নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, জামানতের পরিমাণ বাড়ার ফলে এ নির্বাচনে ‘খেলা চলবে’ কেবল সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের।
Published : 13 Apr 2024, 09:17 PM
স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে আগে যে বিধিনিষেধ ছিল, আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে তা তুলে দেওয়ায় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সন্তোষ থাকলেও জমানতের টাকা বাড়ানোয় ক্ষোভ রয়েছে৷
নির্বাচন বিশ্লেষকরাও বলছেন, জামানতের পরিমাণ বাড়ার ফলে এ নির্বাচনে ‘খেলা চলবে’ কেবল সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের। এতে প্রতিযোগিতা কমে আসায় প্রার্থীদের সহজ জয়ের সুযোগ দেখছেন কেউ কেউ৷
আর নির্বাচন কমিশন বলছে, অহেতুক নির্বাচনে আসার প্রবণতা কমাতেই তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছে।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালা ও আচরণবিধিমালায় আরও কিছু সংশোধনী এনে গত ২০ মার্চ প্রজ্ঞাপন জারি করেছে নির্বাচন কমিশন।
সংশোধনীতে চেয়ারম্যান পদে জামানতের পরিমাণ ১০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে এক লাখ টাকা করা হয়েছে। আর ভাইস চেয়ারম্যান পদে জামানত পাঁচ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে ২৫০ জন ভোটারের সমর্থনসূচক স্বাক্ষরের যে তালিকা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হত, এবার তা বাদ দেওয়া হয়েছে।
সংশোধিত বিধি অনুযায়ী, প্রার্থীদের জামানত রক্ষায় প্রদত্ত ভোটের ১৫ শতাংশ ভোট পেতে হবে। এতদিন তা ছিল এক অষ্টমাংশ।
আগামী উপজেলা নির্বাচন থেকেই এসব বিধান কার্যকর হবে।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ৮ মে প্রথম ধাপে ১৫২ উপজেলায় ভোট হবে। এসব উপজেলায় তিনটি পদে মনোনয়নপত্র জমার শেষ সময় ১৫ এপ্রিল, বাছাই ১৭ এপ্রিল।
নির্বাচন সামনে রেখে সংশোধিত বিধি নিয়ে কথা হয় প্রার্থী হতে ইচ্ছুক কয়েকজনের সঙ্গে। তাদের একজন আজিজুল ইসলাম মুকুল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলা থেকে ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করতে চান এবার।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জামানত বাড়ানোর ফলে সৎ লোকদের প্রার্থী হতে বেগ পেতে হবে৷ যারা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কিংবা যাদের আয়ের অন্য উৎস রয়েছে কেবল তাদের জন্যই সহজ হবে৷
“জামানতের পরিমাণটা আমাদের কাছে একটু বেশিই মনে হচ্ছে। এটা নির্বাচন কমিশন কোন যুক্তিতে করছে, তারাই ভালো বলতে পারবে। যারা সীমাবদ্ধ আয়ের মধ্যে চলে, জনগণের সেবা করতে চায়, মানুষের কাছে থাকতে চায়, প্রতিনিধি হতে চায়, তাদের ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে যাবে। স্বাক্ষরের বিধান তুলে দিয়ে আর লাভ হল না।”
গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে লড়েছিলেন মাহতাব উদ্দীন, জয়ও পেয়েছিলেন তিনি৷ এবারও নির্বাচনে আসার চিন্তাভাবনা রয়েছে তার৷ তিনিও মনে করছেন, অস্বচ্ছল যোগ্য প্রার্থীদের জামানতের টাকা জোগাড় করাটাই কষ্টকর হয়ে যাবে।
“যারা স্বচ্ছল তাদের জন্য তো এটা কোনো বিষয় না, কিন্তু অনেক প্রার্থী আছে যাদের জনগণ পছন্দ করে, তারা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দুর্বল, অন্যান্য দিক দিয়ে ভালো।”
বেলাব উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করতে ইচ্ছুক রহিমা বেগম ময়ূরী মনে করেন, জামানতের টাকা বেশি হওয়ায় নির্বাচনে এবার প্রার্থীর সংখ্য কম হবে; ফলে তার জন্য নির্বাচিত হওয়া সহজ হবে।
“এটা আমার জন্য ভালো হয়েছে। এর ফলে সব প্রার্থী আসবে না, সক্ষমতা যাদের আছে তারাই আসবে শুধু।”
আওয়ামী লীগ মনোনীত গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান আশরাফুল আলম সরকার লেবুও মনে করেন জামানতের টাকা বাড়ানোটা নির্বাচনি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে ভালো হয়েছে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে বাহবা জানাই। ইচ্ছে হলেই কেউ প্রার্থী হয়ে যাবে না। দাঁড়িয়ে লাভটা কী, তারা তো জিততে পারবে না।”
তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে স্বাক্ষরের বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়ার বিষয়টিকে সরকারের নির্বাচনি কৌশল হিসেবে দেখছেন নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এর মাধ্যমে প্রার্থী হতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে; আবার জামানত বাড়িয়ে প্রার্থী হতে তাদের নিরূৎসাহিত করা হচ্ছে।
“স্বাক্ষর তুলে দেওয়ার কারণ এরকম বাধা থাকলে অনেকেই প্রার্থী হয় না, হতে পারে না বা হওয়ার পরও প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যায়। কারণ স্বাক্ষর জোগাড় করতে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়। অনেক প্রার্থী আছে যাদের টাকা নাই, যারা সৎ মানুষ, যাদের সাধারণ ভোটারের কাছে গ্রহণযোগ্যতা আছে কিন্তু টাকার অভাবে নির্বাচন করতে পারে না, তাদের জন্য এটা এক ধরনের নিরূৎসাহিত করা। এতটা না করলে ভালো হতো।”
এদিকে জামানতের টাকা বাড়ানোর বিষয়টিকে অযৌক্তিক মনে হচ্ছে না সাবেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানমের কাছে।
তিনি বলেন, “অনেক সময় এত বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে যায় যার ফলে নির্বাচনে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। ইচ্ছা হলো আর প্রার্থী হয়ে গেল, এটা যেন না হয়, তা খেয়াল রাখা দরকার।
“ভোটার না থাকার পরও ভোটে দাঁড়ালে তো জামানত ফিরে পাবে না। এদিকটাও যেন প্রার্থীর মাথায় থাকে। ভোটার না থাকলে ১ লাখ টাকা দিয়ে নিশ্চয়ই কেউ ভোটার হতে আসবে না। যাদের যোগ্যতা আছে তারাই আসুক।”
নির্বাচন বিধি ও আচরণবিধি সংশোধন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কেউ যদি ভোট পায় তাহলে জামানত তো সে ফিরে পাবে। এখানে কোনো সমস্যা নাই। দেখি ‘একটু নির্বাচন করি’ এই প্রবণতাটা হ্রাস পাবে। যে লোক ১৫ ভাগ ভোট পাবে না তার তো নির্বাচন করার দরকার নাই।
“স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থনে ভোটাররা অনেক সময় স্বাক্ষর দিতে চায় না বলে অনেকে জাল স্বাক্ষর জমা দেয়। সে কারণে কমিশন এ নিয়ম তুলে দিতে চেয়েছে।”
‘বৈষম্য তৈরি করবে রঙিন পোস্টার’
আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে সাদাকালোর পাশাপাশি রঙিন পোস্টার ও ব্যানার করতে পারবেন প্রার্থীরা। এতে নির্বাচনে বৈষম্য তৈরি হওয়ার শঙ্কা দেখছেন মনোনয়ন প্রত্যাশী ও নির্বাচন বিশ্লেষকরা।
আজিজুল ইসলাম মুকুল বলেন, রঙিন পোস্টার ব্যবহার করতে গিয়ে প্রার্থীদের বেশ অর্থ খরচ হবে; সেক্ষেত্রে প্রার্থী যোগ্য হলেও তার পক্ষে তা করা সম্ভব হবে না।
“তিনি রঙিন করতে পারলেন না, সাদাকালো করলেন। তখন পাবলিক ভাববে লোকটা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, এখন বর্তমান সমাজে তো সবাই টাকা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে। যারা সৎ এবং যোগ্য মানুষ হিসেবে পরিচয় নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়ায়, তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। অনেকে তো আছে যারা টাকার ঝনঝনানি দেখাবে, আমরা তো সেটা পারব না।”
মাহতাব উদ্দিন বলেন, সাদা কালো পোস্টার ব্যবহারের নিয়ম বহাল থাকলে কোন প্রার্থী স্বচ্ছল আর কোন প্রার্থী অস্বচ্ছল তা স্পষ্ট হতো না।
“সেক্ষেত্রে সবার পোস্টারও একরকম থাকত। এখন যাদের টাকা আছে তারা অনেক বেশি ভালো করতে পারবে, যাদের টাকা কম তাদেরটা তেমন ভালো হবে না।”
নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীমও মনে করেন, রঙিন পোস্টার আকর্ষণ করে বেশি; ফলে যে প্রার্থীর তা তৈরি করার পরিস্থিতি থাকবে না তাকে নির্বাচনি ইঁদুর দৌড়ে পিছিয়ে পড়তে হবে।
“যার টাকা আছে সে রঙিন পোস্টার দিয়ে হয়ত এলাকা একদম ভরে ফেলবে। যার টাকা কম সে তখন ঢাকা পড়ে যাবে।”
তবে রঙিন পোস্টার ব্যবহারে অসুবিধা দেখছেন না আশরাফুল আলম সরকার লেবু।
তিনি বলেন, “আমরা কোনো না কোনোভাবে রঙিন পোস্টার ব্যবহার করার চেষ্টা করি। অনেকের জরিমানাও দিতে হয়। এটা করায় ভালো হয়েছে।”
রঙিন পোস্টারের অনুমতির বিষয়ে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, “এখন সাদাকালো পোস্টার ছাপানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে বলে প্রার্থীদের অভিযোগ ছিল। তাই রঙিন পোস্টারের বিধান আনা হয়েছে।”
অনলাইন মনোনয়নে অসুবিধা দেখছেন না তারা
স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো চেয়ারম্যান, সাধারণ ভাইস চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত ভাইস চেয়ারম্যান পদে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে কমিশন। সরাসরি মনোনয়ন জমা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই এবার। তবে বিষয়টি নিয়ে অসুবিধা দেখছেন না মনোনয়ন প্রত্যাশীরা।
নারায়ণগঞ্জের আজিজুল ইসলাম মুকুল বলেন, “অনলাইন হয়ে আরো সুবিধা হয়েছে। ঘরে বসে জমা দেওয়া যাবে। কোথাও যেতে হবে না।”
গাজীপুরের মাহতাব উদ্দীন বলেন, “যেহেতু যুগ অনেক এগিয়েছে, সবকিছুই ডিজিটাল হয়ে আসছে সুতরাং এ সিস্টেমে আসাতে খারাপ হবে না।”
উপজেলার ভোটে বাড়ল জামানত, সহজ হল স্বতন্ত্র প্রার্থিতা
উপজেলা নির্বাচন: মনোনয়নপত্র জমা দিতে হবে অনলাইনে
২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমায় বাধা দেওয়ার পর তৎকালীন কমিশন অনলাইনে মনোনয়ন জমা নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। পরে জেলা পরিষদের ভোটে এ সুযোগ থাকলেও প্রার্থীদের অনাগ্রহে তাতে সাড়া পায়নি ইসি। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অন্তত ৩৯ জন অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেন।
বর্তমান কমিশন আচরণবিধি প্রতিপালনের সুবিধার কথাও বিবেচনায় নিয়েছে, তাই অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমার বিষয়ে নতুন করে আগ্রহ দেখাচ্ছে। অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা উন্মুক্ত থাকলেও নতুন অ্যাপে ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও তেমন সাড়া মেলেনি। এবার বিধি সংশোধন করে উপজেলা ভোটে সব পদে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
দেশের ৪৯৫ উপজেলায় এবার চার ধাপে ভোট হবে। প্রথম ধাপে ৮ মে, দ্বিতীয় ধাপে ২৩ মে, তৃতীয় ধাপে ২৯ মে এবং চতুর্থ ধাপে ৫ জুন ভোট হবে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে জানিয়েছে, তারা এবার স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে দলীয় প্রতীক দেবে না। অন্যদিকে সংসদ নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনও বর্জনের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। ফলে এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হবে মূলত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে।