“সমাবেশে ‘জয় বাংলা’ বলে আপা (শেখ হাসিনা) নামতে যাবেন, এমন সময় বিকট শব্দ। এরপর কোথায় যেন উড়ে গিয়ে পড়লাম।”
Published : 21 Aug 2023, 12:51 AM
এখনও মাঝে মাঝে প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যায়, চেহারা ফুলে যায়, পা দিয়ে রক্ত ঝরে, সেইসঙ্গে ইনফেকশন আর কিডনি জটিলতা তো আছেই; ১৯ বছরে আগের এক ভয়ঙ্কর ঘটনার পর থেকেই এই সমস্যা বয়ে বেড়াচ্ছেন রাশিদা আক্তার রুমা।
ক্ষোভে-দুঃখে তিনি বলছিলেন, “সেদিন বোধহয় মরে গেলেই বেঁচে যেতাম। তাহলে আমার বাচ্চারা, আমার পরিবারের এত হয়রানি, এত কষ্ট করতে হত না।”
রাশিদা আক্তার রুমা একসময় ছিলেন ঢাকার কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক। দলীয় অন্যান্য কর্মসূচির মতই ২০০৪ সালের ২১ অগাস্টে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন।
সেই সমাবেশে আওয়ামী লীগ সভাপতি, তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়ার পরক্ষণেই যা ঘটেছিল, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে এখনও শিউরে ওঠেন রুমা।
“ওই দিন সমাবেশে জয় বাংলা বলে আপা (শেখ হাসিনা) নামতে যাবেন, এমন সময় বিকট শব্দ। এরপর কোথায় যেন উড়ে গিয়ে পড়লাম। কখন, কতক্ষণ ছিলাম জানি না। সন্ধ্যার দিকে আমার আমপাশের লোকজনের শব্দ এল। তখন আমি চোখ খুলে দেখি রক্ত আর রক্ত।
“আমার আঙ্গুল, বাঁ হাত, দুটো পা ভেঙে গিয়েছিল। পা ভেঙে হাড় বাইরে বেড়িয়ে গিয়েছিল। হাতির পায়ের মত ফুলে গিয়েছিল পা দুটো। পরে আমি আমার বাঁ হাতের ওপর ভর দিয়ে কোনোরকমে উঠে দেখি, আইভি আন্টি ওখানে পড়ে আছে। আমি ওনার পাশেই ছিলাম। আমি উঠে যে কাউকে কিছু বলব তা পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। পরে কেউ একজন আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।”
২১ অগাস্টের ভয়াবহ সেই গ্রেনেড হামলার ঘটনার স্মৃতিচারণ করছিলেন রুমা; যে ঘটনায় আওয়ামী লীগের তখনকার মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ প্রাণ হারিয়েছিলেন ২৪ জন, আহত হন শতাধিক। সেদিন কোনোভাবে বেঁচে গেলেও স্থায়ীভাবে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
ওই দিন অস্থায়ী ট্রাকে বানানো মঞ্চে শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। মঞ্চের সামনেই ছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। কিন্তু সেই আক্রমণের পরই সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যায়। বোমার ক্ষত আর শরীরের স্প্লিন্টারের যন্ত্রণার সঙ্গে দুঃসহ সেই স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে রুমা বলেন, “২৪ ঘণ্টা ওষুধ খেয়ে থাকতে হয়। প্রতিটা দিন ৩০-৩৫টা ট্যাবলেট খেতে হয়। এই যে স্প্লিন্টার, শরীরে প্রচণ্ড জ্বালাপোড়া করে। দিনে ৪-৫বার গরম পানি করে শরীরে ঢালতে হয়। না ঢাললে পোকার মতো হাঁটতে শুরু করে। চুলকাতে চুলকাতে রক্ত বের হয়ে যায়। গরমের দিন আসলে এটা হয়। রাতে যন্ত্রণা করে খুব বেশি। পা অবশ হয়ে যায়।”
স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমরা সেদিন বোধহয় মরে গেলে বেঁচে যেতাম। মরে গেলে এত হয়রানি, কষ্ট করতে হত না।”
সেদিন অস্থায়ী ট্রাকে বানানো হয়েছিল মঞ্চ। এর সামনেই মহিলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ছিলেন এই সংগঠনের তখনকার কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসমা জেরিন ঝুমু।
সেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “মনে হলে শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠে। মনে হয়, মৃত্যুর সামনে থেকে আসছি। শেখ হাসিনা আপা যখন মঞ্চ থেকে নেমে আসবেন, তখন আইভী আপার সঙ্গে সঙ্গে আমিও সিঁড়ির দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছি, পরে আর কিছু মনে নেই। শুধু বিকট শব্দ শুনেছি। পরবর্তীতে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে সেটা বুঝছি।
“আর সবসময় তো এই কথা মনে হয় না, যখন স্প্লিন্টারের ব্যথা হয় তখনই মনে হয়, কয়েক সেকেন্ডের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে থাকে।”
শরীরে থেকে যাওয়া স্প্লিন্টার এখনও যন্ত্রণা দেয় জানিয়ে ঝুমু বলেন, “চলাফেরার সময় যন্ত্রণা দেয়। মাঝে মাঝে হাসপাতালে যাই, বেশি যন্ত্রণা দিলে হাসপাতালে যাই, আর ওষুধের ওপর বেঁচে আছি।”
২১ অগাস্টের হামলায় প্রাণে বেঁচে গেলেও বাটার দোকানের সামনে ট্রাক থেকে অল্প দূরে থাকা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের তখনকার সাংগঠনিক সম্পাদক খলিলুর রহমানের দুই পায়ে অসংখ্য স্প্লিন্টার বিঁধেছিল।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “তখন ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলেও সেখানে কোনো চিকিৎসা আমার হয়নি। আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, ধানমন্ডির ট্রমা সেন্টার ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটালে। দীর্ঘদিন চিকিৎসা করেও আসলে সব স্প্লিন্টার বের করা যায়নি, সে কারণে ঝিরঝিরে একটা ব্যথা সব সময়ই থাকে। আর শীতকালে সেই ব্যাথাটা বেশি যন্ত্রণা দেয়। হঠাৎ হঠাৎ পায়ের ব্যথায় ঘুম ভেঙে যায়।”
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এসএম কামালের শরীরেও ওই হামলার ক্ষত এখনও আছে।
“নেত্রীর ট্রাকের পাশেই ছিলাম। বিকট একটা শব্দ শোনার পর অনেকেই বুঝতে পারিনি কী হয়েছিল। এরপর কয়েকটা বিকট শব্দ হয়। চারদিকে মানুষ ছোটাছুটি করছিল। আর্তচিৎকারে একটা ভয়াবহ পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।
“আমি হঠাৎ করে দেখি আমার শরীরের নিচের অংশ রক্তে ভেজা। আমাকে প্রধানমন্ত্রীর গাড়িচালক আলী হোসেন ও শাহজাহান ঢাকা মেডিকেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল। সেখানে যাওয়ার পর কোনো চিকিৎসক পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে ধানমন্ডিতে আমার বাসার পাশে, ৪ নম্বর রোডে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। সেখানে পেটের নাড়ি কেটে ফেলতে হয়, আর সব স্প্লিন্টার বের করা সম্ভব হয়নি।
“যেগুলো শরীরে আছে সেগুলোর যন্ত্রণা তো আছেই। সেগুলোর ব্যথা নিয়েই এখন জীবন কাটাতে হয়। কিছু করার নাই,” বলেন তিনি।
২১ অগাস্টের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ অগাস্ট মারা যান। প্রায় দেড় বছর পর মৃত্যু হয় ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের। সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে।
২১ অগাস্ট হামলায় নিহত অন্যরা হলেন- শেখ হাসিনার দেহরক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রহমান, হাসিনা মমতাজ, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মোশতাক আহমেদ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসিরউদ্দিন, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম। একজনের পরিচয় এখনও জানা যায়নি।
নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে এ সংক্রান্ত মামলার রায় হয় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়।
রায়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এছাড়া ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন বিচারক।
২০০৯ সালে ফের সরকার গঠনের পর থেকে আওয়ামী ওই হামলায় হতাহতদের সাহায্যে উদ্যোগ নিয়েছে।
তৎকালীন আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক রাশিদা আক্তার রুমা পুরান ঢাকার তিন তলার দুই কক্ষের একটি বাসায় দুই মেয়েকে নিয়ে ভাড়ায় থাকতেন। বছর তিনেক আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ফ্ল্যাট দিয়েছেন বলে জানান রুমা।
তিনি বলেন, “এমনিতেই শরীরের অবস্থা খারাপ, আবার কষ্টের জীবন। নেত্রী তিন বছর হলে মিরপুরে ফ্ল্যাট দিয়েছে। এখন আমি ফ্ল্যাট থাকি এক মেয়ে নাতি-নাতনিদের নিয়ে।”
আরও পড়ন-
গ্রেনেড হামলার মূল চক্রান্ত তারেকের, খালেদা নেপথ্যে: শেখ হাসিনা
২১ অগাস্ট: কর্মীদের মানবঢালে যেভাবে প্রাণে বাঁচেন শেখ হাসিনা