বিচারের ভার আপনাদের: প্রধানমন্ত্রী

সরকারের বর্তমান মেয়াদের চার বছর পূর্তির প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Jan 2023, 01:34 PM
Updated : 6 Jan 2023, 01:34 PM

টানা ১৪ বছর সরকারে থেকে আওয়ামী লীগ দেশকে কী দিতে পেরেছে, সেই বিচারের ভার দেশের মানুষের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, “২০০৯ সাল থেকে একটানা ১৪ বছর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে। এই ১৪ বছরে আমরা দেশ এবং দেশের জনগণকে কী দিতে পেরেছি- তার বিচার-বিশ্লেষণ আপনারা করবেন।”

প্রতিবারের মতই সরকারের বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় তার এই ভাষণ রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমে সরাসরি প্রচার করা হয়।

ভাষণের শুরুতেই সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন, “একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের চার বছরপূর্তি উপলক্ষে আমি দেশবাসী এবং দেশের বাইরে অবস্থানরত প্রবাসী ভাইবোনদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। একইসঙ্গে আপনাদের খ্রিষ্টীয় নতুন বছর ২০২৩-এর শুভেচ্ছা জানাই।”

বিচারের ভার জনগণের ওপর ছেড়ে দিয়ে শেখ হাসিনা গত ১৪ বছরে তার সরকারের বিভিন্ন কাজের বিস্তারিত খতিয়ান তুলে ধরেন তার ভাষণে। 

তিনি বলেন, “স্বাধীন-স্বার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাসহ এ দেশের মহৎ এবং বৃহৎ অর্জনসমূহ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরেই অর্জিত হয়েছে।”

সরকারপ্রধান বলেন, “স্বাধীনতার পর জাতির পিতা যখন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের মাধ্যমে অর্থনীতিকে মজবুত ভিত্তির উপর দ্বার করানোর দ্বারপ্রান্তে, তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি তাকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যা করে। স্তব্ধ হয় বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা।

“২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার সুযোগ পায়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১, এই পাঁচ বছরে দেশের প্রতিটি খাতে অভাবনীয় উন্নয়ন সাধিত হয়। বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে।”

মাঝে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এবং সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ফের সরকার পরিচালনার দায়িত্বে আসে, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে তখনও বিশ্বব্যাপী মন্দাবস্থা চলছিল। চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ছিল আকাশচুম্বী।

“অন্যদিকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ছিল নিম্নমুখী। বিদ্যুতের অভাবে দিনের পর দিন লোডশেডিং চলতো। গ্যাসের অভাবে শিল্পকারখানার মালিকেরা যেমন হাহাকার করতো, তেমনি চুলা জ্বলতো না মানুষের বাড়িতে। সারসহ কৃষি উপকরণের উচ্চমূল্য এবং জ্বালানি তেলের অভাবে কৃষকের নাভিশ্বাস উঠেছিল।

“এমন এক অর্থনৈতিক দূরবস্থার মধ্যে আমরা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিই। নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে আমরা রূপকল্প-২০২১ প্রণয়ন করি এবং জনগণের সামনে তুলে ধরি।”

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, জোট সরকারের শেষ অর্থবছরে (২০০৫-০৬) বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ মার্কিন ডলার। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে।

২০০৫-০৬ সময়ে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ। বর্তমানে দারিদ্রের হার ২০ শতাংশ। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। করোনা মহামারীর আগে ২০১৯-২০২০ অর্থবছর তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছিল ৮ দশমিক এক-পাঁচ শতাংশে। ২০০৫-০৬-এ জিডিপির আকার ছিল মাত্র ৬০ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপির আকার ৪৬০ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াতের শেষ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি খাতে আয় হয়েছিল ১০ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২০২২ অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫২ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলারে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে রেমিটেন্স এসেছিল ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বিদেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা পাঠিয়েছেন ২২ দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলার।

২০০৫-০৬ অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে তা ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা ও মূল্যস্ফীতির কারণে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৪ বিলিয়ন ডলারে। যা ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য রিজার্ভ রয়েছে।

সরকারের উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা নানা প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ সম্পন্ন করেছি। এই সেতু দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলাকে সড়ক পথে ঢাকা এবং অন্যান্য জেলার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করেছে। গত ২৮-এ ডিসেম্বর মেট্রোরেল উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে আমরা যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরেকটি মাইলফলক স্পর্শ করেছি।

“কিছুদিনের মধ্যেই শুধু বাংলাদেশেই নয়, চট্টগ্রামে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পাতাল সড়কপথ, বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধনের মাধ্যমে আরেকটি মাইলফলক স্থাপিত হবে। পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। আমরা ২০১৮ সালের মে মাসে মহাকাশে নিজস্ব স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণ করেছি।”

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ৪১তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। জেন্ডার সমতা এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে।

মাছ, মাংস ও ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশের ‘স্বয়ংসম্পূর্ণতা’ অর্জনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম। বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে তৃতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয়। প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ কৃষককে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদান করা হয়েছে। ১ কোটি কৃষক ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক একাউন্ট খুলেছেন। ভর্তুকির টাকা সরাসরি ব্যাংকে জমা হয়। সেচের জন্য সুলভমূল্যে বিদ্যুৎ এবং কৃষিযন্ত্র ক্রয়ে ৭০ শতাংশ ভর্তুকি পাচ্ছেন।

দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ইতোমধ্যেই অনেকগুলো অঞ্চলে দেশি-বিদেশি কোম্পানি বিনিয়োগ শুরু করেছে। কৃষি পণ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

“কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনা হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে কোল্ডস্টোরেজ স্থাপন ও ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে গ্রামের জনগণকে শহরের সকল নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার কাজ চলছে। গ্রামেও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে গেছে। এ পর্যন্ত ৩৫ লাখেরও বেশি মানুষকে বিনামূল্যে জমিসহ ঘর প্রদান করা হয়েছে। ২ কোটি ৫৩ লাখ শিক্ষার্র্থীকে বৃত্তি-উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে।“

মহামারীতে অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশও যে গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়েছিল, সে কথা ভাষণে তুলে ধরেন আওয়ামী সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “আপনাদের সহায়তায় এবং আমাদের সরকারের সময়মত উদ্যোগ গ্রহণের ফলে আমরা খুব ভালোভাইে সেই মহামারী মোকাবিলা করতে পেরেছি। টিকা পাওয়ার যোগ্য শতভাগ মানুষকে বিনামূল্যে টিকা প্রদান করা হয়েছে।”

অর্থনীতিতে মহামারীর প্রভাব মোকাবিলায় ২৮টি প্যাকেজের আওতায় ২ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন. গার্মেন্টসসহ অন্যান্য শিল্পকারখানার শ্রমিকদের বেতনভাতা নিশ্চিত করা হয়েছে। ৫০ লাখ প্রান্তিক মানুষকে দুই দফায় আড়াই হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারীর সময় প্রায় ৭ কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার মানুষ নানাভাবে উপকৃত হয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠান উপকৃত হয়েছে প্রায় ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬৭টি।

মহামারীর পরিস্থিতির মধ্যে রাশিয়া-উইক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞায় খাদ্য, জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যে অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, সে কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, “আমাদের দেশেও জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। আমরা কয়েকটি পণ্য বেশি দামে কিনে স্বল্পদামে সীমিত আয়ের মানুষের মধ্যে বিতরণ করছি।”

শেখ হাসিনা বলেন, ১ কোটি পরিবারকে টিসিবির ফেয়ার প্রাইস কার্ডের মাধ্যমে ৩০ টাকা কেজি দরে চাল ও সাশ্রয়ীমূল্যে ভোজ্য তেল, ডাল ও চিনি ক্রয় করা হচ্ছে। ৫০ লাখ পরিবার ১৫ টাকা কেজি দরে মাসে ৩০ কেজি চাল কিনতে পারছেন।

অসহায় মানুষদের ভিজিডি ও ভিজিএফ-এর মাধ্যমে ৩০ কেজি করে চাল প্রতিমাসে বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। হিজড়া, বেদে, মান্তা, দলিত, হরিজন, কুষ্ঠরোগীসহ সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষের জন্য পুর্নবাসন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “গত ১৪ বছরে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। বাংলাদেশকে আজ আর কেউ বন্যা, খরা, দুর্যোগের দেশ হিসেবে দেখে না। বাংলাদেশ এখন উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। উন্নয়নের রোল মডেল।”