বিস্ফোরণ গ্যাস থেকে হলে বাঁচার উপায় কী?

কাঠামোগত, সংস্কারগত নানা ত্রুটি থেকে ভবনে গ্যাস জমে, যা থেকে ঘটতে পারে বিস্ফোরণ।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 March 2023, 07:33 PM
Updated : 9 March 2023, 07:33 PM

ভবনের ভেতর থেকে ইট-কনক্রিট থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামগ্রী, এমনকি মানুষও ছিটকে এসে পড়েছিল সড়কে। এমনই প্রবল ছিল সিদ্দিক বাজারের ভবনটির বিস্ফোরণ।

এই বিস্ফোরণের উৎস ছিল কী- এই প্রশ্ন শুরু থেকেই ছিল। তবে তিন দিন চলে গেলেও এই প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর মেলেনি।

পরপর দুটি ভবনে বিস্ফোরণে নাশকতার সন্দেহ জেগেছিল কারও কারও মনে। সেজন্য বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষাও করা হয়। তবে নাশকতা নয়, এমনটাই নিশ্চিত করা হচ্ছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসায় বলেছেন, নাশকতার কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

তাহলে বিস্ফোরণ কী থেকে- এমন প্রশ্নে আবার নিশ্চিত করে তিনি কিছু বলতে পারেনি। তার উত্তর আসে- “আমাদের কাজ চলছে। আমরা সুনিশ্চিতভাবে বলতে পারব না, কী হয়েছিল।”

তাহলে কী থেকে হয়েছিল সেই বিস্ফোরণ, যাতে সাততলা একটি ভবনের নিচের দুই তলার ফ্লোর ধসে পড়ে, প্রাণ হারাতে হয়েছে ২২ জনকে।

পুরান ঢাকায় এর আগে চুড়িহাট্টা আর নিমতলীর ভয়াবহ আগুনের সঙ্গে রাসায়নিকের গুদামের সংযোগ থাকলেও সিদ্দিক বাজারে তেমন কিছুও পাওয়া যায়নি।

এই ভবনে তাহলে কী থেকে বিস্ফোরণ হতে পারে-তার একটা ধারণা দিয়ে বুয়েটের কেমি কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া বলেন, “এটাতে তো মার্কেটে। বাসা-বাড়ি, মার্কেট; সেখানে এক্সপ্লোশনের মতো তো কোনো জিনিস নেই। গ্যাস ছাড়া তো আমি কিছু দেখি না। নেচারাল গ্যাস, লিকেজ-এগুলো থেকে হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।”

সিদ্দিক বাজারের চার দশক পুরনো ভবনটিকে ‘কুইন স্যানিটারি মার্কেট’ নামে অনেকে চিনত, সেখানে স্যানিটারি দোকান-গুদাম ছিল। আর ছিল কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। উপরের তলাগুলোতে আবাসিক ফ্ল্যাটও ছিল।

এই গ্যাস বিস্ফোরণ এক হতে পারে পয়োবর্জ্য থেকে। সহকারী পরিচালক ওয়্যারহাউজ ও ফায়ার প্রিভেনশন মো. মানিকুজ্জামান বলেন, সেপটিক ট্যাংক থেকে ফসজিন গ্যাস সৃষ্টি হলে বিস্ফোরণ হতে পারে।

তিনি বলেন, “মাঝে মাঝে ট্যাংকিগুলো পরিষ্কার করা দরকার। অনেকে এটা করে না। তার কারণে বিষাক্ত গ্যাসটি তৈরি হয়। কোনো কারণে হাইলি ফ্লেমেবল কোনো কিছু এর সংস্পর্শে এলে দুর্ঘটনা ঘটে। পাওয়ার বিদ্যুৎ লাইন, গ্যাস লাইন কোনো কারণে লিকেজ হলে (বিস্ফোরণ) এমন হতে পারে। তবে এখানে (সিদ্দিক বাজারে) আসলে কী হয়েছে, তা তদন্তের পরই বোঝা যাবে।”

ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ বিভাগের একজন প্রকৌশলী জানান, বাসার নিচে তৈরি সেপটিক ট্যাংকের দুটি চেম্বার, কখনও তিনটি চেম্বার থাকে। টয়লেট থেকে সেই বর্জ্য পড়ে সেপটিক ট্যাংকে। ট্যাংকের ওপরে একটি পাইপ দেওয়া হয় গ্যাস বের হয়ে যাওয়ার জন্য। ট্যাংকের তরল বর্জ্য (ইফ্লুয়েন্ট) বের হয়ে যাবে সোকওয়েলে। সেপটিক ট্যাংকে জমে যাওয়া ময়লা বছর বছর সেটা পরিষ্কার করে দিতে হবে। এটাই সেপটিক ট্যাংকের প্রযুক্তি।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ও্ প্রকৌশলী বলেন, “গ্যাস বের হয়ে যাওয়ার জায়গা না থাকলেই সেখানে গ্যাস জমে যাবে, দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা তৈরি হবে। পুরান ঢাকার ওই ভবনটিতে সেপটিক ট্যাংক আছে কি না, থাকলে সেখান থেকে গ্যাস বের হওয়ার জায়গা রাখা হয়েছে কি না দেখতে হবে।”

তবে সেপটিক ট্যাংক থেকে বিস্ফোরণ এতটা বড় হবে না বলে মনে করেন অধ্যাপক সুলতানা রাজিয়া। “স্যুয়েরেজ থেকেও মিথেন গ্যাস বের হয়। সেটি খুব অল্প পরিমাণে। সেখানকার গ্যাস থেকে অত বড় ঘটনা সম্ভব না।”

তাহলে বাকি থাকল গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ কিংবা ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস লাইন থেকে গ্যাস বেরিয়ে জমে তা থেকে বিস্ফোরণ।

“এখানে গ্যাস লিকেজ, এলপিজি-ছাড়া আর কোনো কারণ দেখছি না,” বলেন রাজিয়া সুলতানা।

Also Read: চুড়িহাট্টা থেকে সিদ্দিক বাজার: ঝুঁকি জেনেও উদাসীন সবাই

Also Read: সিদ্দিক বাজারের ভবনটির এখন কী হবে?

Also Read: ‌ঢাকা শহর এখন ‘বিস্ফোরণোন্মুখ’

তবে যেহেতু ভবনটিতে তিতাসের পাইপলাইন সংযোগ ছিল, ফলে সেখানে এলপিজি সিলিন্ডারের প্রয়োজন ছিল না।

সেক্ষেত্রে গ্যাসলাইন থেকে কোনোভাবে গ্যাস লিকেজ হয়ে জমেই এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে মনে করেন কেমি কৌশলের অধ্যাপক সুলতানা রাজিয়া, রাসায়নিক নিয়ে যার কাজ।

দুই বছর আগে মগবাজারে ভবনে বিস্ফোরণের নজির দেখিয়ে তিনি বলেন, প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “মগবাজারের বিস্ফোরণটা যেটা হলো সেটা জমে থাকা, লাইনের গ্যাস যেটা আমরা রান্নার জন্য ব্যবহার করি, নেচারাল গ্যাস থেকে।”

কেন এখন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে গ্যাস, তার জন্য ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ত্রুটিকেই দায়ী করেন তিনি

“আগেকার বাড়িঘর বড় ছিল খোলামেলা, সেখানে গ্যাস লিক করলেও জমে থাকার সুযোগ ছিল না। এখন বাড়িঘরগুলো বদ্ধ, রান্নাঘর বন্ধ থাকে, গ্যাস লিক হলে বের হওয়ার সুযোগ থাকে না। এ জিনিসগুলো কঠিন করে ফেলছে অবস্থা।”

