“জানতাম সমতলে বস্তায় আদাসহ অন্যান্য সবজি চাষ হচ্ছে। তাই ভাবলাম জানাশোনা কৌশলটাকেই পাহাড়ে এনে দেখি কেমন হয়, যেই ভাবা সেই কাজ,” বলেন তিনি।
Published : 15 Mar 2025, 01:58 AM
পাহাড়ে থরে থরে সাজানো প্লাস্টিকের সাদা বস্তায় বেড়ে উঠছে গাজর, আদা, আলু, বেগুন, কাঁচামরিচ আর শিমসহ বিভিন্ন সবজির গাছ, যেখান থেকে বাজারে আসছে তরতাজা সবজি।
‘অর্গানিক’ এই চাষাবাদে বারবার পাহাড়ের মাটি কাটতে হচ্ছে না, রাসায়নিক বা কীটনাশকও পাহাড়ে ‘ছড়াচ্ছে না’। জৈব সার ব্যবহার করেই অপেক্ষাকৃত অল্প পরিশ্রমে ভালো ফলন উঠছে দফায় দফায়।
পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার ফাতেমানগর গ্রামে বছর তিনেক ধরে এভাবে চাষাবাদ করছেন মোস্তফা শিবলী। পাহাড়ের গা কেটে চাষাবাদের বদলে এভাবে বস্তায় চাষ করে পেয়েছেন আন্তর্জাতিক পুরস্কার।
তিনি বলেন, মাটিতে সরাসরি চাষ না করে বস্তায় চাষে মাসে অন্তত ৩ হাজার কেজি সবজি সংগ্রহ করছেন, যার মধ্যে রয়েছে গাজর, বিটরুট, আলু, কাঁচামরিচ, করলা, শিম, লাউ ও বেগুনসহ নানা কিছু।
মোস্তফা শিবলীর জন্ম ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক-স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে পাহাড়ে জৈব সার ও কৃষির পাশাপাশি কুয়াকাটায় পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
রোববার ঢাকার উত্তরায় নিজের সেই ব্যতিক্রম চাষাবাদের গল্প শোনান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে। তার দাবি, পাহাড়ের গায়ে চাষাবাদের চেয়ে বস্তায় চাষাবাদে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ সবজি উৎপাদন হচ্ছে।
বস্তায় চাষের চিন্তা কীভাবে মাথায় এল, এ প্রশ্নে শিবলী বলেন, “খাগড়াছড়ির ফাতেমানগর গ্রামে আমরা একটা কৃষি খামার পরিচালনা করি। মূলত জৈব সার উৎপাদন করি, যেটার ব্র্যান্ডনেইম হচ্ছে ‘খাগড়াছড়ি জৈবসার’। এটা সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনপ্রাপ্ত। ওই জৈবসারের একটা অংশ দিয়ে পাহাড়ে আমরা কৃষিকাজ করি। আমাদের প্রায় ৬০ একরের কৃষিখামার। শুরুতে সেই জায়গায় কাঠের বা ফলের গাছ লাগাচ্ছিলাম। পরে আমরা দ্রুত উপার্জনের আশায় সবজি চাষের সিদ্ধান্ত নিই এবং আশপাশের অন্যদের মত করে চাষ করা শুরু করি।
“আমরা সমতলের মানুষ পাহাড়ে গেছি। যতটা আগ্রহ নিয়ে গেছি, ততটা শিক্ষা ও প্রস্তুতি নিয়ে যাইনি। একেবারেই না বুঝে আমরা পাহাড়ে গিয়ে নানান কার্যক্রমে জড়িয়ে গেছি। তার মধ্যে একটা হচ্ছে কৃষিকাজ। আমিও প্রথমে অন্যদের দেখাদেখি যেভাবে কৃষিকাজ শুরু করেছিলাম, সেটা ছিল খুবই আত্মঘাতী। আমরা পাহাড়ের ঢালে অন্যদের মত করে আগাছা পরিষ্কার করে, একদম ন্যাড়া বানিয়ে মাটি কুপিয়ে ঝুরঝুরে করে সেখানে সবজি চাষ শুরু করি। খুবই পরিশ্রমসাধ্য ও ব্যয়বহুল ছিল এই প্রক্রিয়া।”
তিনি বলেন, “এর চেয়েও ক্ষতিকর আর কষ্টের হচ্ছে, এইভাবে সবজি চাষ করতে গিয়ে পাহাড়ের মাটিটাকে বিপজ্জনক করে ফেলা। এভাবে মাটিকে দুর্বল করে ফেলায় বর্ষার সময়ে বিপুল বারিধারা আমাদের সেই ঝুরঝুরে মাটিকে ধুয়ে একদম পাহাড়ের নিচে নিয়ে যায়, যেখানে ঝিরি বইছে। দেখা গেল বর্ষায় একদিন ভারি বৃষ্টির হলে পরের দিন চাষের জন্য কুপিয়ে রাখা সেই জায়গাটিতে রীতিমত ছোটখাটো ল্যান্ডস্লাইড বা ভূমিধস হয়েছে। আমরা দেখলাম এই মাটি নেমে গিয়ে পাহাড়ের নিচে যে ঝিরি বা পানির স্রোতধারা থাকে, সেখানে পানির প্রবাহকে আটকে দিচ্ছে। এক ধরনের ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
“দেখলাম আশপাশের সবাইও একইরকম ক্ষতির কারণ হয়ে কাজ করছে এবং সবার সম্মিলিত কারণে পাহাড় তার হাজার বছরের ইকোলজি নিয়ে ক্রমশ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে এ কারণে। তখন আমরা চিন্তা করলাম যে বিকল্প কী হতে পারে? কোন পদ্ধতিতে সবজি চাষ করলে পাহাড়ের ক্ষতি হবে না। আমরা জানতাম সমতলে বস্তায় আদাসহ অন্যান্য সবজি চাষ হচ্ছে। ভাবলাম এই জানাশোনা কৌশলটাকেই পাহাড়ে এনে দেখি কেমন হয়।”
শিবলী বলেন, “যেই ভাবা সেই কাজ। এরপরই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের শুরু। ২০২২ সালের শেষের দিকে আমরা আমাদের খামারের পাহাড়ের ঢালের জমিতে আড়াই হাজার বস্তা বসিয়ে সবজি চাষ শুরু করি। অসাধারণ ফলাফল পাই। আগাছা সরাতে হচ্ছে না, তার উপরেই বস্তা সরিয়ে আমরা সবজি চাষ করছি। ভেতরে নিজেদেরই জৈবসার দিচ্ছি। কীটনাশক বা অল্প পরিমাণে রাসায়নিক সার যাই দিচ্ছি, সেটা বস্তাতেই রয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিধারার সঙ্গে মাটিও নেমে যাচ্ছে না, আর যা কিছু রাসায়নিক আগে মাটিতে গিয়ে মিশেছিল, তার কোনো কিছুই আর মাটিতে মিশে যাচ্ছে না। পানিটাকেও নষ্ট করছে না।
“সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এই বস্তায় প্রথমবার বসানোর পরে সেই একই বস্তায় চাষাবাদের পর গাছ উঠিয়ে দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার এমনকি চতুর্থ বা পঞ্চমবারও একই চাষ করা যাচ্ছে। যদি বস্তাগুলোকে ঠিকঠাক ব্যবস্থাপনা করা যায়। তার মানে হচ্ছে এটা অর্থ সাশ্রয়ী, পরিবেশ রক্ষার দিক থেকেও ভালো, ভূমিধস হচ্ছে না, পানিদূষণ হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ সবজি উৎপাদন করা যাচ্ছে।”
প্রথমবার ফলাফল ভালো হওয়ায় দ্বিতীয় বছর পাঁচ হাজার বস্তায় সবজি চাষ শুরু করেন শিবলী।
“তৃতীয় বা বর্তমান বছরে আমাদের বস্তার সংখ্যা ১১ হাজার। আমরা এই ফলাফলে খুশি। এই কাজটার জন্যই আমাদের প্রতিষ্ঠান শিবলী ফার্মস পাহাড়ে কৃষির জন্য পুরস্কৃত হয়েছে।”
পাহাড়ে পরিবেশবান্ধব এই কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সম্প্রতি নেপালভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেইন ডেভেলপমেন্ট’ (আইসিআইএমওডি) এর পুরস্কার পেয়েছেন মোস্তফা শিবলী, যার অর্থমূল্য প্রায় ১০ লাখ টাকা।
আইসিআইএমওডি হিমালয়-হিন্দুকুশ পর্বতমালার নিকটবর্তী আটটি দেশ– বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, ভুটান, চীন, ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, পাকিস্তান নিয়ে গঠিত একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংস্থা। এটি এ দেশগুলোর পাহাড়ি এলাকায় কৃষি নিয়ে কাজ করে, যেটি পরিচালিত হয় নেপাল থেকে।
‘হিন্দুকুশ হিমালয়া ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ ফর অন্ট্রাপ্রেনার্স’ নামে ওই পুরস্কার সংক্ষেপে ‘এইচকেএইচ-আইসিই’ নামে পরিচিত। এ বছর নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, ভারতের দুইশর বেশি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছিল। তার মধ্যে ১১টি ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পুরস্কার পেয়েছে। যেখানে মোস্তফা শিবলীর প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। ‘বস্তায় অর্গানিক সবজি’ চাষের জন্য এ পুরস্কার পেয়েছে ‘শিবলী ফার্মস’।
এ পুরস্কারের বিষয়ে কীভাবে জেনেছিলেন শিবলী?
