Published : 28 Jun 2023, 04:59 PM
ঢাকায় ডেঙ্গু রোগী বাড়ার মধ্যেই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, রাজধানীর ১৮ শতাংশ বাড়িতে এইডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি মিলেছে, যেখানে কোনো এলাকার ৫ শতাংশ বাড়িতে এই লার্ভা পাওয়া গেলে সেই পরিস্থিতিকে ধরা হয় ‘ঝুঁকিপূর্ণ’।
গত ১৮ থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত চালানো এক জরিপের এই তথ্যের ভিত্তিতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের ভাষ্য, এজন্য হাসপাতালের বিছানা বাড়িয়ে লাভ হবে না, প্রয়োজন ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা। সেজন্য ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা আর উদ্যোগ বাড়াতে হবে।
ডেঙ্গু এইডিস মশাবাহিত রোগ। এইডিস মশার লার্ভা থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা জন্মায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশি লার্ভা পাওয়ার অর্থ ঢাকায় এবার এইডিস মশাও বেশি পাওয়া যাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এ বছর ২৭ জুন পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭ হাজার ৭৫৪ জন, মৃত্যু হয়েছে ৪৭ জনের। বাংলাদেশে এর আগে জুন মাস পর্যন্ত কখনও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এত পরিমাণ রোগী হাসপাতালে ভর্তি ও মারা যায়নি।
জরিপে যা এসেছে
জাতীয় ম্যালেরিয়া ও এইডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় ১৮ থেকে ২৭ জুন জরিপ চালিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯৮ ওয়ার্ডে চালানো এই জরিপে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের বাহক মশার প্রজননস্থল শনাক্ত, পুর্ণাঙ্গ মশা ও লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপ ও ম্যাপিং করা হয়েছে।
জরিপের প্রথম আট দিনের তথ্যে দেখা গেছে, ২৫ জুন পর্যন্ত ঢাকার ২ হাজার ৫১১ বাড়ির মধ্যে ৪৫৩ বাড়িতে এইডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। আর ২ হাজার ৭৩৮টি পাত্রের মধ্যে ৬২৫টিতে পাওয়া গেছে এই লার্ভা।
ডিএনসিসির ৯৬২ বাড়ির মধ্যে ২১০টি বাড়ি এবং ৯৯৪টি পাত্রের মধ্যে ২৭৭টি পাত্র এবং ডিএসসিসি এলাকার ১ হাজার ৫৪৯টি বাড়ির মধ্যে ২৪৩টি বাড়ি এবং ১ হাজার ৭৪৪টি পাত্রের মধ্যে ৩৪৮টি পাত্রে মিলেছে এইডিস মশার লার্ভা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ঢাকা উত্তর সিটি এলাকার হাউজ ইনডেক্স ২১ দশমিক ৮, ব্রুটো ইনডেক্স ২৮ দশমিক ৭৯। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় হাউজ ইনডেক্স ১৫ দশমিক ৭, ব্রুটো ইনডেক্স ২২ দশমিক ৪৭।
মশার লার্ভার উপস্থিতি হিসাব করা হয় ব্রুটো ইনডেক্সের মাধ্যমে। জরিপে প্রতি একশ প্রজনন উৎসের মধ্যে ২০টি বা তার বেশিতে যদি এইডিস মশার লার্ভা বা পিউপা পাওয়া যায়, তাহলে সেটাকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ উপস্থিতি বলা যায়।
আর হাউজ ইনডেক্স পাঁচের বেশি হলে তাকে মশার ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ উপস্থিতি বিবেচনা করেন বিশেষজ্ঞরা।
এই জরিপে যুক্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডা. কবিরুল বাশার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হাউজ ইনডেক্স পাঁচের উপরে গেলেই বিপজ্জনক বলা হয়। সেখানে ঢাকায় ১৮ এর বেশি!
