৫০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো মত অবস্থানে নেই পিবিআই। তদন্ত কর্মকর্তা নিহত চিকিৎসকের স্বামীকে সন্দেহে রেখেছেন। কিন্তু জোরাল প্রমাণও নেই।
Published : 17 Feb 2024, 12:35 AM
কলাবাগানে নিজের ঘরে চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান লিপি হত্যার তদন্তে নেমে ঘূর্ণিপাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
স্থানীয় থানার হাতে কিছু দিন থাকার পর খুনের রহস্য উদঘাটনের দায়িত্ব পড়ে তদন্ত সংস্থা পিবিআইয়ের ওপর। কিন্তু আড়াই বছর পরেও সিদ্ধান্তে আসার মত কিছু বের করতে পারেনি তারা।
ফলে কারা, কেন সাবিরাকে খুন করেছে, সেই প্রশ্নের ধারেকাছেও যাওয়া যায়নি।
তদন্ত কর্মকর্তা নিহত চিকিৎসকের স্বামী সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা এ কে সামছুদ্দিন আজাদকে সন্দেহের কেন্দ্রে রেখে এগোতে চাইছেন। কিন্তু তাকে গ্রেপ্তার করে, রিমান্ডে নিয়েও ‘গুরুত্বপূর্ণ’ তথ্য মেলেনি। আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতেও তিনি রাজি হননি। কিছুদিন কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন আজাদ। এখনো তাকে ও তার গাড়িচালককেই সন্দেহে রেখেছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
আড়াই বছরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা পিবিআই বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক, গৃহকর্মী, ভাড়াটিয়া ও পাশের কক্ষের বাসিন্দা, সহকর্মী ও স্বজনসহ ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তবে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো মত অবস্থানে তারা নেই।
পিবিআই প্রধান অবশ্য দাবি করেছেন, তারা রহস্য উন্মোচনের ‘কাছাকাছি’।
শুরু থেকেই রহস্যে মোড়া
২০২১ সালের ৩০ মে কলাবাগান প্রথম লেইনের একটি বাড়ির চার তলার ফ্ল্যাট থেকে সাবিরার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ৪৭ বছর বয়সী এই চিকিৎসক গ্রীন লাইফ হাসপাতালে কাজ করতেন।
সাবিরার শরীরে ধারাল জখম এবং পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন পাওয়ার কথা পুলিশ জানিয়েছিল।
সাবিরা ওই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে দুজনকে ‘সাবলেট’ দিয়েছিলেন। তাদের একজন প্রথম সাবিরার লাশ দেখেন। অন্যজন বাসায় ছিলেন না।
সাবলেট নেওয়া সেই নারী পরে ভবনের দারোয়ানসহ কয়েকজনকে এনে দরজা ভেঙে ভেতরে যান।
তারা ঢুকে দেখতে পান, লিপি বিছানায় পড়ে আছেন এবং ঘরে ধোঁয়া। পরে ফায়ার ব্রিগেড এসে পানি ছিটিয়ে চলে যায়। পুলিশ বেলা ১২টার দিকে এসে তাকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কলাবাগান জোনের সহকারী কমিশনার শরীফ মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান সেদিন বলেছিলেন, “তার (সাবিরা) গলায় ও কোমরে গুরুতর জখম আছে। বিছানার জাজিম পোড়া দেখা গেছে এবং শরীরেও পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন রয়েছে।”
কিন্তু পুলিশ কোনো অস্ত্র পায়নি, খুনির আঙুলের ছাপ নেই কোথাও। এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, যিনি সন্দেহজনক কাউকে ভবনে ঢুকতে বা বের হতে দেখেছেন। সেই ভবনে নেই কোনো সিসিটিভি ক্যামেরাও।
এ ঘটনায় সাবিরার পাশের কক্ষের তরুণী, তার ছেলে বন্ধু এবং বাড়ির দারোয়ানকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। কিন্তু তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
সাবিরার মামাত ভাই রেজাউল হাসান জুয়েল কলাবাগান থানায় যে মামলা করেন, তাতে কাউকে আসামি করা হয়নি।
