ঢাবিতে পড়া অঞ্জনের চাকরি হবে, সেই অপেক্ষায় চা শ্রমিক মা

“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলাম। মা তখন কী যে খুশি হয়েছিলেন! কিন্তু ভর্তির সময় যত ঘনিয়ে আসছিল, মায়ের মুখটা তত মলিন দেখাচ্ছিল। চা-বাগানে কাজ করে যা পান, তা দিয়ে তো সংসারই চলে না। ভর্তির টাকা দেবেন কোথা থেকে,” লিখেছেন অঞ্জন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 August 2022, 03:04 PM
Updated : 19 August 2022, 03:04 PM

শুধু পেঁয়াজ, শুকনো ভাত, তেল আর লবণ; বহুদিন সেই ভাতও জোটেনি। প্রতিবেশীর দেওয়া কুমড়ো বা আলু সেদ্ধ খেয়ে দিন কেটেছে। কুপি বাতির তেল ফুরিয়ে গেলে পড়াও থমকে গেছে সন্তোষ রবিদাস অঞ্জনের।

মৌলভীবাজারের তরুণ অঞ্জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেছেন সম্প্রতি। তাকে বড় করে তুলতে, লেখাপড়া করাতে তার চা শ্রমিক মা কমলি রবিদাসের অক্লান্ত পরিশ্রম আর সীমাহীন ত্যাগের কথা তিনি লিখেছেন ফেইসবুকে।

নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের দুর্দশার কথা সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে উঠে এলেও আড়ালেই থেকে যায় চা শ্রমিকের মত অবহেলিত জনগোষ্ঠীর কথা। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এই মানুষেরা সম্প্রতি ধর্মঘটে নেমেছে, আর সেই সময়ে অঞ্জনের ওই ফেইসবুক পোস্ট আবেগতাড়িত করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের।

তার পাশে দাঁড়াতে অনেকেই দিচ্ছেন চাকরির প্রস্তাব। দিনে আট ঘণ্টা করে ১২০ টাকা মজুরিতে কি সংসার চলে চা শ্রমিকের? সেই প্রশ্নে সংহতি জানাচ্ছেন অনেকেই।

অঞ্জন শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তার ফেইসবুক পোস্ট দেখে ইউএনওর মাধ্যমে রোববার তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মৌলভীবাজারের ডিসি। চাকরির আশ্বাস পেলেও তা কেমন কাজ, সে সম্পর্কে নিশ্চিত নন তিনি।

আবুল খায়ের গ্রুপ, আনোয়ার গ্রুপ, ম্যাক্সনস গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানিও চাকরি প্রস্তাব দিয়েছে। এছাড়া ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম, এস এম জাকির হোসাইন, গোলাম রব্বানীও ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে জীবনবৃত্তান্ত নিয়েছেন বলে জানান অঞ্জন।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দেওয়া এ তরুণ বলেন, “আমার পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্কিত ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে আমরা ইন্টারেস্ট। মা কষ্ট করে বড় করছেন, সরকারি চাকরি পেলে তিনি খুশি হবেন।

“সেজন্য স্নাতকোত্তর শেষ করার পর বিসিএসসহ বিভিন্ন ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা দিয়েছি। প্রাইমারি পরীক্ষায় লিখিততে উত্তীর্ণ হয়ে মৌখিক পরীক্ষাও দিয়েছি। কিন্তু কোনোটারই ফল প্রকাশ হয়নি।”

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগরে কানিহাটি চা বাগানের এক শ্রমিক পরিবারে জন্ম সন্তোষ রবিদাস অঞ্জনের। জন্মের মাস ছয়েকের মাথায় বাবাকে হারান। সন্তানকে মানুষ করতে মা কমলি রবিদাস বৃদ্ধ বয়সেও চা বাগানে কাজ করেন। পরিবারে অঞ্জনের মা ছাড়া আর কেউ নেই।

চা বাগানের মাটির ঘর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের দালানে আসার পথ কতটা বন্ধুর ছিল তা উঠে এসেছে অঞ্জনের বয়ানে। ফেসবুকে তিনি লেখেন, বাবাকে হারানোর সময় তার মা মজুরি পেতেন দৈনিক ১৮ টাকা।

“সেই সময় আমাকে পটের দুধ খাইয়ে, অন্যের বাসায় রেখে মা যেতেন বাগানে কাজ করতে। ২০০৭ সালে আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। মায়ের মজুরি তখন ৮৮ টাকা। এক দিন বললেন, ‘বাজারে গিয়ে পাঁচ কেজি চাল নিয়ে আয়।’ সেই চাল দিয়ে এক মাস চলেছে আমাদের।

“পরদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে দেখি মা চাল ভাজলেন। পলিথিনে সেই ভাজা চাল, আটার রুটি আর লাল চা একটা বোতলে ভরে গামছায় প্যাঁচালেন। আর আমাকে আটার রুটি ও লাল চা দিলেন। দুপুরে খেতে গিয়ে দেখি শুধু পেঁয়াজ, শুকনা ভাত, তেল আর লবণ আছে। তা দিয়ে মেখে খেলাম। রাতেও কোনো তরকারি ছিল না।”

অঞ্জনের বর্ণনায়, “তখন পাশের বাসার কাকু আমাকে ডেকে কুমড়া আর আলু দিয়েছিলেন, যা দিয়ে আমরা দুইটা দিন পার করেছিলাম। তখন কুপি বাতির আলোয় পড়তাম। মা আগেই রেডি করে দিতেন বাতি। তেল শেষ হয়ে গেলে আর পড়া হতো না। দোকানদার বাকিতে তেল দিতেন না।

