ভাস্কর চলে গেলেন, ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ রক্ষণাবেক্ষণে কি অর্থ মিলবে?

শামীম সিকদারের তৈরি ১১৬টি ভাস্কর্যের বেশিরভাগে নামফলক বা পরিচিতি না থাকায় সেগুলো বুঝতে এখনই অসুবিধা হচ্ছে দর্শনার্থীদের।

রাসেল সরকারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 March 2023, 07:08 PM
Updated : 21 March 2023, 07:08 PM

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ফুলার রোডের শেষ প্রান্তে গেলেই চোখে পড়বে ত্রিভুজ আকৃতির একটি সড়ক দ্বীপ, যেখানে শ্বেতবর্ণের সারি সারি আবক্ষ ভাস্কর্য ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ ভাস্কর্য।

পরিসরের দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভাস্কর্য হিসেবে পরিচিত এই ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে ধারণ করছে। তার চারপাশে দেশ-বিদেশের শতাধিক ব্যক্তির ভাস্কর্য প্রতিনিধিত্ব করছে বিশ্বের মুক্তিকামীদের।

অযত্ন অবহেলায় দীর্ঘদিন ধরে বেহাল পড়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্য। সম্প্রতি ভাস্কর শামীম সিকদার দেশে এসে সেগুলোর মেরামত ও রং করায় নতুনত্ব ফিরে পেয়েছে ভাস্কর্যগুলো, যিনি গত হয়েছেন মঙ্গলবারই।

Also Read: ভাস্কর শামীম সিকদার আর নেই

সবুজ-শ্যামল দৃষ্টিনন্দন চত্বরটির পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে যে কাউকে তা কৌতূহলী করে তোলে, অনেককে ছবি তুলতে দেখা যায়। তবে ভাস্কর্যটি সম্পর্কে জানেন না অনেকেই।

স্ত্রীকে নিয়ে সাভার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে এসেছেন শাহরিয়ার আলম। স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্য চত্বরের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের ছবি তুলতে দেখা গেল।

আলাপচারিতায় তারা জানালেন, বঙ্গবন্ধু, শেরে বাংলাসহ বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে সাধারণ মানুষদের ভাস্কর্য তাদের নজর কেড়েছে।

শাহরিয়ার বললেন, “এত বিশাল ভাস্কর্যের মহত্ব বা বিশেষত্ব কী- আমাদের জানা নেই। তবে এখানে একটা বিষয় আমাদের নজড় কেড়েছে। সেটা হলো- এখানে প্রাকৃতজন থেকে শুরু করে বিশ্ব বিখ্যাতদের ভাস্কর্য স্থান পেয়েছে। এ যেন অনেক গুণী মানুষদের মহামিলন মেলা।”

দর্শনার্থীদের জন্য প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এবং ছুটির দিনগুলোতে সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এ ভাস্কর্য চত্বরটি খোলা থাকে। দর্শনার্থীরা বিনামূল্যে ভাস্কর্য চত্বরে প্রবেশ করতে পারেন, ফলে প্রতিদিনিই দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়ছে।

বান্ধবীদের নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্য চত্বরে ঘুরে দেখছিলেন ঢাকার একটি কলেজের শিক্ষার্থী ফারহানা তাবাচ্ছুম।

তিনি বললেন, “আমরা মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে এসেছি। এই দিক দিয়ে যাওয়ার পথে ভাস্কর্যগুলোতে চোখ আটকে গেল। এক সাথে এতগুলো ভাস্কর্য কোথাও দেখি নাই। তাই অনেকগুলো ছবি তুলে নিলাম।

“এখানে দেশ-বিদেশের অনেক মহান ব্যক্তিদের ভাস্কর্য দেখতে পেয়েছি। তবে অধিকাংশ ভাস্কর্যে নামফলক বা পরিচিতি না থাকায় সেগুলো বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল।”

হবিগঞ্জ থেকে ঢাকায় ঘুরতে এসেছে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাকিল হোসেন। স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্য ঘুরে দেখার পর অনুভূতি জানাতে গিয়ে বলছিল, একসাথে অনেকগুলো ভাস্কর্য দেখলাম। অনেক গুণীজন সম্পর্কে জানতে পারলাম।

“স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেনের গুলিবিদ্ধ ভাস্কর্যটা আমাকে খুব নাড়া দিয়েছে। এভাবে একজন নূর হোসেনকে জীবন্ত রাখা যায়, তা না দেখলে বুঝতে পারতাম না।”

স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্যের যাত্রা

ভাস্কর শামীম সিকদার ১৯৮৮ সালে ফুলার রোডে অবস্থিত সেকেলে বাংলো স্টাইলের বাড়ির (বর্তমানে প্রোভিসির ভবন) সামনের পরিত্যক্ত জায়গায় ‘অমর একুশে’ নামে একটি বিশাল ভাস্কর্য নির্মাণ শুরু করেন। ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রয়াত অধ্যাপক আহমদ শরীফ এটি উদ্বোধন করেন। ১৯৯৮ সালে ওই স্থানে উদয়ন স্কুলের নতুন ভবন নির্মাণ শুরু হলে ভাস্কর্যটি স্থানান্তরের প্রয়োজন হয়। ভাস্কর্যটি সড়কদ্বীপে এনে রাখা হয়।