এ বছর ডেঙ্গু ছড়ানোর ঝুঁকি অন্য সময়ের চেয়ে বেশি জানিয়ে তিনি বলেন, “মাঠ পর্যায়ে এইডিস মশার ঘনত্ব বেশি পাচ্ছি। ডেঙ্গু রোগীও মওসুম শুরুর আগে থেকেই বাড়ছে। আমার কাছে মনে হয়, অগাস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে বড় একটা একটা আঘাত আসবে।”
গত ১৮ জুন থেকে জরিপ শুরু হওয়ার প্রতিদিন ২১টি দল বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনে যান। তিনজনের একেকটি দল নির্দিষ্ট এলাকার ১৫টি বাড়ি জরিপ করেন। এইভাবে প্রতিদিন ৩১৫টি বাড়ি পরিদর্শন করেন তারা। আবাসিক, নির্মাণাধীন, বহুতল ভবন, একতলা ভবন, খোলা জায়গা এবং বস্তিও রয়েছে জরিপে আওতায়।
জরিপকারীদের সঙ্গে ঘুরে অনেক বাড়িতেই এইডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি দেখা গেছে। গত ১৯ জুন ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের মগবাজার, দিলু রোড এবং ইস্কাটন এলাকার ১৫ বাড়ি জরিপ করে নয়টিতেই লার্ভার উপস্থিতি মেলে। সেদিন ৩১৫টি বাড়ি জরিপ করে ৭৪টি বাড়িতে এইডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়।
মঙ্গলবার গুলশানের ১৫ বাড়ির চারটিতেই এইডিস মশার লার্ভা খুঁজে পান জরিপকারীরা।
ওই এলাকার ১৩৬ নম্বর সড়কের ৭ নম্বর হোল্ডিংয়ের একটি বহুতল আবাসিক ভবনের নিচতলায় গিয়ে দেখা যায়, নিচতলার অংশ সাজানো গোছানো, পরিপাটি। জরিপকারীররা নিচতলায় রাখা ফুলের টবসহ বিভিন্ন পাত্র পরীক্ষা করেন। সেসব জায়গায় লার্ভা পাওয়া যায়নি। কিন্তু ওই বাড়ির সীমানা দেয়াল এবং ভবনের মাঝখানে রাখা প্লাস্টিকের ড্রামের ঢাকনার উপর সামান্য একটু পানিতেই লার্ভা দেখতে পান জরিপকারীরা। লার্ভাসহ ওই পানি সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য নিয়ে আসেন তারা।
এছাড়া ওই সড়কের ১৩ নম্বর বাড়ির এক কোণে উল্টো করে রাখা ফুলের টবের খাঁজে জমা পানিতে এইডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়।
বাড়ির মালিক নুরুন্নাহার রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাগানের কোথাও যেন পানি না জমে সে নির্দেশনা তিনি মালিকে দিয়েছেন। তবে দুদিন আগে সে ঈদের ছুটিতে গেছে। এ কারণে পানি জমে থাকতে পারে।”
এমন সামান্য পানিতেই লার্ভা হতে পারে, সেটি তার ধারণার বাইরে ছিল বলে জানান তিনি।
“আমি ডেঙ্গু নিয়ে সবসময়ই সতর্ক ছিলাম। কিন্তু এখানেই কীভাবে হয়ে গেল সেটাই আশ্চর্যের। এইডিস মশা থাকলে সেটা তো ভয়ের। আমি ওষুধ ছিটানোর ব্যবস্থা করছি। আর যেন কোথাও পানি জমতে না পারে সেদিকে নজর রাখছি।”
জরিপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, এবার এইডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, “১৫টি বাড়ি জরিপ করে নয়টি বাড়িতে লার্ভা পাওয়ার ঘটনা গুলশানেও আছে। আর আমরা প্রথম দিন ৩১৫ বাড়ির মধ্যে ৬০টি বাড়িতে লার্ভা পেয়েছিলাম। গুলশান-বনানীর অবস্থাও এবার ভালো না। এবার ব্রুটো ইনডেক্স ভালো না, যথেষ্ট খারাপ।”
করণীয় কী
এবার অন্য যেকোন সময়ের তুলনায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বেশি হবে, এমন আশঙ্কার সঙ্গে ডেঙ্গু প্রতিরোধে জোর দেওয়ার কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “রোগীর সংখ্যা যখন বাড়ে তখন কিন্তু ডেঙ্গুজনিত জটিলতা আনুপাতিক হারে বেড়ে যায়। আমরা যদি গুরুতর রোগী দেখতে না চাই, মৃত্যু দেখতে না চাই, তাহলে মশার প্রজননক্ষেত্র খুঁজে বের করে মেরে ফেলতে হবে।
“এছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার কাজটিও সমানে করতে হবে। নিজের বাড়ির আঙ্গিনা পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। তাহলে হয়ত আমরা এই মওসুমটা উৎরাতে পারব। নইলে সামাল দেওয়া যাবে না।”
এদিকে ঈদুল আজহার ছুটি ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলতে পারে বলে সতর্ক করেছেন অধ্যাপক কবিরুল বাশার।
তিনি বলেন, ঈদের সময় বাড়িতে ফেলে যাওয়া কোনো পাত্রে পানি জমে থাকলেই মশা জন্মাবে।
“ঈদের ছুটিতে এইডিস মশার ঘনত্ব বাড়বে। মানুষ ব্যস্ত থাকবে, ফলে টেক কেয়ার করতে পারবে কম। কেউ কেউ গ্রামের বাড়ি যাবে, বাসা পরিত্যক্ত হয়ে থাকবে। সব মিলিয়ে এইডিস মশার ঘনত্ব বাড়বে, পাশাপাশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীও বাড়বে।”
জানতে চাইলে ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিটি করপোরেশন সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। পাশাপাশি মানুষকেও সচেতন হতে হবে।
“এটা আমি বারবার বলছি সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে। তারা কীভাবে এগিয়ে আসবেন? তারা বাড়ির কোথাও তিনদিনের বেশি পানি জমতে দিবেন, ফেলে দিবেন।”
ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস মঙ্গলবার জাতীয় ঈদগাহ ময়দান পরিদর্শনে এসে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মানুষ সচেতন হচ্ছে না বলে জানান।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “মানুষ সচেতন হচ্ছে না। এজন্য ডেঙ্গু মশা নিধনে চিরুনি অভিযান চালাবে ডিএসসিসি। ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম আরও গতিশীল ও বেগবান করব এবং আমরা জরিমান করব।
“আমরা দেখছি অনেকেই দায়িত্ব পালন করছেন না এবং বেশির ভাগ মানুষই অসচেতন। সুতরাং জরিমানার কার্যক্রম আমরা চালিয়ে যাব ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে।”