গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি লোড শেডিং দিয়েও পরিস্থিতি সামলানো ‘যাচ্ছে না’ বলে জানিয়েছে ঢাকার দুই বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি- ডেসকো এবং ডিপিডিসি।
বৃহস্পতিবার রাজধানীতে কয়েকদফা লোড শেডিংয়ের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, সাম্প্রতিক অতীতে এত বেশি লোড শেডিং তারা দেখেননি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এভাবে লোডশেডিং চলার কারণে কারখানা বন্ধ রাখতে হলে অনেকগুলো খাত রুগ্ন হয়ে পড়বে।
এ বিষয়ে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড- ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাওসার আমীর আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিদিনই আমরা ভাবি যে, লোডশিডং একটু কমবে, কমবে। কিন্তু কমছে না।”
রাজধানীর মিরপুর, ক্যান্টনমেন্ট, গুলশান, বনানী, মহাখালী, উত্তরা, বাড্ডা, টঙ্গী ও পূর্বাচলসহ ঢাকা ও গাজীপুরের প্রায় ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ করে ডেসকো। ১১ লাখ গ্রাহক রয়েছে তাদের।
কাওসার আমীর আলী জানান, বিকেল চারটায় ডেসকো ১০১৮ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে ৭৫০ মেগাওয়াট সরবরাহ পেয়েছে। বন্ধ রাখতে হয়েছে ৮৫টি ফিডার।
তার মানে ডেসকোর ব্যাবস্থাপকদের ২৬৮ মেগাওয়াট অর্থাৎ ২৬ শতাংশ ঘাটতি ব্যবস্থাপনা করতে হয়েছে লোড শেডিংয়ের মাধ্যমে।
“গরম বেশি। চাহিদাও বাড়ছে। ম্যানেজ করতে আমাকে যথেষ্ঠ বেগ পেতে হচ্ছে,”- বলেন ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
“আমরা আশা করেছিলাম একবার করে লোড শেড দিব। খুব বেশি হলে দুইবার হতে পারে। কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় তিনবারও দিতে হয়েছে।”
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি-ডিপিডিসিও লোড শেডিংয়ের মাধ্যমে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় করছে।
কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান জানান, ডিপিডিসি ১৬৫০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে প্রায় ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাচ্ছে। এটা মেটাতে হচ্ছে লোড শেডের মাধ্যমে।
“গুমোট আবহাওয়া। এই পরিস্থিতিতে চাহিদাও বেড়ে গেছে।”
তবে শিল্পে সরবরাহ ঠিক রাখা হচ্ছে বলে জানান এই বিতরণ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
রাজধানী ঢাকার বেশিরভাগ এলাকাসহ নারায়ণগঞ্জের কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে ডিপিডিসি। এ কোম্পানির গ্রাহক প্রায় সাড়ে ১৫ লাখ।
এদিকে চাহিদা বাড়লেও জ্বালানি সরবরাহ কমিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ১২০০০ মেগাওয়াটের আশেপাশে রাখা হচ্ছে। এর ফলে একেক দিন একেক রকম ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।
গত ১৬ই এপ্রিলে দেশে একদিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল ১৪৭৮২ মেগাওয়াট।
বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ চাহিদা ১৪০০ হাজার ধরে লোড শেডিংয়ের পূর্বাভাস দেওয়া হয় ১৪০৯ মেগাওয়াট। বুধবার ১৩২২৬ মেগাওয়াট চাহিদা ধরে ১২০২ মেগাওয়াট লোড শেড দেওয়া হয়। মঙ্গলবার লোড শেড ছিল প্রায় ১৩০০ মেগাওয়াট।
দুর্ভোগে সাধারণ মানুষ
রাজধানীর মোহাম্মদুপরের মোহম্মাদীয় হাউজিং লিমিটেড এলাকায় বৃহস্পতিবার সকাল থেকে চারবার লোডশেডিং হয়েছে বলে জানালেন সেখানকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গত কদিনে আজকেই সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে। গতকাল দুই বার গিয়েছিল, এক ঘণ্টা করে। বাসায় ছোট বাচ্চা আছে, গরমে সবার অবস্থা কাহিল।”
মিরপুর শেওড়াপাড়ার একজন বাসিন্দা জানান, বুধবার রাত দুইটায় বিদ্যুৎ গিয়ে আসে এক ঘন্টা পর। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে অন্তত তিনবার লোড শেডিং হয়েছে।
মিরপুর-১২ নম্বরের ই-ব্লকে গত এক মাস ধরে প্রতিদিনই দুইবার করে বিদ্যুৎ চলে যায়। তবে গতকাল থেকে সেটা বেড়ে তিন থেকে চারবার হয়ে গেছে।
ওই এলাকায় বুধবার রাত ১২ টা থেকে ১টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ ছিল না। এছাড়া বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা থেকে ১২টা, বিকাল ৩টা থেকে সাড়ে ৩টা এবং সন্ধ্যা ৭টা থেকে আরও এক দফা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে।
সেখানকার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব ফরিদা বেগম বলেন, “একে তো প্রচণ্ড গরম। তার ওপর বিদ্যুৎ না থাকায় অনেক কষ্ট হয়ে যায়। দিনে গেলে এক কথা, এত রাতে বিদ্যুৎ গেলে তো ঘুমানোও যায় না। জানি না এই দুর্ভোগ শেষ হবে কবে?”
ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানি সংকটে পড়ে যায় বিশ্বের বহু দেশ। এ মাসের শুরুতে স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস আমদানি বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ। এতে ধাক্কা খায় বিদ্যুৎ উৎপাদন।
প্রায় শতভাগ বিদ্যুতায়নের কয়েক বছর পর দেশে ফিরতে শুরু করে লোড শেডিং। এরপর ১৮ই জুলাই থেকে প্রায় ১০০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হয়। এরপর লোড শেডিং আরও বাড়ে।
১৮ জুলাই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ঘোষণা দেন, সারাদেশে প্রতিদিন সূচি ধরে এক ঘণ্টা করে বিদ্যুতের লোড শেডিং শুরু হবে। এক সপ্তাহ এভাবে চলার পর ‘অবস্থা দেখে’ পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলেো জানান তিনি।
ওইদিনই বিভিন্ন বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি লোড শেডিংয়ের সূচি প্রকাশ করে। সেখানে এক ঘন্টার পাশাপাশি কোথাও কোথাও দুই ঘন্টাও লোডশেডিংয়ের সূচি প্রকাশ করা হয়। কিন্তু শুরু থেকেই ওই সূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
এক ঘন্টার জায়গায় লোড শেডিং পৌঁছেছে তিন থেকে চার ঘন্টায় এবং এক সপ্তাহ পার হলেও পরবর্তী সিদ্ধান্ত আসেনি।
সংকটে ব্যবসায়ীরা
দৈনিক কর্মঘণ্টার একটা বড় সময় লোড শেডিং থাকার কারণে সংকটে পড়ার কথা উঠে আসে বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই আয়োজিত এক আলোচনায়।
অনুষ্ঠানে পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মনসুর আহমেদ বলেন, “আমরা খুব সংকটের মধ্যে আছি। এলসিগুলো শিপমেন্টের একটা নির্ধারিত তারিখ রয়েছে।
“এভাবে লোডশেডিং হতে থাকলে, কারখানা বন্ধ রাখতে হলে আমরা অসুবিধার মধ্যে পড়ে যাচ্ছি। আমরা জানি সরকার শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।”
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, “ডিজেল ও এলএনজির দাম সমন্বয় করে হলেও যেন লোডশেডিং সমস্যার সমাধান করা হয়। জ্বালানির কারণে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি উত্তপ্ত হয় তাহলে ব্যবসা বাণিজ্যের আরও ক্ষতি হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ সিরামিকস ম্যানুফেকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক আজিজুল হাকিম বলেন, “সিরামিক শিল্পের মেশিনারিজগুলো ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হয়। এখানে ৩৬৫ দিন গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাগে।
কিন্তু গ্যাসের সংকটের কারণে প্রতিদিনই আমাদেরকে সুইচ অন অফ করতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের এই খাত রুগ্ন শিল্প হয়ে যাবে। এই পরিস্থিতিতে সিরামিক কিভাবে সারভাইব করবো সেই নির্দেশনা দরকার।
আরও খবর