তসলিমার ভাষ্য, “মাথায় ব্যথা পেয়ে এসেছিলাম চিকিৎসার জন্য, আমার মাথাটা কেটে নেওয়া হয়েছে। সার্জনদের যুক্তি হলো, মাথা ফেলে দিলে মাথা ব্যথা করবে না।”
Published : 19 Jan 2023, 11:35 AM
ভারতে বসবাসরত বাংলাদেশে নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিনের হাসপাতালে ভর্তির কারণ জানা গেল অবশেষে; পড়ে গিয়ে পায়ের হাড় ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। এরপর অস্ত্রোপচার করে তার ‘হিপ জয়েন্টই’ বাদ দিয়েছেন চিকিৎসক।
চিকিৎসা শাস্ত্রে লেখাপড়া করা তসলিমার অভিযোগ, সার্জনের ‘ভুল’ সিদ্ধান্তে আজ তিনি পঙ্গু হতে চলেছেন।
ফেইসবুকে এক দীর্ঘ পোস্টে এই লেখক জানিয়েছেন, অস্ত্রপচার-পরবর্তী জীবনে চলাফেরার জন্য চিকিৎসক বেশ কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন। আর ‘হিপ রিপ্লেসমেন্টে বাধ্য করায়’ চিকিৎসকের ওপর ক্ষুব্ধ তিনি।
সেই চিকিৎসক বা হাসপাতালের নাম লেখেননি তলসিমা। তার ভাষ্য, চিকিৎসক শুরুতেই ‘হিপ রিপ্লেসমেন্ট’ চিকিৎসায় না গেলেও পারতেন।
“মাথায় ব্যথা পেয়ে এসেছিলাম চিকিৎসার জন্য, আমার মাথাটা কেটে নেওয়া হয়েছে। সার্জনদের যুক্তি হল, মাথা ফেলে দিলে মাথা ব্যথা করবে না।“
এর আগে রোববার ফেইসবুকে তসলিমার পোস্ট করা হাসপাতালের দুটি ছবি থেকে জানা যায়, তিনি অসুস্থ। তবে কী অসুখে তাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছে, সেখানে তা স্পষ্ট ছিল না।
বুবধার তসলিমা জানালেন ‘হাসপাতাল বাসের’ কারণ। তিনি লিখেছেন, “হাসপাতালের বেডে আমার শুয়ে থাকার ছবি দেখে অনেকে ভেবেছে আমার বোধহয় হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হয়েছে। না, সেসব কিছুই হয়নি।
“সেদিন ওভারসাইজ পাজামা পরে হাঁটছিলাম ঘরে, পাজামা চপ্পলে আটকে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম। অগত্যা যা করতে হয়, করেছি। হাঁটুতে ব্যথা হচ্ছিল, আইস্প্যাক দিয়েছি, ভলিনি স্প্রে করেছি।”
তসলিমা ভেবেছিলেন, হয়ত হাঁটুর লিগামেন্টে চোট লেগেছে। এক্সরে করার জন্য এরপর তিনি যান হাসপাতালে। কিন্তু এক্সরে আর সিটিস্ক্যান করে ডাক্তার জানালেন, পায়ের ফিমারে চিড় ধরেছে।
এই লেখক জানান, শুরুতে দুই ধরনের চিকিৎসার পরামর্শ এসেছিল চিকিৎসকের কাছ থেকে।
“প্রথম অপশান ইন্টারনাল ফিক্সেসান, ফাটলের জায়গাটা স্ক্রু লাগিয়ে ফিক্স করে দেবেন। দ্বিতীয় অপশান হিপ রিপ্লেসমেন্ট, আমার হিপ কেটে ফেলে দিয়ে কিছু প্লাস্টিক মেটাল দিয়ে একটা নকল হিপ বানিয়ে দেবেন। আমি তো প্রথম অপশানই নেব, যেটি সত্যিকারের ট্রিটমেন্ট।“
একসময়ে চিকিৎসক পেশায় কাটানো তসলিমার ইচ্ছে ছিল ফিমারে (উরুর হাড়) অস্ত্রপচার করানো। কিন্তু চিকিৎসক রাজি ছিলেন না।
“বললেন ফিক্সেশানে সবসময় ফিক্স হয় না, ৮০% কাজ হয়, কিন্তু ২০ % ফেইল করে। আমি বললাম, 'দেখা তো যাক ফিক্স হয় কিনা, হয়তো হবে।' সার্জন বললেন, 'ফিক্স না হলে কিন্তু ওই হিপ রিপ্লেসমেন্টেই যেতে হবে।'
এরপর হাসপাতালে ভর্তি হন তসলিমা নাসরিন, তখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত ছিল পায়ে ‘ফিক্সেশান’ করা হবে। কিন্তু অপরানেশন কক্ষে যাওয়ার আগে সিদ্ধান্ত বদলানোর কথা বলেন চিকিৎসক।
