আসামিপক্ষের আইনজীবীরা মামলার শুনানিতে মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘নোবেলজয়ী আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে বার বার।
Published : 01 Jan 2024, 07:20 PM
শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে মুহাম্মদ ইউনূসকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত বলেছে, এ মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান হিসেবে তার অপরাধের বিচার হয়েছে, নোবেলজয়ী ইউনূসের নয়।
ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা সোমবার এই রায়ে ইউনূসসহ চার আসামিকে ছয় মাসের কারাদণ্ডের পাশাপাশি জরিমানা করেছেন।
ইউনূস ছাড়া বাকি তিন আসামি হলেন- গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান এবং দুই পরিচালক নুরজাহান বেগম ও মো. শাহজাহান।
শ্রম আইনের ৩০৩ এর ৩ ধারায় তাদের প্রত্যেককে ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে, অনাদায়ে আরো ১০ দিনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
একই আইনের ৩০৭ ধারায় তাদের সবাইকে ২৫ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দিয়েছেন বিচারক।
তবে আপিলের শর্তে এক মাসের জামিন মঞ্জুর হওয়ায় আপাতত জেলে যেতে হচ্ছে না গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউনূসসহ চারজনকে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে এ মামলা করেন।
শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে নির্দিষ্ট লভ্যাংশ জমা না দেওয়া, শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী না করা, গণছুটি নগদায়ন না করায় শ্রম আইনের ৪-এর ৭, ৮, ১১৭ ও ২৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে।
চলতি বছরের ৬ জুন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক। বাদীসহ চারজনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে সোমবার রায় দিলেন তিনি।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, “আসামিপক্ষের আইনজীবীরা এক নম্বর আসামির (ইউনূস) বিষয়ে প্রশংসাসূচক বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তাকে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা নোবেলজয়ী আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব বলা হয়েছে।
কিন্তু এ আদালতে নোবেলজয়ী ইউনূসের বিচার হচ্ছে না, গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান হিসেবে বিচার হচ্ছে।”
বিচারক বলেন, “ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।”
যা যা হল রায়ের সময়
আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিজয় নগরের টাপা প্লাজায় শ্রম আদালত ও আশেপাশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। মোতায়েন করা হয় বিপুল সংখ্যক পুলিশ।
রায়ের খবর সংগ্রহ করতে দেশের বিপুল সংখ্যক সংবাদকর্মীর পাশাপাশি বিবিসি, আল জাজিরা, ডয়চে ভেলেসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিও উপস্থিত হন।
দুপুর ১ টা ৪৩ মিনিট ওই ভবনের পঞ্চম তলায় ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের এজলাসে উপস্থিত হন ৮৩ বছর বয়সী ইউনূস। ততক্ষণে পরিপূর্ণ হয়ে যায় এজলাস।
দুপুর সোয়া ২টা থেকে বিকাল সোয়া ৩টা পর্যন্ত ৮৪ পৃষ্ঠার রায়ের আংশিক পড়ার মধ্যেই বিচারককে কয়েক দফা থামিয়ে দেন ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন। রায়ে আসামিপক্ষের কোন কোন ডিফেন্স বক্তব্য ও যুক্তি কেন এল না এবং কেন এড়িয়ে যাওয়া হল, এ নিয়ে বিচারককে বার বার বলতে থাকেন তিনি।
উত্তরে বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা বলেন, “আপনি পুরোটা শুনে দেখেন। আপনার বক্তব্য তো পরবর্তীতে এসেছে। কোনো বক্তব্যই স্কিপ করা হয়নি।”
মামুন বলেন, “পরে এলে তা হবে না। পয়েন্টের মধ্যে আসতে হবে। আমি ১০৯টা কন্ট্রাডিকশন দিয়েছি। এগুলো তো আসতে হবে জাজমেন্টে। আমরতো কোনো ল ভায়োলেশন নাই। হোয়াটএভার দি জাজমেন্ট, এটাতো কোর্টের ব্যাপার। কিন্তু আমার এ বক্তব্যগুলি আসতে হবে। যেহেতু আমরা এত কস্ট করে আর্গুমেন্ট করেছি, আমার এ বক্তব্য বাদ যাবে!
“ইউনূসের বিরুদ্ধে কোনো ডিপোজিসন নাই। কোনো ডকুমেন্ট নাই। আমার বক্তব্য হচ্ছে, আমরা যে বক্তব্য দিয়েছি তা সে পয়েন্টগুলো জাজমেন্টের মধ্যে থাকতে হবে। শ্রম আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে উচ্চ আদালত বলেছেন, ক্রিমিনাল মামলার আগে সিভিল মামলা করতে হবে। আইনেও তাই আছে।”
এভাবে কিছু সময় পরপর বিচারকের রায় পাঠ থামিয়ে দিয়ে শুনানির বিভিন্ন বিষয় রায়ে প্রতিফলিত হয়নি বলে প্রশ্ন তুলতে থাকেন মামুন। রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী খুরশীদ আলম খান এ সময় কোনো কথা বলেননি।
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মুহাম্মদ ইউনূস সাংবাদিকদের বলেন, “যে দোষ করিনি, সেই দোষে শাস্তি পেলাম। এটাকে ন্যায়বিচার যদি বলতে চান, তাহলে বলতে পারেন।”
এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন জানিয়ে ইউনূসের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, “রাষ্ট্রপক্ষ কোনো কিছু প্রমাণ করতে পারেনি। আমরা ১০৯টি কন্ট্রাডিকশন দিয়েছি। একটা কন্ট্রাডিকশন দিলেই খুনির আসামিও খালাস পেয়ে যায়। অথচ ১০৯টা কন্ট্রাডিকশন দিয়েছি, ১০৫টা সাজেশন দিয়েছি, তারপরও এই রায়। আসলে ইউনূসকে শায়েস্তা করার জন্য এ রায়।”
অন্যদিকে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, “এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, বাংলাদেশে আইনের শাসন আছে। যে যত বড় হোক, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।”
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এই আইনজীবী বলেন, “আপনি যখন প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন শ্রম আইনের অধীনে, শ্রম আইন মানতে হবে। আপনি নোবেল লরিয়েট, তার মানে এটা না যে শ্রম আইন আপনি মানবেন না।”