হাজার হাজার অভিভাবকের হাত ধরে এদিন শিশু, কিশোর-কিশোরীরা চিড়িয়াখানায় এসে আনন্দ পেয়েছেন।
Published : 23 Apr 2023, 09:09 PM
বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষার পরও ঘুরলো না সিংহটি। পেছন ফিরে শুয়ে আছে বলে মন খারাপ ধূপখোলা থেকে জাতীয় চিড়িয়াখানায় ঘুরতে আসা পাঁচ বছরের জান্নাতের৷
বাবার কাঁধে চড়ে 'এই লায়ন ওঠ, ওঠ' বলে ডাকছিল সে। সিংহ তার এ ডাকে সাড়া না দিলেও জান্নাতের মন ভরেছে বাঘের ‘মার্চপাস্ট’ দেখে।
রোববার ঈদুল ফিতরের দ্বিতীয় দিনে ঘুরতে আসা তার মতো হাজারো শিশু কিশোর আর বড়দের নিরাশ করেনি চিড়িয়াখানায় প্রধান আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
রাজসিক ভঙ্গিমায় তার খাঁচার এপাশ থেকে ওপাশে প্রাণবন্তভাবে অনেকবারই হেঁটে চলে আনন্দ দিয়েছে আগত দর্শনার্থীদের, যেন মার্চপাস্ট করছিল।
গরমের তপ্ত ভাব কাটিয়ে রোদ-বৃষ্টিহীন দিন আর মৃদুমন্দ বাতাসের অন্য রকম আবহাওয়ার মধ্যে জাতীয় চিড়িয়াখানায় জান্নাতদের মত ঢাকার অপরপ্রান্ত থেকে থেকে যেমন এসেছিলেন অনেকেই, তেমনি কাছাকাছি দূরত্বের মানুষজনও ভিড় করেন।
ঈদের ছুটিতে সবার আসা যাওয়ার মধ্যে এদিন জনস্রোত নেমেছিল চিড়িয়াখানামুখী সড়কে। চিড়িয়াখানার বাইরে ও ভেতরেও ছিল দর্শনার্থীদের ঢল। দুপুর গড়িয়ে বিকালে সেই ভিড় আরও বাড়ে।
চিড়িয়াখানার পরিচালক রফিকুল ইসলাম তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "ঈদের দিনে এক লাখ মানুষের সমাগম হয়েছিল। আজকে সেটা দুই লাখে ঠেকেছে।"
এ জনস্রোতে ছিলেন দুই ভাই-বোন আরাফ উদ্দিন ও সাইয়া আহমেদ তানহা। বাঘের সেই খাঁচার সামনে কথা হয় তাদের সঙ্গে। মা-বাবার সঙ্গে প্রথমবার চিড়িয়াখানায় ঘুরতে এসে ক্লাস এইটে পড়া তানহা বলেন, "আমার খুবই ভালো লাগছে। ঈদের ছুটিতে এখানে এসে অনেক প্রাণী দেখলাম। এতদিন এগুলো টিভিতে দেখেছি।"
তার ভাই আরাফের কথায়, "নতুন-নতুন অনেক প্রাণী দেখলাম। অনেক ভাল লেগেছে।"
সাব সাহারান আফ্রিকা অঞ্চলের দৈত্যাকার জলহস্তী এদিন চলে এসেছিল দর্শনার্থীদের খুব কাছাকাছি। খাঁচার ফাঁক গলে হাত দিয়ে কেউ কেউ ছুঁয়েও দেখেছেন বিশালকায় প্রাণীটিকে। ঢাকার খিলক্ষেত থেকে আসা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া নাঈম তাদের একজন। তিনি জানান, এর আগে চিড়িয়াখানায় এলেও এত কাছ থেকে জলহস্তী আগে কখনও দেখননি।
বিভিন্ন প্রজাতির বানর, উল্লুক, বেবুনের খাঁচার পাশেও এদিন ছিল উপচে পড়া ভিড়। উল্লুকের খাঁচার পাশে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকা মিরপুর থেকে আসা আট বছরের সিরাতুন নাজাত অবনী বলে, " বাঘ, ভাল্লুক, জেব্রা আর অনেকগুলো বানর দেখেছি। উল্লুকটাও বানরের মত দেখতে কিন্তু একটু অন্যরকম।"
তার মা গৃহিণী শম্পা জানালেন, বাচ্চার জন্যই ভিড় হবে জেনেও এসেছেন। বাচ্চার আনন্দের মাঝেই এখন তার ঈদ আনন্দ।
শম্পার মতো হাজার হাজার অভিভাবকের হাত ধরে এদিন শিশু, কিশোর-কিশোরীরা চিড়িয়াখানায় এসে আনন্দ পেয়েছেন।
নার্সারিতে পড়া তৌসিফের চাচা হাসিবুল আলম এদিন বাসার সব শিশুদের নিয়ে আসেন চিড়িয়াখানায়। এ দলে ছিলেন তার মা নুরুন নাহারও। অনেক কিছু দেখার পর শিশু তৌসিফ জানালেন, সিংহ দেখে তার সবচেয়ে ভালো লেগেছে। শিশুদের সঙ্গে এসে আনন্দ কুড়িয়েছেন বয়জ্যেষ্ঠ নুরুন নাহারও। তিনি বলেন, "খুবই ভালো লাগছে। অনেকদিন পর ফ্যামিলির সঙ্গে বের হয়ে আনন্দ উপভোগ করছি। নাতি-পুতিদের খুশিই আমার খুশি।"
হাঁ করে থাকা কুমির দেখে বেশ ভীত সাত বছরের সিরাজুম মুনিরা। মা লিমা আক্তার তাকে অভয় দিয়ে ধাতস্থ করলেন কিছুটা। মুনিরা বলেন, "বাঘের চেয়েও কুমির বেশি ভয়ঙ্কর।"
কিছুটা উসখুস ভাব নিয়ে আর ভীত চোখে মানুষ ভিড় করেছেন বিভিন্ন প্রজাতির সাপ ও সরীসৃপের খাঁচার সামনেও।
ভিড়ের চাপে সব খাঁচার সামনে এদিন যেতে পারেননি। দূর থেকেই দেখতে হয়েছে অনেক কিছু। এরমধ্যে দর্শনার্থীদের এদিন নির্মল আনন্দ দিয়েছে খাঁচার ভেতর দেশি-বিদেশি নানা প্রজাতির পাখির ওড়াওড়ি আর কলকাকলি। দুধসাদা রঙা বক, পেখম তোলা ময়ূর, দেশি ঘুঘুসহ নানা প্রজাতির পাখিতে মুগ্ধ হয়েছেন ঘুরতে আসা মানুষ।
একেবারে ছোটদের এসব পাখি দেখিয়ে কেউ কেউ চিনিয়েছেন। বয়সে কিছুটা বড়দের বই ও টিভির পর্দায় দেখে যারা চিনেছে তাদের পাখি দেখিয়ে নাম জিজ্ঞেস করে বাবা-মায়েরা পরখ করে দেখেছেন।
ভিড়ের মধ্যেও হরিণ ও গাধার সামনে লতাপাতা ধরে খাইয়েছেন কেউ কেউ। ঘোড়া-জেব্রার গায়ে হাত বুলিয়ে দেওয়ার দৃশ্যও দৃষ্টি কেড়েছে অনেকখানে।
জিরাফের খাঁচার সামনে থাকা বেসরকারি চাকরিজীবী মো. কামাল হোসেন পরিবারের সবাইকে তিনি এসেছেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে।
তার দলের সবচেয়ে ছোট সদস্য পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া নওরীন জাহান আইভি ঘড়িয়াল আর লামা এদিনই প্রথম দেখেছেন। নওরীন বলেন, "অনেক কিছুই ভালো লেগেছে। বাঘ ভালো লাগছে। সাপ, জিরাফ, জেব্রাও সুন্দর। ঘড়িয়াল আর লামা দেখেছি যা আগে কখনও দেখিনি।"
তার ভাই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ মোহাম্মদ নিয়ামূল হাসান সাকিবের অবশ্য একটু ভিন্ন ভাবনা। পরিবারের সঙ্গে ঘুরতে আসাই তার মধ্যে ভালো লাগা তৈরি করেছে। তবে মন খারাপ হয়েছে চিড়িয়াখানার ব্যবস্থাপনা দেখে।
সাকিব বলেন, "আগের মতই দেখলাম সবকিছু। কিছু চেঞ্জ আনা দরকার। ব্যবস্থাপনা আরও আধুনিক হওয়া দরকার, তদারকি বাড়ানো দরকার। মানুষ যেভাবে আসে সে অনুযায়ী চিড়িয়াখানার আয়তনও বাড়ানো প্রয়োজন। আমি চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা ঘুরেছি সেটি কিন্তু ঢাকার চেয়ে আরও অর্গানাইজড।"
জাতীয় চিড়িয়াখানার ইজারাদার বিমল চন্দ্র মণ্ডল বলেন, "ঈদকে সামনে রেখে চিড়িয়াখায় নিরাপত্তা ভালো আছে। পর্যাপ্ত পুলিশ নিরাপত্তা দিচ্ছে। আশা করি মানুষ নির্বিঘ্নে চিড়িয়াখানায় আনন্দ উদযাপন করতে পারবে৷ আবহাওয়া ভালো থাকলে ঈদের এই পুরো সপ্তাহে ভালো লোক হবে।"
চিড়িয়াখানার পরিচালক রফিকুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা ও বিনোদনের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এত বিপুল মানুষের সমাগম বেশ সুন্দরভাবে হয়েছে।
“সবএনিমেল শেডের সামনে আমাদের লোক আছে, দর্শনার্থীরা যেন প্রাণীদের বিরক্ত না করে সে ব্যাপারটি তারা দেখছেন ও সচেতন করছেন।"
টানা তাপদাহ কাটিয়ে ওঠা প্রাণীদের প্রাণবন্ত রাখতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, "আমরা ওই স্ট্রেস সামাল দিতে বেশ আগে থেকে চেষ্টা করেছি। পর্যাপ্ত ইলেক্ট্রোলাইট, পানি সাপ্লাই ও গোসল দেওয়া হয়েছে। এই ঈদে মানুষ সুস্থ-সবল প্রাণী উপভোগ করছে বলে আশা করছি।"