“আচমকা সার্জন এসে বললেন, 'শুনুন, হিপ রিপ্লেসমেন্ট ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। করলে ওটাই করব। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ফিক্সেশান আপনার কাজ করবে না, আপনার জন্য হিপ বদলানোই বেস্ট।' আমি সেকেন্ড অপিনিয়নের জন্য সময় চাইলাম। সার্জন খুশি হলেন না। বললেন, অপারেশান এক্ষুনি না করলে প্রব্লেম, ইনফেকশান হয়ে যাবে, এটা সেটা।“
ওই হাসপাতালে তসলিমার চেনা আরও দুজন চিকিৎসকও তাকে শল্য চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে নিতে ‘চাপ’ দেন, যেহেতু তসলিমার চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা সার্জন একজন ‘বড় সার্জন’।
“অগত্যা আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে রাজি হতে বাধ্য হতে হল। তারপর কী হলো, আমার হিপ জয়েন্ট কেটে ফেলে দিয়ে টোটাল হিপ রিপ্লেসমেন্ট করা হলো। একটা পঙ্গু মানুষের জীবন আমাকে দেওয়া হলো।“
অস্ত্রপচার শেষে সংজ্ঞা ফেরার পরের অবস্থা বর্ণনা করে তসলিমা লিখেছেন, “চেতন ফিরলে ব্যাপারটার আরও ভেতরে গিয়ে দেখলাম, যাদের হিপ জয়েন্টে প্রচণ্ড ব্যথা, বছরের পর বছর হাঁটতে বা চলতে ফিরতে পারে না, হিপ জয়েন্ট যাদের স্টিফ হয়ে গেছে জয়েন্টের রোগে, রিউমাটয়েড আর্থাইটিস, জয়েন্টে টিউমার বা ক্যান্সার- তাদের, সেই অতি বয়স্ক মানুষদের, টোটাল হিপ রিপ্লেসমেন্ট করা হয়, কিছুদিন জয়েন্টের যন্ত্রণা কমিয়ে হাঁটা চলা করতে যেন পারে।
“আমি ছিলাম এক্সারসাইজ করা প্রচণ্ড অ্যাক্টিভ মানুষ, সাইক্লিং, সুইমিং, ট্রেড মিল করছি, দৌড়োচ্ছি। শরীর থেকে ডায়বেটিস, ব্লাড প্রেশার, ফাইব্রোসিস উবে গেছে। সেই আমাকে সান্ত্বনা দেওয়া হচ্ছে, চিন্তার কিছু নেই, তুমি হাঁটতে পারবে।”
কী কী নিয়ম মেনে চলতে হবে তাও লিখেছেন তসলিমা। চিকিৎসক তাকে বলেছেন, “কমোডে বসতে পারবে না, উবু হতে পারবে না, পায়ের ওপর পা রাখতে পারবে না, ওজন বহন করতে পারবে না, নরমাল চেয়ারে বসতে পারবে না, শুরু হলো হাজারো রেস্ট্রিকশান।“
তসলিমার প্রশ্ন, “এ কেমন জীবন আমাকে দেওয়া হলো! এই পঙ্গু জীবন পেতে কি আমি প্রাইভেট হাসপাতালে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে চিকিৎসা করতে এসেছিলাম! “
তার অভিযোগ, চিকিৎসক তাকে ভয় দেখিয়ে এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে এনে ‘অন্যায় করেছেন’।
“যখন বুঝলাম ডাক্তার ভীষণ অন্যায় করেছেন, আমাকে ভুল কথা বলে, ভয় দেখিয়ে আমার হিপ কেটে নিয়েছেন, আমি জিজ্ঞেস করেছি, যে কারণে হিপ রিপ্লেসমেন্ট করা হয়, তার একটি রোগও আমার ছিল না, আমার জয়েন্টে কোনও ব্যথা ছিল না, কোনও আরথ্রাইটিস ছিল না, নেক ফিমারের ফিক্সেশান করতে গিয়ে হিপ জয়েন্ট কেটে কেন ফেলে দিলেন?
“বললেন তার (সার্জন) নাকি মনে হয়েছে ফিক্সেশান কাজ করবে না। কত পার্সেন্ট কাজ করে না? ২০%। কেন মনে হয়েছে আমি সেই ২০% এর মধ্যে পড়ি, ৮০% এর মধ্যে পড়ি না? একবার ট্রাই করে দেখা উচিত ছিল না? তার উত্তর, ‘ফিক্সড না হলে আবার অপারেশান করতে হতো, সেই ঝামেলায় না গিয়ে পরে যেটা করতে হবে, সেটা আগেই করে দিলাম। আমেরিকানরা অল্প অল্প করে এগোয়, আমরা একটু এগ্রেসিভ, আমরা আগেই শেষটা করে দিই।’ কিন্তু অপারেশানের দিন তো বললেন, অন্য কোনও অপশান নেই হিপ রিপ্লেসমেন্ট ছাড়া! উত্তর নেই। “
তসলিমা লিখেছেন, চিকিৎসক তাকে শেষ পর্যন্ত পরামর্শ দিয়েছেন, তিনি যেন আরেকটু ‘পজিটিভ’ভাবে বিষয়টি নেন।
“পঙ্গু জীবন নিয়ে ঠিক কী করে পজিটিভ হওয়া যায়, সেটা বুঝতে পারছি না।“
পুরনো খবর: