লোড শেডিংয়ের সূচি সামলাতেও হিমশিম

ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়ায় বিদ্যুতের লোড শেডিং বেড়েছে ব্যাপক। আর তা বিদ্যুৎ বন্ধ রাখার সূচিও দিয়েছে এলোমেলো করে।

রিয়াজুল বাশারও ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 July 2022, 07:16 PM
Updated : 20 July 2022, 08:12 AM

সঙ্কটে পড়ে ডলার ধরে রাখতে মঙ্গলবার থেকে ডিজেলভিত্তিক আটটি কেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয় সরকার। এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার মেগাওয়াটের মতো।

এর আগে জুলাইয়ের শুরুতে স্পট মার্কেটের এলএনজি আমদানি বন্ধ করার পর গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটায় হারিয়ে যাওয়া লোড শেডিং ফিরতে শুরু করে।

এখন ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রও আপাতত বসিয়ে রেখে মঙ্গলবার থেকে উৎপাদন কমিয়ে প্রতিটি এলাকায় এক থেকে দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ না দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পরিকল্পনা নেয় সরকার।

যা জানিয়ে সোমবার সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেছিলেন, জ্বালানি স্বল্পতার এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট লোড শেড হতে পারে।

এরপর কয়েকটি বিতরণ কোম্পানি ঢাকা ও এর আশেপাশে কখন কোন এলাকায় বিদ্যুৎ থাকবে না, সেই সূচিও প্রকাশ করে। কিন্তু সরবরাহের পূর্বাভাসের সঙ্গে প্রাপ্তির মিল না থাকায় সেই সূচি ঠিক রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোকে।

দেশের একমাত্র বিদ্যুৎ সঞ্চালনকারী কোম্পানি-পিজিসিবি মঙ্গলবারে পূর্বাভাসে সর্বোচ্চ চাহিদা ধরে পিক আওয়ারে ১৪ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট এবং দিনের বেলায় চাহিদা ধরে ১২ হাজার ১০০ মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবির একজন কর্মকর্তা জানান, পিক আওয়ারের সর্বোচ্চ চাহিদা ১৪৪০০ মেগাওয়াটের বিপরীতে সর্বোচ্চ উৎপাদন ১২৪৮২ মেগাওয়াট ধরা হয়েছে।

এই হিসাবে লোড শেডিং হয় ১৯১৮ মেগাওয়াট। গত কয়েক বছরের মধ্যে এটাই দিনে সর্বোচ্চ লোড শেডিং।

পিডিবির ওই কর্মকর্তার হিসাবে, সোমবার সর্বোচ্চ ১৪৪০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছিল ১৩২৮১ মেগাওয়াট। তখন লোড শেডিং ছিল ১১১৯ মেগাওয়াট।

কিন্তু পিজিসিবির হিসাবে সোমবার লোড শেডিং দেখানো হয় ৭৮৫ মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎ সরবরাহের পূর্বাভাস ধরে নিজেদের গ্রাহকদের এলাকাভিত্তিক লোড শেডিংয়ের পরিকল্পনা সাজাচ্ছে বিতরণকারী সংস্থাগুলো। 

কিন্তু পূর্বাভাস অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ না হওয়ায় তাদের লোড শেডিংয়ের সেই সূচি এলোমেলো হয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছেন বিতরণ সংস্থা ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাওসার আমীর আলী।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা আজকের সূচি প্রকাশ করেছিলাম। কিন্তু আগামী কালকের লোড শেডিংয়ের তথ্য প্রকাশ করতে পারছি না।

“কারণ কী পরিমাণ লোড শেড হবে, পিডিবি তা নির্দিষ্ট করতে পারছে না। এজন্য আমরা যে শিডিউল করছিলাম, লোড শেড তার চেয়ে বেশি হয়ে যাচ্ছে।”

কাওসার বলেন, মঙ্গলবার ডেসকোকে ৮০ মেগাওয়াট লোডশেড দেবে বলে জানানো হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেছে লোড শেড দিয়েছে ১৫০ মেগাওয়াট।

“সন্ধ্যা ৬টা থেকে সাড়ে ৬টার মধ্যে দেড়শ মেগাওয়াটে উঠে যাওয়ায় আমরা আর শিডিউল মানতে পারিনি।”

ঢাকার শহরের উত্তর অংশসহ টঙ্গী, পূর্বাচলে প্রায় ১১ লাখ গ্রাহককে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ডেসকো।

পূর্বাভাসের তুলনায় বেশি বিদ্যুতের চাহিদা বেশি হওয়ায় লোড শেডিংয়ের সূচি মানা কঠিন হয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন আরেক সংস্থা ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ানও।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমাদের ১০০ মেগাওয়াট লোড শেড হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে সেটা ১২৫ মেগাওয়াটে পৌঁছে যায়।

“আমার জন্য খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে শিডিউল মেইনটেইন করা। বিপণি বিতানগুলো বন্ধ করে দেওয়ার জন্য আমরা লোক পাঠিয়েছি।”

প্রায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন নিশ্চিত করা আওয়ামী লীগ সরকার এই খাতকে তাদের সময়ে অন্যতম উন্নয়নের সাফল্য বলে প্রচার করে। গত এপ্রিল মাসে ১৪ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে।

পিজিসিবির হিসাবে, পহেলা জুলাই দেশে কোনো লোড শেডিং ছিল না। এর পরের দিন ছিল ৫০০ মেগাওয়াট। ৩ জুলাই একলাফে ১৫০০ মেগাওয়াট লোড শেডিং হয়, অর্থাৎ সেদিন চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল ১৫০০ মেগাওয়াট।

লোড শেডিং ৪ জুলাই থেকে কমতে শুরু করে এবং ঈদের আগের দিন অর্থাৎ ৯ জুলাই থেকে রোববার পর্যন্ত ৯ দিন ছিলই না।

বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় আমদানি বিল মেটাতে সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চাপ তৈরি হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।

আবার ডলার সঙ্কটের কারণে ব্যাংকগুলো তেল আমদানির জন্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের এলসি খোলার জন্য গড়িমসি করছে।

এই পরিস্থিতি সরকারকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে।

ডিজেল কেন?

বাংলাদেশ ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ৬৩ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি তেল আমদানি করেছে, যার মধ্যে ৭৩ শতাংশই ডিজেল।

দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ৩৪ শতাংশ তেলনির্ভর, যার মধ্যে ডিজেলে চলে ৬ শতাংশ এবং বাকি ২৮ শতাংশ ফার্নেস অয়েলনির্ভর।

দেশে আমদানি করা ডিজেলের সর্বোচ্চ ব্যবহারকারী পরিবহন খাত। আর বিদ্যুতে যায় ১০ শতাংশ।

কিন্তু এখন প্রতি লিটার ডিজেল আমদানির পর ৫০ টাকা লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন-বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ।       

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যদি এভারেজ ধরা হয়, গত জুন মাসে আমাদের প্রতি লিটারে ৫০ টাকার মতো লোকসান হয়েছে। ওই মাসে ১৫০০ কোটি টাকার মতো লোকসান হয়েছে।”

ভর্তুকির কারণে লোকসান গুণলেও ডিজেলের দামও আবার বাড়ানো সরকারের জন্য কঠিন। কারণ দেশের পরিবহণের ৯০ শতাংশই ডিজেলের উপর নির্ভরশীল।

তাই শুধু বিদ্যুতে ডিজেল সরবরাহ বন্ধ রেখে প্রতিমাসে ১৫০ কোটি টাকা সাশ্রয়ের পথ ধরেছে সরকার।

সোমবার সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, “বিদ্যুতের ১০ শতাংশ এবং অন্যান্য খাত থেকে আরও ১০ শতাংশ, মোট এই ২০ শতাংশ ডিজেল সাশ্রয় করতে পারলে যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা আমরা সেভ করতে পারব, এটা অনেক বড় বিষয় হবে।

“এ সিদ্ধান্ত আমরা না নিলে… সারাবছর এই ১০ শতাংশ ডিজেলের যে দাম দিই, সেই মূল্য তো আমরা বিদ্যুৎ থেকে পাব না। ডিজেল থেকে যে বিদ্যুৎ হয়, তা ৩৫ থেকে ৪০ টাকার মতো পড়ে প্রতি ইউনিট। বিদ্যুৎ বিক্রি করছি গড়ে প্রায় ৭ টাকায়।”

বিদ্যুতের বাইরে বাকি ১০ শতাংশ কীভাবে কমানো হবে- জানতে চাইলে বিপিসির চেয়ারম্যান বলেন, “সেটা এখন বলতে পারব না। পেট্রোল পাম্পের বিষয়টা চূড়ান্ত হযনি। আসলে কী কমবে, কতটুকু লাভ হবে, সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে বলা যাবে।”

লোড শেডিংয়ে কারণে জেনারেটরের ব্যবহার বাড়লে তাতেও ডিজেল খরচ বাড়বে।

তবে তা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন না বিপিসির চেয়ারম্যান আজাদ।

তিনি বলেন, “একটা কেন্দ্রের চাহিদার সঙ্গে জেনারেটরের চাহিদা মেলানোর যৌক্তিক কারণ নেই।

“জেনারেটর যে দু-চারজনের দরকার, তাদের আগেই আছে। লোড শেডিংয়ের সময় বিকল্প কোনো যন্ত্র যদি চালাতেই হয়, সেটা অন্যান্য সময়েও ছিল।”