বৃহস্পতিবার সকালে প্রথমবারের মত ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণের পথে চলে গেছে সুন্দরবন এক্সপ্রেস।
Published : 02 Nov 2023, 01:30 PM
পদ্মার আগ্রাসী ঢেউ আর গর্জনের ভয়াল রূপ উপেক্ষা করে ছুটতে হয়েছে কিছুদিন আগেও, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেছে নদীতেই; আর এখন দুর্গম সেই যাত্রার পথ যেন পানির মত সহজ।
খরস্রোতা পদ্মার বুক চিড়ে বাসযোগে দক্ষিণের পথে চলার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে সোয়া এক বছর আগেই। সেই পথে এবার ট্রেনযোগে বাড়ি ফেরার স্বপ্নও পূরণ হল পদ্মাপাড় ও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের।
খুলনা থেকে বুধবার রাতেই পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় আসে আন্তঃনগর খুলনা এক্সপ্রেস ট্রেন। সকাল সোয়া ৮টায় প্রথমবারের মত ঢাকা থেকে যাত্রী নিয়ে ফের পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণের পথে চলে গেছে সেটি।
এতদিন যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে চললেও এখন থেকে দক্ষিণের পথে চলা সুন্দরবন এক্সপ্রেসের সঙ্গে বেনাপোল এক্সপ্রেসও চলবে পদ্মা সেতু হয়ে। তাতে যাত্রা হবে সহজ, কমবে সময়।
ঢাকা থেকে পদ্মাসেতু হয়ে ট্রেনে প্রথম যাত্রার সাক্ষী হতে বৃহস্পতিবার ভোরে কমলাপুরে স্টেশনে আসেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী রাসেল ও তার বন্ধু কাজী মাসুদ; চোখে-মুখে ছিল উচ্ছ্বাস।
৭ নম্বর প্ল্যাটফর্মে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে রাসেল বলেন, “মাত্র ১৫-২০ মিনিটে পদ্মা সেতুর এপাশ থেকে ওপাশে চলে যাব, এটা স্বপ্নের মত। এই নদীর ওপর দিয়ে এখন রেল চলবে, অ্যামেইজিং।
“গত বছর জুলাইয়ে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে গিয়েছিলাম। আজকে রেললাইনটা চালু হল, এটা একটা স্বপ্নের মত। আমাদের কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি।”
কোনো কাজের উদ্দেশে নয়, পদ্মা সেতু হয়ে প্রথম ট্রেন যাত্রার সাক্ষী হতেই গোপালগঞ্জে যাচ্ছেন দুই বন্ধু।
রাসেলের ভাষ্য, “আজকে আমাদের অনেক আনন্দের দিন। আমরা গোপালগঞ্জের মানুষ একটা সময় যখন লঞ্চ বা ফেরিতে আসতাম, আট-নয় ঘণ্টা লেগে যেত। ফেরির জন্য ১০-১২ ঘণ্টাও লেগে যেতে দেখেছি। সেইসময় পদ্মার যে গর্জন ছিল…একটা ভয় কাজ করত।”
মাসুদ বলেন, “আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ, প্রথম যাত্রার সাক্ষী হব, সেজন্য আমাদের আসা। আজকের জার্নিটা আমাদের কাছে খুবই এক্সাইটিং। পদ্মা সেতু হয়ে ট্রেনে যাব, এটা কখনও কল্পনায়ও ছিল না আমাদের।”
সকাল ৮টা ১৭ মিনিটে কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে গেছে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি। এর মাধ্যমে কমলাপুর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে প্রথমবারের মত যাত্রা শুরু হল বাণিজ্যিক ট্রেনের। সেই মহাক্ষণের সাক্ষী হতে ভোরের আলো ফোটার আগেই প্ল্যাটফর্মে ভিড় করেন রাসেল ও মাসুদের মত অনেকে।
ফেরির ঝঞ্ঝাট আর যানজটের ভোগান্তি ছেড়ে নিরাপদ এই রেল যাত্রা দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে পরম পাওয়া।
গত ৪ এপ্রিল প্রথমবারের মত পদ্মা সেতু অতিক্রম করে পরীক্ষামূলক ট্রেন। সেদিন একটি গ্যাং কার এবং তিন মাস পর গত ৭ সেপ্টেম্বর কমলাপুর থেকে যাত্রীবাহী ট্রেন পরীক্ষামূলকভাবে পদ্মা সেতু পাড়ি দেয়। এরপর গত ১০ অক্টোবর পদ্মা সেতুতে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর তিন সপ্তাহ পর শুরু হল বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল।
প্রমত্তা পদ্মা সাঁই করে পাড়ি দিয়ে মানুষ চলছে এক বছরের বেশি সময় ধরে; এবার সেই পথে খুলেছে নতুন দুয়ার। স্বপ্নের এ সেতু চালুর সঙ্গে সঙ্গে ঘুচেছে নদীতে ফেরি পারাপারের দীর্ঘ যুগের ভোগান্তি; জীবনযাত্রা আর অর্থনীতিতেও এসেছে গতি।
