর্তা বলেন, “সারা দেশে কত ব্যাটারিচালিত রিকশা যে আছে, তার হিসাবই কারো কাছে নেই। এদের কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। ওরা এখন সংখ্যায়ও অনেক, সরকার চাইলেই এদের উচ্ছেদ করতে পারবে না।
“এখন ওদের জন্য একটা পৃথক নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঠিক করে লাইসেন্সিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যাতে অন্তত তাদের ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের জন্য আইনগত উপায়ে সাজা দেওয়া যায়। বিআরটিএ দিয়ে ওদের লাইনে আনা যাবে না।”