আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
Published : 28 Jan 2024, 03:26 PM
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ (২) ধারার সর্বনিম্ন সাজা ৭ বছরের কারাদণ্ড হলেও তথ্য বিকৃতির মামলায় মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান এবং পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিনকে আদালত ‘বিশেষ বিবেচনায়’ দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।
ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াত বৃহস্পতিবার ৫০ পৃষ্ঠার ওই লিখিত রায় ঘোষণা করেন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ (২) ধারায় এটাই প্রথম রায় বলে বিচারক জানান।
দশ বছর আগে মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের সরাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগে এ মামলা দায়ের করা হয়।
জামিনে থাকা আদিলুর ও এলান রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। দুই বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি তাদের ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয় রায়ে।
আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে জানিয়ে বিচারক রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, “মানবাধিকার সংগঠন অধিকার ওয়েবসাইটে মতিঝিলের শাপলা চত্বর হেফাজতের অবস্থান এবং সেই অবস্থান থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ৬১ জন নিহত ও অসংখ্য নিখোঁজের যে সংবাদ প্রকাশ করেছেন সেটা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটাতে পারত। একইসঙ্গে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করার জন্য এ ধরনের সংবাদ প্রচার করা অবশ্যই অপরাধ।
“অধিকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এই সংবাদ তখনকার সব গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। কাজেই এমন মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন সংবাদ অধিকার প্রকাশ করেছে, যার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানটির সম্পাদক ও পরিচালক এড়াতে পারেন না। এ কারণে ট্রাইবুনাল দুজনকে দোষী সাব্যস্ত করছে।”
তারপরও কম সাজার কারণ ব্যাখ্যা করে বিচারক বলেন, “এই ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন শাস্তি ৭ বছরের কারাদণ্ড। তারপরও আসামিদের সামাজিক অবস্থান এবং ফৌজদারি অপরাধ এই প্রথম হওয়ায় তাদেরকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হল।”
রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি নজরুল ইসলাম শামীম সংবাদিকদের বলেন, “আসামিরা মামলার বিচারে কোনোদিন গরহাজির না থেকে প্রতি ধার্য তারিখে হাজির থেকে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন । এ কাজ করে তারা আদালতকে সাহায্য করেছেন বলে বিবেচনা করেছেন বিচারক। সে কারণে তাদের আইনে নির্ধারতি সর্ব নিম্ন সাজা না দিয়ে তার চেয়েও কম সাজা দেওয়া যৌক্তিক মনে করেছেন তিনি।”
তবে এই রায়ে সন্তুষ্ট নন জানিয়ে আইনজীবী শামীম বলেন, “আমরা রায়ের কপি হাতে পেয়ে তা পর্যালোচনা করে আপিলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারি।”
অন্যদিকে দণ্ডিত আসামি এবং তাদের আইনজীবীরাও রায় নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কারাগারে নেওয়ার আগে প্রিজন ভ্যানে তোলার সময় আদিলুর রহমান খান সাংবাদিকদের বলেন, “আমি ন্যায়বিচার পাইনি। এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাব।”
আদিলুর রহমানের আইনজীবী মোহাম্মদ রুহুল আমিন ভূঁইয়া বলেন, “বিচারিক আদালত থেকে ন্যায়বিচার পাননি আদিলুর রহমান ও নাসির উদ্দিন। এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আবেদন করা হবে।”
মামলার রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া দূতাবাসের কর্মকর্তারা। অস্ট্রেলিয়া হাই কমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি সাচা ব্লুমেন আদালতপাড়ার সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, “এ বিষয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। আমরা শুধু পর্যবেক্ষক হিসেবে আদালতে এসেছি। আমরা রায় পর্যবেক্ষণ করতে এসেছি।”
দেশি-বিদেশি অনেক মানবাধিকারকর্মীও উপস্থিত ছিলেন আদালতে। মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, “বিতর্কিত ৫৭ ধারায় আজ একজন স্বনামধন্য অধিকারকর্মীরকে সাজা দেওয়া হল। যেটা মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থি।”
এ সময় একটি বিদেশি টেলিভিনে চ্যানেলর সাংবাদিককেও এজলাসের বারান্দায় খবর পরিবেশন করতে দেখা যায়।
যে কারণে মামলা:
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ আন্দোলন শুরুর পর তার প্রতিক্রিয়ায় মাঠে নেমেছিল কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজত সারাদেশ থেকে সংগঠনের কর্মী ও মাদ্রাসাশিক্ষার্থীদের ঢাকায় জড়ো করে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়েছিল।
দিনভর সরকারের বারবার আহ্বানেও তারা ওই স্থান না ছাড়ায় রাতে সমন্বিতভাবে অভিযান চালিয়ে তাদের সরিয়ে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেই অভিযানে ৬১ জন নিহত হন বলে পরে অধিকার তাদের এক প্রতিবেদনে দাবি করে; যদিও পুলিশের দাবি, রাতের অভিযানে কেউ মারা যাননি, আর দিনভর সংঘাতে নিহতের সংখ্যাটি ১১।
অধিকারের প্রতিবেদনে প্রকাশিত সংখ্যাটি নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হলে ওই বছরের ১০ অগাস্ট এই ঘটনায় গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরে জিডিটি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্বে থাকা আইনজীবী আদিলুরকে মামলা দায়েরের দিন ১০ অগাস্ট রাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অধিকারের কার্যালয়েও চলে পুলিশের তল্লাশি। আদিলুর দুই মাস পর জামিনে মুক্তি পান। এলানও আদালতে আত্মসর্পণ করে জামিন নেন।
তদন্ত শেষে ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার আদালতে আদিলুর ও এলানের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। পরদিন মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়, ২০১৪ সালে হয় অভিযোগ গঠন। তার সাত বছর পর ২০২১ সালের ৫ অক্টোবর বাদীর সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে মামলাটির বিচার শুরু হয়।
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামি আদিলুর ও এলান ৬১ জনের মৃত্যুর ‘বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যা’ তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন তৈরি ও প্রচার করে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে ‘আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নের অপচেষ্টা’ চালান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকার ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি দেশে-বিদেশে ‘চরমভাবে ক্ষুণ্ন করে’।
“পাশাপাশি তারা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি করে, যা তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ (১) ও (২) ধারায় অপরাধ। একইভাবে ওই আসামিরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর টেষ্টা চালায় এবং সরকারকে অন্য রাষ্ট্রের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালায়।”
বিচার চলাকালে মোট ৩২ জনের সাক্ষ্য শুনে বৃহস্পতিবার দুই আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিল আদালত।
(প্রতিবেদনটি প্রথম ফেইসবুকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে: ফেইসবুক লিংক)