পরে ভাস্কর শামীম সিকদার ওই ভাস্কর্যটির অবয়ব পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ নাম দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের আলোকে নতুনভাবে নির্মাণ করেন। একইসঙ্গে বিভিন্ন ভাস্কর্য দিয়ে সড়ক দ্বীপটিকেও তিনি নিজের মনের মতো গড়ে তোলেন। ১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করেন।

ভাস্কর্য চত্বরটি মূলত স্বাধীনতা সংগ্রাম মনুমেন্ট ঘিরে, যেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ভাষা অন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদের মুখাবয়ব স্থান পেয়েছে। মনুমেন্টটির নিচে ভাষা শহীদের ভাস্কর্য এবং সবার উপরে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় নেতৃত্বের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আর তার মাথার উপর দিয়ে লাল সবুজ পতাকা উড়ছে সগৌরবে।

শ্বেতবর্ণের এ মনুমেন্টের উচ্চতা ৬০ ফুট এবং পরিসীমা ৮৫.৭৫ ফুট, যা একটি গোলাকার ফোয়ারার মাঝখানে স্থাপিত। এতে ঝর্ণা, লাইট ও সাউন্ড সিস্টেম রয়েছে। বিভিন্ন দিবস উপলক্ষ্যে লাইট ও সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা হয়।

মূল ভাস্কর্য স্বাধীনতা সংগ্রামকে ঘিরে সড়ক দ্বীপের চত্বরটিতে মোট ১১৬টি ভাস্কর্য রয়েছে। সেগুলো দেশ-বিদেশের শতাধিক কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক, বিপ্লবী, রাজনীতিক, বিজ্ঞানীর আবক্ষ ভাস্কর্য। এসব ভাস্কর্যের কোনোটি একক, কোনোটি যুক্ত।

এখানে রয়েছে বঙ্কিমচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জগদীশ চন্দ্র বসু, মাইকেল মধুসুদন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালন, কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত, ড. মো. শহীদুল্লাহ, শিল্পী সুলতান, জিসি দেব, সুভাস বোস, কামাল আতাতুর্ক, মহাত্মা গান্ধী, রাজা রামমোহন রায়, মাও সে তুং, ইয়াসির আরাফাত, কর্নেল ওসমানী, তাজউদ্দীন আহমদ, সিরাজ সিকদারের প্রতিকৃতি। ভাস্কর শামীম সিকদারেরও দুটি প্রতিকৃতি রয়েছে। আরও রয়েছে একটি হাতির চিত্তাকর্ষক ভাস্কর্য।

শামীম সিকদার নিয়োজিত কিউরেটর মো. ইমরান হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্বর্যটি মূলত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে রিপ্রেজেন্টের একটা জায়গা। এই জায়গাটাতে শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের স্বাধীনতাকামী, যারা মেহনতি মানুষের কথা বলেছেন, মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন তাদেরকে একটা রিপ্রেজেন্ট করা হয়েছে।

“স্বাধীনতা সংগ্রাম চত্বরের মূল বিশেষত্ব হলো এখানে শুধু মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নয়, স্বাধীনতার সাথে যারা রিলেটেড, স্বাধীন দেশের জন্য মূল যে চালিকা শক্তি শিল্প-সংস্কৃতির স্বাধীনতাকেও এখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।  এখানে কিন্তু শিল্পের ধারক-বাহকদেরও ভাস্কর্য আছে। সকল ধরনের মানুষদের নিয়েই কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রাম চত্বর গড়ে উঠেছে।”

রক্ষণাবেক্ষণে অর্থের অভাব

স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্য চত্বরের নির্মাতা শামীম সিকদার হলেও এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন নিরাপত্তা প্রহরী ও একজন মালী এখানে নিয়োজিত করা হয়েছে।

তবে তা রক্ষণাবেক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো বাজেট নেই বলে জানান কিউরেটর মো. ইমরান হোসেন।

তিনি বলেন, “শিল্পকর্ম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কিন্তু ভালো বাজেটের দরকার। বাজেট না থাকায় দীর্ঘদিন বেহাল ছিল এই ভাস্কর্য চত্বর। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে বটগাছ জন্মেছিল। ভাস্কর শিল্পী শামীম সিকদার ব্রিটেন থেকে দেশে ফিরে ১০ লক্ষ টাকা খরচ করে এটা মেরামত করেছেন, রঙ করিয়েছেন।

“বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি প্রতি বছর ভাস্কর্যগুলোর জন্য বরাদ্দ রাখত, তাহলে তা সংরক্ষণ ও সৌন্দর্যের জন্য কাজ করা যেত।”

অর্থের অভাবে সব ভাস্কর্যে নামফলক দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না জানিয়ে ইমরান বলেন, “প্রত্যেকটা ভাস্কর্যে যদি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা যেত, তাহলে তরুণ প্রজন্ম এই শিল্পকর্ম সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারত। সংস্কৃতি বিকাশে এটা অনেক বড় একটা ভূমিকা রাখতে পারে। এগুলো করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।”

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। মানসম্পন্নভাবে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমাদের অনেক কিছুই নেই।

“গুণগত ও মানসম্পন্ন কোনো কিছু করতে হলে ভালো ফিন্যান্সিয়াল সাপোর্ট থাকতে হয়। আর্থিক সাপোর্টের জন্য আমরা বিষয়টি ইউজিসির কাছে উপস্থাপন করব।”