পুরান ঢাকার ভবনগুলো একটি আরেকটির গা ঘেঁষে উঠেছে। সামনে-পেছনে ফাঁকা জায়গা থাকে না বললেই চলে। সিদ্দিক বাজারের ভবনটিও একই রকম।

এই ভবনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গঠিত রাজউকের কমিটির সদস্য বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলছেন, “এটা একদিনে ঘটেনি, অনেক দিন ধরে পুঞ্জীভূত গ্যাস। তার মানে গ্যাস সাপ্লাই সিস্টেমে ত্রুটি আছে, গ্রাউন্ডফ্লোরে শো রুমে কোনো না কোনোভাবে গ্যাস জমেছে। ভ্যান্টিলেশনে গলদ আছে।”

উদ্ধার কাজে যুক্ত থাকা পুলিশও বিস্ফোরণের উৎস হিসেবে একই ধারণার কথাই বলেছে। ডিএমপির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সিদ্দিক বাজারের ভবনটির ভূগর্ভস্থ তলায় কাচঘেরা বদ্ধ দোকান স্থাপন করা হয়েছিল। বিস্ফোরণটি সেখানেই হয়েছিল। গাড়ির পার্কিংয়ের জন্য নির্ধারিত এই ভূগর্ভস্থ তলাটি খোলামেলা থাকলে এমন ঘটনা ঘটত না।

পয়োবর্জ্য থেকে বায়োগ্যাসে, না কি গ্যাসের লাইনের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেনি পুলিশ।

ভবনটির বেইজমেন্টে এক সময় রান্নাঘর এবং একতলায় খাবারের হোটেল ক্যাফে কুইন ছিল জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই রান্নাঘরে কমার্শিয়াল গ্যাসের বড় লাইন ছিল,যা পরে লিখিতভাবে তিতাসের কাছে সারেন্ডার করা হয়। কিন্তু বাড়ির অন্যান্য ফ্লোরের লাইন এখনও চলমান। ফলে এই লাইন সম্পূর্ণ বন্ধ না হয়ে সেখান দিয়েও তিতাস গ্যাস লিক হতে পারে। কোনোভাবে জমা গ্যাসে স্পার্কের মাধ্যমে বিস্ফোরণের হতে পারে।

সেখানে দোকানগুলোতে অনেক শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ছিল উল্লেখ করে, সেখান থেকে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে কি না, তা খতিয়ে দেখার উপরও জোর দিচ্ছে পুলিশ।

“এসিগুলোকে সময়ে সময়ে সার্ভিসিং না করালে বা ত্রুটিপূর্ণ থাকলে তা থেকেও বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে, যেটা ২/৩ বছর আগে গুলশানে আরব আমিরাতের ভিসা সেন্টারে ঘটেছিল।”

বাঁচার উপায় কী?

সিদ্দিক বাজারের ভবনটিই শুধু নয়, তার দুই দিন আগে ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরির পাশে মিরপুর সড়কের শিরিন ম্যানশন নামে একটি তিন তলা ভবনেও বিস্ফোরণ ঘটে। সেখানে বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে জমে থাকা গ্যাসকে কারণ মনে করা হচ্ছে।

বুয়েটের অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা বলছেন নিয়মিত তদারকির কথা। “বিদেশেও বাসা-বাড়ি মার্কেটে এমন ঘটনা ঘটছে, কমিয়ে এনেছে তারা। আমাদের এটা কমানোর একমাত্র রাস্তাই হচ্ছে যে (গ্যাসের) লাইন ঠিক রাখা, দেখা, চেক করা। বারবারে দেখা যে এগুলো ঠিক আছে কিনা। আর কোনো ইজি রাস্তা নেই।”

গ্যাস লিকেজ হলে যেন ধরা যায়, সেজন্য প্রাকৃতিক গ্যাসে গন্ধ যুক্ত করার কথাও বলেন কেমি কৌশলের এই অধ্যাপক।

তিনি বলেন, “আগে গ্যাসের সঙ্গে গন্ধ মিক্সড হত, গ্যাস লিকেজ হলে আমরা গন্ধ পেতাম। এখন সেটা পাই না। গন্ধ না থাকার কোনো কারণ থাকতে পারে। ওই গন্ধটা আমাদের জন্য ক্ষতিকর না। তারপরও বলব-গন্ধ পেলে এলার্ট হওয়া যায়।”

ঘরে যদি গ্যাস থেকে যায়, গন্ধ পাওয়া যায়, তাহলে আগুন জ্বালানোর মতো কাজ কখনোই না করার পরামর্শ দেন তিনি।

পুরান ঢাকার মতো এলাকায় আগুন লাগলে কী করতে হবে, তা নিয়ে মহড়া আয়োজনের সুপারিশও করেন তিনি।

ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার দিকটি দেখিয়ে বুয়েটের পুর কৌশলের অধ্যাপক ড. মেহেদী বলেন, “বিস্ফোরণ একটা, দুটো দেখছি, এটা তো আমরা লাকি, একসঙ্গে অনেক হওয়ার কথা।

“তাই আমাদের এখনই শুরু করতে হবে মেইনটেইন্সে আর চেকিং। অন্যান্য দেশে প্রতি পাঁচ বছর পর পর বিল্ডিং রি-চেক করে। কারণ, বিল্ডিং আবাসিক হওয়ার কথা, কিন্তু কমার্শিয়াল ইউজ করেছে। একটি বাসায় একটা এসি থাকার কথা, বাস্তবে পাঁচটা এসি ব্যবহার করা হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “সিদ্দিক বাজারের বাসাটায় দেখলাম, তাকে কোনো ভেন্টিলেশন নেই গ্রাউন্ডফ্লোরে। যেখানে বিস্ফোরণটা ঘটেছে আন্ডারগ্রাউন্ডে, সেখানে গ্যাস যদি জমেও থাকত ভেন্টিলেশন থাকলে বের হয়ে যেত।”

ভবনগুলোতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়মিত তদারকির উপর জোর দিয়ে রাজউকের কারিগরি কমিটির সদস্য ড. মেহেদী বলেন, “শাখারীবাজারের বিল্ডিং, চুড়িহাট্টার ওয়াহিদ ম্যানশন, নিমতলীর ঘটনা-প্রত্যেকটা তো রিপিট হচ্ছে।

“বছর বছর ধরে কোনো ধরনের কম্পায়েন্স আনবে না, বিল্ডিং চেক করা হবে না, তাহলে তো ঘটনা ঘটবেই।

তিনি বলেন, “ভবনের ভেতরে তিনটা জিনিস- কাঠামো, ফায়ার ও ইলেকট্রিক সিস্টেম, আরেকটা সার্ভিসেস- গ্যাস সাপ্লাই, প্লাম্বিং (পয়নিষ্কাশন) এসব চেক করতে হবে। রি সার্টিফিকেশন করতে হবে। এটা করলে বের হয়ে আসতে পারব আমরা।”

রাজউকের সমালোচনা করে এই বুয়েট শিক্ষক বলেন, “কোনো ভবনকে আমরা কোনোদিন কমপ্লায়েন্সের আন্ডারে প্রতি পাঁচ বছর পর পর রি-সার্টিফিকেশন করি না। রাজউকের ম্যান্ডেট রয়েছে-যে কোনো বিল্ডিংয়ে উঠার আগে অকুপেন্সি সার্টিফিকেট হ্যান্ডওভার করতে হয় রাজউককে।

“ঢাকায় ৬ লাখ বিল্ডিং রয়েছে, পাকা দালন রয়েছে; মাত্র একশটার অকুপেন্সি সার্টিফিকেট দিয়েছে। তার মানে রাজউক এটা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। চেক করতে ব্যর্থ হচ্ছে।”