“পঞ্চম শ্রেণির পর ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন স্কুলে পাঁচ বছরের জন্য ফ্রি পড়ালেখার সুযোগ পাই। মা অনেক খুশি হয়েছিলেন।তখন তার সামান্য আয়ের একটা অংশ থেকে আমাকে টিফিন খাওয়ার জন্য প্রতি সপ্তাহে ৭০-৮০ টাকা দিতেন।”

দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে গত ৯ অগাস্ট থেকে প্রতিদিন দুই ঘণ্টার কর্মবিরতি শুরু করছিলেন লাখো চা শ্রমিক। ১৩ অগাস্ট থেকে শুরু হয় তাদের অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট।

চা শ্রমিকদের দাবি করা দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরিও জীবন ধারণের জন্য যথেষ্ট নয় মন্তব্য করে ১২০ টাকা মজুরিকে ‘শোষণের নিকৃষ্ট উদাহরণ’ বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। গত সোমবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “শোষণের শিকার চা শ্রমিকরা স্বপ্ন দেখার সাহসও হারিয়ে ফেলেছেন।”

সেই চা শ্রমিকের সন্তান অঞ্জন মায়ের মুখে হাসি ফোঁটানোর স্বপ্নই বুনছেন দুই দশক ধরে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ঢাকায় আসা এ তরুণ কষ্টগাঁথার কথা বলতে গিয়ে ফেইসবুকে লিখেছেন, “২০১৩ সালে বিএএফ শাহীন কলেজে ভর্তি হই। তখন মা ১০২ টাকা করে পেতেন। এই সময়ে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কিস্তি তুলে আমার ভর্তির টাকা, ইউনিফর্ম আর বই-খাতা কিনে দিয়েছিলেন।

“২০১৪ ডিসেম্বর। মায়ের হাতে টাকা নেই। তখন এইচএসসির রেজিস্ট্রেশন চলছিল। মা ৫০ টাকার একটা নোট দিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলেছিলেন, ‘কেউ ধার দেয়নি রে বাপ।’ কলেজের এক শিক্ষকের কাছ থেকে ধার নিয়ে সেবার রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়েছিলাম।”

সংকট যে কিছুতেই কাটছিল না, সে কথা তুলে ধরে অঞ্জন লেখেন, “এইচএসসির পর ভর্তি পরীক্ষার কোচিং। মা তখন আবার লোন নিলেন গ্রামীণ ব্যাংক থেকে। লোনের কিস্তির জন্য এই সময় মা বাড়ি থেকে অনেক দূরে গিয়ে বালু শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। বিনিময়ে পেতেন ৩০০ টাকা।

“আমি জানতাম ঘরে চাল নেই। শুধু আলু খেয়েই অনেক বেলা কাটিয়েছিলেন মা।এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলাম। মা তখন কী যে খুশি হয়েছিলেন! কিন্তু ভর্তির সময় যত ঘনিয়ে আসছিল, মায়ের মুখটা তত মলিন দেখাচ্ছিল। কারণ চা-বাগানে কাজ করে যা পান তা দিয়ে তো সংসারই চলে না। ভর্তির টাকা দেবেন কোথা থেকে?”

তখন স্থানীয়রা চাঁদা তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে সহায়তা করেছিল জানিয়ে তিনি লেখেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশনি করেই চলতাম। হলের ক্যান্টিনে ২০ টাকার সবজি-ভাত খেয়েই দিন পার করেছি। অনেক দিন সকালে টাকার অভাবে নাশতাও করতে পারিনি। দুর্গাপূজায় কখনও একটা নতুন জামা কিনতে পারিনি।”

সামাজিকভাবে বঞ্চিত হওয়ার কথাও তুলে ধরেন অঞ্জন। তিনি বলেন, “২০১৮ সালে শ্রেষ্ঠ মা হিসেবে উপজেলায় মাকে সম্মাননা দেওয়া হবে বলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জানানো হয়। পরে মায়ের নামটা কেটে দেওয়া হয়েছিল।

“খোঁজ নিয়ে জেনেছি, মা আমার চা শ্রমিক। স্টেজে উঠে নাকি কিছু বলতে পারবেন না। তাই নাম কেটে দিয়েছে!”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অঞ্জন সবে পড়াশোনা শেষ করেছেন, ছুটছেন চাকরির পেছনে; মায়ের হাসি মাখা মুখের প্রতীক্ষায় প্রহার কাটছে তার। এর মধ্যে চলছে কমলিদের আন্দোলন।

আবেগাল্পুত অঞ্জন লিখেছেন, “মা এখনও প্রতিদিন সকালে একটা বোতলে লবণ, চা-পাতা ভর্তা, আটার রুটি, সামান্য ভাত পলিথিনে ভরে নিজের পাতি তোলার গামছায় মুড়িয়ে নিয়ে দৌড়ান চা-বাগানে। আট ঘণ্টা পরিশ্রম করে মাত্র ১২০ টাকা মজুরি পান! এই মজুরিতে কিভাবে চলে একজন শ্রমিকের সংসার?

“আজকাল মায়ের শরীর আর আগের মতো সায় দেয় না। বলেন, ‘তোর চাকরি হইলে বাগানের কাজ ছেড়ে দেব।’ আমি এখন সেই দিনের প্রতীক্ষায় আছি...!”