তিনি বলেন, “আমি এটা প্রথমে জানতে পারি ব্র্যাকে আমার এক পরিচিত বন্ধুর মাধ্যমে। তখন আমি আবেদন করি। মাস তিনেক পরে ওরা আমাকে ফাইনালিস্ট হিসেবে নির্বাচন করে। আরও মাসখানেক পর ওরা আমাকে মেইলে জানায়, আমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছি।”
পাহাড়ে এই চাষাবাদে সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতা কী?
শিবলী বললেন, “আমার চলমান কার্যক্রমের মধ্যে এই মুহূর্তে একটা বড় দুর্বলতা হচ্ছে, আমরা পানি দিতে-দিতে শেষ, কায়িক পরিশ্রম করে কুলাতে পারছি না। টিউবওয়েলে পাম্প করে পানি তোলাটা বা ডিজেল দিয়ে ঝিরি থেকে পানি তোলাটা অনেক ব্যয়বহুল। আমি যে কৃষিকাজ করি, ওখানে সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে সেচ। পুরস্কারের টাকা দিয়ে আমার কৃষিকাজে ‘স্মার্ট ইরিগেশন সিস্টেম’ চালু করতে চাই। সোলার বা সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রিক সেচ ব্যবস্থায় নিয়ে যাব। এতে সেচ প্রক্রিয়াটা আরও সহজ হবে। আরও বৃহৎ পরিসরে চাষ করাটা সহজ হবে।”
পাহাড়ে বস্তায় চাষাবাদ থেকে আসা সবজি ঢাকায় নিতে চান না মোস্তফা শিবলী। তিনি বলেন, “পানছড়িতে আমরা ৩০০ থেকে ৫০০ লোকের একটা তালিকা করেছি, যারা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ সবজি পেলে একটু বেশি দামে হলেও কিনবেন। আমাদেরটা তো তুলনামূলক নিরাপদ, সরাসরি কেমিকেল দিয়ে করছি না যেহেতু, কিন্তু কীটনাশক তো দিই, তাই পুরোপুরি নিরাপদ বলছি না। তো, আমরা যে পরিমাণ সবজি উৎপাদন করি, এটাই আমাদের টার্গেট।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জানিয়ে তিনি বলেন, “পুরস্কার পাওয়ার পরে সবচেয়ে বেশি যেটা মনে হয়েছে, যে কাজটা আমরা পরম বিশ্বাস এবং মমতা নিয়ে করছি, যে উদ্দেশ্য নিয়ে করছি, এটাকে যদি সত্যি সত্যি বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলে এটা শুধু আমাদের এই ছোটো খামারে সীমিত রাখলে চলবে না। যেসব কৃষকরা এখনও পাহাড়ে প্রচলিত ভুল পদ্ধতিতে সবজি চাষ বা স্বল্পমেয়াদি কৃষিকাজ করছে, তাদেরকে এই মডেলের প্রতি অনুপ্রাণিত করতে চাই।
“এই পদ্ধতি খুব অপরিচিত না, কমবেশি সবাই এটা জানে। কিন্তু, এটা যে ভূমিধস রোধ করে এবং মাটির দূষণ কমায় এবং তুলনামূলক অনেক বেশি ব্যয় সাশ্রয়ী, এই বিষয়গুলো তাদের বোঝানো, হাতে-কলমে ধরিয়ে দেওয়া, ওদের কিঞ্চিৎ প্রণোদনা দিয়ে কাজটা শুরু করানো এবং ক্রমান্বয়ে এটার প্রচার প্রসার ঘটানো যাতে মানুষ আরও ব্যাপক আকারে চাষ শুরু করে।
“অন্তত একটা অঞ্চলকে আমরা ভূমিধস এবং পানি দূষণ থেকে বাঁচাতে পারি এবং নিরাপদ সবজি উৎপাদন করতে পারি সেটা হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাহায্যে পাহাড়ে এই পদ্ধতি ছড়িয়ে দিতে চাই।”