বৃহস্পতিবার পদ্মা সেতু হয়ে ট্রেনের প্রথমদিনের যাত্রী হতে সপরিবারে ফরিদপুর যান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে কর্মরত শরিফুল আলম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আগে বাসে যাইতাম, ফেরিতে যাইতাম, চার-পাঁচ ঘণ্টা তো ফেরিতেই কেটে যাইত। আর এখন যেভাবে বাসে যেতে পারছি, ট্রেনেও পারব। ট্রেনে যাওয়ার যে কী একটা আনন্দ, এইটা বইলা বোঝানো যাবে না।”
পরিবারের সঙ্গে ট্রেনে চেপে বাড়ি যেতে পেরে আনন্দিত শরিফুল আলমের মেয়ে শায়রা আলম।
মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এই শিক্ষার্থী বলেন, “পদ্মা সেতু হওয়ার আগে ভাবি নাই যে কোনদিন সেতু দিয়া যাইতে পারব। তারপর তো এইটা হইল। খুবই এক্সাইটিং। এই প্রথমবার ট্রেনে উঠতেছি, আমার আসলেই অনেক ভালো লাগতেছে।”
কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কিশোরগঞ্জের ওমর ফারুক বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকে যাতায়াত নিয়ে ভোগান্তির শেষ ছিল না। প্রথমবার ঢাকা থেকে ট্রেনে যাচ্ছি। এটা ব্যাখ্যা করা যাবে না যে কেমন ফিলিংস কাজ করতেছে। ওই অঞ্চলে কখনও ট্রেন যেতে পারে, এটা আসলেই অকল্পনীয়।”
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে অপেক্ষায় ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। সকালে ট্রেনে চেয়ে যাচ্ছিলেন কুষ্টিয়ার পোড়াদহে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “টিভিতে সবসময় খবর দেখতাম, ট্রেন আসবে। আমি অপেক্ষা করছিলাম, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ কখন আসবে। এই বয়সেও আমি ছুটে আসছি।”
এক যুগ ধরে ট্রেনের লোকোমাস্টার বা চালক হিসেবে কাজ করছেন আসাদুল ইসলাম। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে সুন্দরবন এক্সপ্রেস চালিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব পড়েছে তার ওপর।
কমলাপুর রেলস্টেশনে আসাদুল বলেন, “দক্ষিণাঞ্চলে ট্রেন চলবে শোনার পর থেকে আমার শখ ছিল পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে প্রথম ট্রেন চালানোর। আজ সেই জিনিসটা ঘটতে যাচ্ছে। এই অনুভূতিটা অন্যরম।”
কমলাপুর রেলস্টেশনের স্টেশন ম্যানেজার মো. মাসুদ সরওয়ার জানান, ট্রেনটিতে আসন সংখ্যা ৯০৮টি। প্রথমদিন শতভাগ যাত্রীই নিয়েই ছেড়ে গেছে ট্রেনটি।
ট্রেনটি ঢাকা থেকে ফরিদপুর, রাজবাড়ি, কুষ্টিয়া হয়ে খুলনার পথে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেন খুলনায় পৌঁছাবে বিকাল সাড়ে ৪টায়। অর্থাৎ মোট সময় লাগবে ৮ ঘণ্টার একটু বেশি। ফিরতি পথে ট্রেনটি খুলনা থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবে বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ৮টায়। কমলাপুর স্টেশনে এসে পৌঁছাবে শুক্রবার রাত ৩টা ৫০ মিনিটে।
এছাড়া বৃহস্পতিবার দুপুর ১টায় বেনাপোল থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবে এই রুটের দ্বিতীয় ট্রেন ‘বেনাপোল এক্সপ্রেস’। ট্রেনটি ঢাকায় এসে পৌঁছাবে রাত পৌনে ৯টায়। এরপর ঢাকা থেকে আবার বেনাপোলের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করবে রাত পৌনে ১২টায়।
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ডাকা অবরোধের শেষদিন এই ট্রেন যাত্রা ঘিরে বিশেষ নিরাপত্তা জোরদারের কথা জানান স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সরওয়ার।
তিনি বলেন, “যাত্রীদের কথা মাথায় রেখে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বিভিন্ন কর্মকর্তাদের নিয়ে বিশেষ সেলও গঠন করা হয়েছে। আমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও সতর্ক রয়েছে।”
আরও পড়ুন-
পদ্মার বুকে এবার রেলপথে যাত্রা