পুলিশের তদন্ত আগাতে থাকে সাবিরার স্বামীকে ঘিরে। তবে তাকে গ্রেপ্তার, রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাবাদে সন্দেহকে প্রমাণে পরিণত করার মত তথ্য মেলেনি।
থানা পুলিশ এই হত্যা রহস্য উন্মোচন করতে না পারার পর দায়িত্ব পায় পিবিআই। দায়িত্ব পড়ে পরিদর্শক জুয়েল মিয়ার ওপর। গণমাধ্যমকে সে সময় তিনি বলেন, ফরেনসিক প্রতিবেদনে এসেছে, প্রথমে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এরপর আগুন লাগানো হয়েছে। ওই আগুনে সাবিরার শরীরের ৭০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ৯টি কোপ দেওয়া হয়েছিল।
তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা জুয়েল মিয়া বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গলায় কাটা জখম ছিল। শরীরের আরো জখমের দাগ ছিল এবং কিছু অংশ পোড়া ছিল এবং এটি একটি হত্যাকাণ্ড ছিল।”
তদন্ত কর্মকর্তার ‘ভরসা’ সাবিরার স্বামীর ডায়েরি
২০২১ সালের ২২ অগাস্ট থেকে মামলাটির তদন্ত করছে পিবিআই।
সংস্থাটির পরিদর্শক মো. জুয়েল মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন পর্যন্ত তদন্তে সাবিরার স্বামী ও তার গাড়িচালকের মধ্যেই সন্দেহ ঘুরপাক খাচ্ছে। আরো কিছু পারিপার্শ্বিক তথ্য-উপাত্ত দরকার। তাই পিবিআই সময় নিতে হচ্ছে।”
এ চিকিৎসকের প্রথম স্বামী একজন চিকিৎসক ছিলেন। ২০০৩ সালে দুর্ঘটনায় তার মৃত্যুর দুই বছর আজাদকে বিয়ে করেন তিনি।
দুই সংসারে তার দুই সন্তান রয়েছে। তবে স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় সাবিরা আলাদা থাকতেন।
আজাদকে কেন সন্দেহ– এই প্রশ্নে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, “হত্যার পর সাবিরার স্বামীর কাছ থেকে একটি ডায়েরি উদ্ধার করা হয়। ডায়েরির তিন পাতায় স্ত্রীর বিরুদ্ধে মান-অভিমান ও ক্ষোভের বেশ কিছু লেখা ছিল।”
নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সাবিরার স্বামীকে ২০২২ সালের ১৯ এপ্রিল শান্তিনগরের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তিন দিন পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছিল।
তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, “অনেক প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গেছেন তিনি (আজাদ)। এরপর ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর হাই কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে বাইরে রয়েছেন।”
মামলার বাদী রেজাউল হাসান বলেন, “প্রথম প্রথম সাবিরার স্বামীকে সন্দেহ হয়নি। কিন্তু ডায়েরির ওই লেখা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেখার পর আমাদেরও সন্দেহ হচ্ছে। তবে পুলিশ এখনও কেন তদন্ত শেষ করতে পারছে তা বুঝতে পারছি না।”
তদন্ত কর্মকর্তার ভাষ্য, সাবিরা কলাবাগানে থাকলেও মাঝেমধ্যে গ্রিন রোডে মায়ের বাসাতেও থাকতেন। আজাদ থাকতেন শান্তিনগরে। তার গাড়িচালক সাইফুল শান্তিনগরের বাসা থেকে প্রতিরাতে তার নিজের বাসায় চলে যেতেন। কিন্তু ঘটনার রাতে আজাদের বাসাতেই ছিলেন সাইফুল।
“হত্যার রাতে সাবিরার স্বামীর গাড়িচালক সাইফুলের অবস্থান তাকেও সন্দেহের তালিকায় উপরের দিকে নিয়ে এসেছে,” বলেন তদন্ত কর্মকর্তা জুয়েল মিয়া।
সাবিরা-আজাদের সম্পর্ক কেমন ছিল
২০০৬ সালে সামছুদ্দিন আজাদের সঙ্গে সাবিরার বিয়ে হয়। তাদের একটি মেয়ে রয়েছে।
সাবিরার মামাত ভাই রেজাউল হাসান জানান, সাবিরার সঙ্গে বিয়ের আগে আজাদ আরও দুটি বিয়ে করেন। কিন্তু সাবিরার কাছে একটি বিয়ের কথা গোপন করেন।
“এখন বুঝতে পারছি অন্য একটি বিয়ের বিষয় সাবিরা জানার পরই তাদের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। বিয়ের পর থেকে সাবিরা কখনও স্থায়ীভাবে স্বামীর শান্তিনগরের বাসায় থাকেনি। কখনো শান্তিনগর আর কখনো গ্রিনরোডে মায়ের বাসায় থাকত। খুন হওয়ার দুই মাস আগে কলাবাগানের ওই বাসায় উঠেছিল সে।”
আলামত ‘নষ্ট’, তদন্তে ‘ভুল’
তদন্তের দায়িত্বে থাকা পিবিআই পরিদর্শক বলছেন, শুরুতে এই তদন্তে গাফিলতি হয়েছে।
তিনি বলেন, “অনেক আলামত নষ্ট হয়েছে। সেই কারণে হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শেষ করতে বিলম্ব হচ্ছে।”
পিবিআইয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একজন সাক্ষীর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়া হয়নি বলেই নতুন করে তদন্ত শুরু করতে হয়েছে। তাই সময় লাগছে। তবে এই খুনের রহস্য উদঘাটন করা যাবে।”
জবানবন্দি কেন নেওয়া হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ভুলটা তো সেখানেই হয়েছে। হয়ত পুলিশ একটু মানবিকতা বা দয়া দেখানোর কারণে নেয়নি। অথবা তখন সেভাবে ভাবতে পারেননি তখনকার তদন্ত কর্মকর্তা।”
তবে জুয়েল মিয়া বলেন, “বড় বড় অনেক মামলার চেয়েও বেশি এফোর্ট দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। আশা করছি শিগগিরই খুনের রহস্য রেব করতে পারব আমরা।”
বাদী হতাশ
সাবিরার মামাতো ভাই ও মামলার বাদী রেজাউল হাসান মজুমদার জুয়েল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পিবিআই অনেক জটিল ও ক্লুলেস মামলার রহস্য উদঘাটন করেছে। আমার বোনের খুনিকেও তারা ধরে ফেলবে ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন সত্যিই অনেক হতাশ। বলার মত কোনো অগ্রগতি নেই।
“কোনো রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি সংস্থাটি। এই ঘটনার সঙ্গে কে কে জড়িত আর কী পরিকল্পনায় এই হত্যাকাণ্ড, জানি না কোনো দিন আসবে সেই খবর।”
পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রহস্য উদ্ঘাটনের কাছাকাছি পর্যায়ে রয়েছি। সাবিরার স্বামী এখনও সন্দেহের মধ্যে রয়েছেন। তবে তিনি জামিনে। এখন পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য প্রমাণের অপেক্ষায় আছি আমি।”
বাদীর হতাশার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “হবে হবে। একটু পিছিয়ে আছি। তদন্ত আরো বেগবান করছি। আশা রাখছি রহস্য উদঘাটন করা যাবে।”
আজাদ কোথায়
পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া আজাদের দুটি মোবাইল ফোন নম্বরের একটিতে ফোন ধরেন এক নারী। তিনি নিজেকে নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা জানিয়ে বলেন, ছয় মাস আগে তার ছেলে সিমটি কিনেছে।
তিনি বলেন, এই নম্বরে অনেকেই ফোন করে আজাদ নামে একজনকে চায়।
অন্য নম্বরটিতে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলে সেই কলও ধরেন একজন নারী। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পরিচয় দিয়ে আজাদকে চাইলে তিনি বলেন, “তিনি (আজাদ) বাইরে আছেন। আসলে আপনার কথা বলব।”
‘বাইরে’ মানে দেশের বাইরে কি না- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “দেশেই আছেন”।
এরপর “আমি আপনাকে চিনি না, সুতরাং আর কোন কথা বলব না” বলে কল কেটে দেন ওই নারী।
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা জুয়েল মিয়া বলেন, “আজাদ জামিনে আছেন। পুলিশ পুলিশের মত করে তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।”
পুরনো খবর