নিজের জীবন আর পরিবারকে বলি দিয়ে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে যারা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ এনে দিয়েছিলেন, তাদের সেই আত্মত্যাগের শেষ স্মৃতি ভাণ্ডার হয়ে আছে প্রায় দুই বিঘা জায়গার ওপর নির্মিত ভবনটি।
Published : 28 Mar 2025, 08:44 AM
সময়টা ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল। খুলনার রাজাকারদের নিয়ে আবদুস সালাম খানের বাড়ি ঘেরাও করে পাকিস্তানি সেনারা। তবে সালামকে বাড়িতে না পেয়ে তার চার মাসের মেয়ে রেহানাকে নৃশংসভাবে বুটে পিষে দিয়ে যায় হানাদারেরা।
রাতের বেলায় গোপনে বাড়ি ফিরে মেয়ের নিথর দেহ দেখতে পান সালাম। ছোট্ট নিথর দেহে গোসল আর শেষবারের মত আদর দিয়ে ভাসিয়ে দেন রূপসা নদীতে।
রেহানার ছবি ধরে রাখার কোনো সুযোগ তখন ছিল না। স্মৃতি বলতে পরনের জামাটাই রেখে দেন বাবা। যুদ্ধে বিজয়ের পর সেটি ফ্রেমে বাঁধাই করেন। দুই যুগ পর ১৯৯৬ সালে সেটি দিয়ে দেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সালাম খানের বাড়ি খুলনার সেনহাটি এলাকায়। একাত্তরে যুদ্ধে অংশ নিয়ে তরুণদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন তিনি। যুদ্ধে অংশ নেওয়ায় তার পরিবারের ওপর নির্যাতনের খড়গ নেমে এসেছিল, তার স্মৃতি বহন করছে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত রেহানার জামাটি।
স্বাধীনতা সংগ্রামের এমন অনেক স্মৃতি জায়গা পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। ভেতরে বিভিন্ন গ্যালারিতে রাখা সেসব জিনিসপত্র আর পাশে লেখা বিবরণ পড়ে বা শুনে চোখে জল চল আসবে যে কারও। নিজের জীবন আর পরিবারকে বলি দিয়ে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে যারা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ এনে দিয়েছিলেন, তাদের সেই আত্মত্যাগের শেষ স্মৃতি ভাণ্ডার হয়ে আছে প্রায় দুই বিঘা জায়গার ওপর নির্মিত ভবনটি।
সেখানে ইতিহাসের বিপুল সম্ভার রয়েছে। জীবন্ত ইতিহাস তুলে ধরতে রয়েছে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা। বইয়ের পাতায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়া তরুণ প্রজন্ম অসংখ্য দলিল-দস্তাবেজ আর তথ্য-প্রমাণে ভরপুর সমৃদ্ধ এই জাদুঘরে প্রবেশ করলে ‘ইতিহাসের মধ্যে দিয়েই হেঁটে যায়’ বলে মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও গবেষক মফিদুল হক।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “একটা হচ্ছে জাদুঘরের ভাণ্ডার, আরেকটা হচ্ছে জাদুঘরের প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর একটা বড় দিক হল আমাদের সামনে ইতিহাসটাকে উপস্থাপন করে। উপস্থাপনার ক্ষেত্রে সবসময় আমাদের যেটা কমিটমেন্ট, ফ্যাক্টস অ্যান্ড এভিডেন্স, তথ্য দলিলের মাধ্যমে বাস্তব যে চিত্র, সেটা মেলে ধরা।
“নতুন জাদুঘরে অনেক জায়গা পাওয়া গেছে প্রদর্শনীর জন্য। আমরা যেটা দেখি যে এটা দর্শনার্থীদের ওপর অনেক প্রতিক্রিয়াও সঞ্চার করে। এখন তো তরুণ প্রজন্ম সংখ্যাগরিষ্ঠ আমাদের জনসংখ্যার মধ্যে। তো, জাদুঘরে আসলে তারা ইতিহাসের মধ্যে দিয়েই হেঁটে যায়। দীর্ঘ একটা অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আমরা এটা দেখেছি। আর দেশের বাইরেও যারা আছে, তারাও এটাকে খুব অ্যাপ্রিশিয়েট করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবেও এটার একটা স্বীকৃতি আছে। বলা যায় যে একটা আন্তর্জাতিক মানের জাদুঘর তৈরি করা গেছে।”
মফিদুল হক বলেন, “যে ভাণ্ডারটা আমাদের আছে, সেখানে অনেক ধরনের দলিল, ব্যক্তিগত স্মারক, অফিসিয়াল, সেমি-অফিসিয়াল চিঠিপত্র, কাগজ এইসব আছে। সেটা গবেষকদের জন্য দরকার। আমরা চাইব আরও বেশি গবেষক এখানে আসুক, এটা ব্যবহার করুক। আমরাও সমর্থন দেওয়ার চেষ্টা করি।”
‘কত কিছু যে অজানা, টের পাচ্ছি’
বইয়ের পাতা, ভিডিও কিংবা সিনেমা থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা তরুণ প্রজন্মের ধারণা বদলে দেবে আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। মঙ্গলবার সেখানে আসা তিন তরুণ এমনটাই বলছিলেন।
রাসেল নামে এক শিক্ষার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে এসে মুক্তিযুদ্ধের অনেক নিদর্শন দেখতে পেয়েছি। মনে হল নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের পাঠ নিচ্ছি। কত কিছু যে অজানা, তা এখানে এসে টের পেলাম।”
আরেক শিক্ষার্থী রাশেদুন্নবী সবুজ বলেন, “একাত্তরের কথা শুধু বই-পুস্তকে পড়েছিলাম। এখানে এসে দেখলাম আমাদের ইতিহাস, আমাদের ঐতিহ্য। জানলাম অনেক অজানা গল্প৷ কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ দিতেই হয় এমন পরিচ্ছন্ন পরিবেশ আর বিস্তৃত দুর্লভ সংগ্রহের জন্য।”
নিজের ১০ বছরের সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর দেখাচ্ছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী হামিদুর রহমান। তিনি বলেন, “অন্য জাদুঘরগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন আছে। তবে একসঙ্গে এত বেশি নিদর্শন বোধ করি আর কোথাও নেই। বাচ্চাটা যাতে জানতে পারে, ছোট থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করতে শেখে, তাই নিয়ে আসা।”
২৯ বছরের যাত্রা
বেসরকারি উদ্যোগে রাজধানীর সেগুনবাগিচার একটি ভবন ভাড়া নিয়ে সংস্কারের পর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ। আটজন ট্রাস্টির উদ্যোগে ইতিহাসের স্মারক সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও উপস্থাপন উপযোগী করা হয় ভবনটিকে।
ট্রাস্টিরা হলেন- স্থপতি ও কবি রবিউল হুসাইন, গবেষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মফিদুল হক, নাট্যব্যক্তিত্ব ও সাবেক সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর, নাট্য ব্যক্তিত্ব আলী যাকের, তার স্ত্রী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সারা যাকের, প্রকৌশলী ও সমাজকর্মী জিয়াউদ্দীন তারিক আলী, চিত্রকলা বিশ্লেষক, সংগ্রাহক ও গবেষক আক্কু চৌধুরী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সারওয়ার আলী।
সেগুনবাগিচার বাড়িটিতে পথচলা শুরু হলেও ধীরে ধীরে সংগ্রহ বাড়তে থাকায় জায়গা সংকুলান হচ্ছিল না। পরবর্তীতে আগারগাঁও এলাকায় জাদুঘর ট্রাস্টের অনুকূলে দশমিক ৮২ একর ভূমি বরাদ্দ দেয় সরকার। এরপর ২০০৯ সালের নভেম্বরে উন্মুক্ত স্থাপত্য নকশা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্থাপত্য নকশা চূড়ান্ত করা হয়।
দু্ই বছর পর ২০১১ সালের ৪ মে নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হলেও ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন ভবন, যেটি তৈরিতে খরচ হয় ১০২ কোটি টাকা।
জাদুঘরের উদ্যোগ নেওয়ার শুরু থেকেই ট্রাস্টিরা সাধারণ জনগণের কাছে স্মারক সামগ্রী, আর্থিক অনুদান এবং অন্যান্য সাহায্যের আবেদন করলে ব্যাপক সাড়া পান। ১৯৯৯ সাল থেকে জাদুঘরের জন্য বার্ষিক থোক বরাদ্দ দিয়ে আসছে সরকার। এ ছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্য অর্থ সাহায্য দিয়েছে।
দেয়ালে দেয়ালে ইতিহাসের পাঠ
প্রায় দুই বিঘা জায়গার ওপর নির্মিত জাদুঘর ভবনটির ব্যবহারযোগ্য জায়গার পরিমাণ ১ লাখ ৮৫ হাজার বর্গফুট। ভবনটিতে ছয়টি গ্যালারি রয়েছে। এর মধ্যে ২১ হাজার বর্গফুটের চারটি স্থায়ী গ্যালারি রয়েছে। জাদুঘর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান গ্যালারিতে নিদর্শন উপস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে।
বর্তমানে জাদুঘরের সংগ্রহ ভাণ্ডারে রয়েছে ১৬ হাজারের বেশি স্মারক। ভবনে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে ‘শিখা চির-অম্লান'। ঠিক তার বাঁ পাশেই সিলিংয়ের নিচে বিশেষ কায়দায় বসানো ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি হান্টার যুদ্ধবিমান, যেটি ব্যবহৃত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। ১৯৯৮ সালে ভারতীয় বিমানবাহিনী মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে এটি স্মারক হিসেবে দেয়।
ভবনের চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় গ্যালারিগুলো রয়েছে। প্রথম গ্যালারির নাম ‘আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সংগ্রাম’। সেখানে প্রাচীন কাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সময়ের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে।
এর মধ্যে চর্যাপদের তালপাতার পুঁথি, ১৫০০ থেকে ১৬০০ শতকের পোড়ামাটির ফলক, সাঁওতাল বিদ্রোহ, তিতুমীরের আন্দোলনের বর্ণনাখচিত আলোকচিত্র, বিভিন্ন সময়ে খনন করে পাওয়া টেরাকোটা, ফসিল, মৃৎপাত্র ও শিলাখণ্ড রয়েছে। এ ছাড়া সিপাহী বিদ্রোহে জড়িতদের নির্বাসন দেওয়া কুখ্যাত ‘আন্দামান সেলুলার জেলের' আলোকচিত্র, ঔপনিবেশিক শাসনের দীর্ঘ পর্বের আঁকা চিত্র, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ঋণ সালিশী বোর্ডের নথিপত্র রয়েছে। জাতীয় কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘ধূমকেতু' পত্রিকার কাটিং, ঢাকাই মসলিন শাড়ি, ৪৭ সালের দেশভাগের নানা আলোকচিত্র, দলিল-দস্তাবেজও রয়েছে।
দ্বিতীয় গ্যালারির নাম ‘আমাদের অধিকার, আমাদের ত্যাগ’। এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনাপ্রবাহের তথ্য, আলোকচিত্র আর স্মারকের দেখা মেলে। এই গ্যালারিতে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ঘটনা থেকে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় প্রবাসী সরকার গঠনের পর্ব পর্যন্ত রয়েছে।
এই গ্যালারিতে শব্দ ও আলোর প্রক্ষেপণের একটি বিশেষ প্রদর্শনী আছে। এতে ২৫ মার্চ বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার বর্বরতা তুলে ধরা হয়েছে। রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের আলোকচিত্র, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণের ঐতিহাসিক চেয়ার ও রেপ্লিকা, ৪ এপ্রিল কুষ্টিয়ার যুদ্ধ এবং সারা দেশের গণহত্যার নিদর্শন রয়েছে এই গ্যালারিতে।
একটি ডিসপ্লে বোর্ডে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্যচিত্র ও ৭ মার্চের ভাষণ প্রদর্শিত হচ্ছে। খুলনার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালামের ছোট্ট মেয়ে রেহানার সেই জামাটাও এই গ্যালারিতে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের শার্ট, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কোট ও লাইটার, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর পাঞ্জাবি, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামানের পাঞ্জাবি ও চশমাও রয়েছে সেখানে। এ ছাড়া একাত্তরে নিহত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের বায়নাকুলার ও জামা, নতুন চন্দ্র সিংহের ছড়ি, কোট, বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধে ২ এপ্রিল জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে চিঠি লেখার টাইপরাইটার, একাত্তরে নিহত বিউটি বোর্ডিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রহ্লাদ সাহার ব্যবহৃত থালা, গ্লাস, মধুর ক্যান্টিনের মধুসূদন দের জামাও সংরক্ষিত রয়েছে।
এ ছাড়া উদ্বাস্তু হয়ে পড়া বাঙালিদের শরণার্থী হিসেবে ভারতে যাত্রা, সেখানে আশ্রয়, জীবনযাপনের আলোকচিত্র, পুড়িয়ে দেওয়া ঘর-বাড়ির স্মৃতিচিহ্ন, মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত রাইফেল, মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত জিপ গাড়িও রয়েছে।
এরপর উঠতে হবে পঞ্চম তলায়, সেখানে রয়েছে তৃতীয় ও চতুর্থ গ্যালারি। যার নাম দেওয়া হয়েছে- ‘আমাদের যুদ্ধ, আমাদের মিত্র’ এবং ‘আমাদের জয়, আমাদের মূল্যবোধ’। মুক্তিযুদ্ধের অনেক দুর্লভ ও মূল্যবান নিদর্শন রয়েছে সেখানে।
মুক্তিযোদ্ধাদের লিমপেট মাইন ব্যবহারের প্রশিক্ষণের চিত্র, নৌ-কমান্ডদের ব্যবহৃত ফ্লিপার, লিমপেট মাইনের অংশ এবং সাঁতারের সামগ্রী, নিহত নৌ-কমান্ডোদের আলোকচিত্র রয়েছে। বাখুণ্ডা সেতু ধ্বংস অভিযান ও নারীর ভূমিকা খচিত লিপি, মুক্তিযোদ্ধাদের বারুদ, অস্ত্রশস্ত্র আনা-নেওয়া করার নৌকার রেপ্লিকা, মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত ৭.৬২ এমএম রাইফেল জি-৩, একই মডেলের সাব মেশিনগান বা এসএমজি, বুলেটের বাক্স, বিলোনিয়া যুদ্ধের মানচিত্র, ‘চিথলিয়া রেলওয়ে স্টেশনের' গুলিবিদ্ধ নামফলক রয়েছে।
এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত নাইন এমএম এসএমসি স্টেন মেশিন, মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা, শহীদ বুদ্ধিজীবী মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি যে গাড়ি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মালামাল, অস্ত্রশস্ত্র ও খাবারদাবার পৌঁছে দিতেন সেই গাড়িটি, শহীদ বুদ্ধিজীবী আলীম চৌধুরীর পাঞ্জাবি, শহীদ খায়রুল জাহান বীরপ্রতীকের ডায়েরিও রয়েছে।
এ ছাড়া শান্তি কমিটি গঠনের প্যাড, নারী নির্যাতনের চিত্র, বীরাঙ্গনাদের আলোকচিত্র, বুদ্ধিজীবীদের পোশাক, ব্যবহৃত সামগ্রী, মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বিমানবাহিনীর ছত্রীসেনাদের অবতরণ করার প্যারাশুট, মিত্রবাহিনীর যুদ্ধকালীন আলোকচিত্র, পাকিস্তানি বাহিনীর পুড়িয়ে দেওয়া বাড়িঘরের খণ্ডাংশ রয়েছে। আরও রয়েছে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের চিত্র, ১৬ ডিসেম্বরের পত্রিকার কাটিং, শরণার্থী শিবিরের ‘সেই' পাইপ, মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত হেলমেট ও ব্যাগসহ নানাকিছু।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আরও যত কার্যক্রম
‘আউটরিচ কর্মসূচি’ নামে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের একটি কার্যক্রম রয়েছে। এর আওতায় ঢাকা মহানগর এলাকায় শিক্ষার্থীদের পরিবহনযোগে জাদুঘর পরিদর্শনের জন্য নেওয়া হয়। তারা ‘বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস’ শিরোনামে একটি তথ্যচিত্র দেখে, গ্যালারি পরিদর্শন করে, কুইজ পরীক্ষায় অংশ নেয় এবং সবশেষে আলোচনায় মিলিত হয়। এই কর্মসূচির যাত্রা সূচিত হয় ১৯৯৭ সালে।
একইভাবে ‘রিচআউট কর্মসূচি’ও রয়েছে। একটি বড় আকারের বাসকে পরিণত করা হয়েছে খুদে জাদুঘরে। সারা দেশে ভ্রমণ করে বাসটি জেলা উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রদর্শনীর আয়োজন করে থাকে। ২০০১ থেকে ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর বাসটি বিভিন্ন জেলায় যাওয়া শুরু করে। ২০০৩ সাল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রদর্শনী আয়োজন করছে এটি। ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার, শান্তি ও সম্প্রীতির শিক্ষা’ কর্মসূচির আওতায় ভ্রাম্যমাণ জাদুঘরটি শিক্ষার্থীর কাছে বিশেষ উপস্থাপনা করে থাকে।
সেইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিবার-পরিজন ও প্রতিবেশীদের মধ্য থেকে যারা একাত্তরের দিনগুলো প্রত্যক্ষ করেছেন, তাদের কোনো একজনের অভিজ্ঞতার বিবরণী শুনে তা নিজ ভাষায় লিখে জাদুঘরে প্রেরণ করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়।
একাত্তরের ভয়াবহ গণহত্যার বাস্তবতা বিশ্বের কাছে তুলে ধরা এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিচার, তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা আহরণ ও সহায়তা গ্রহণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আন্তর্জাতিক সম্মেলন করে আসছে ২০০৮ সাল থেকে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ২০০৬ সাল থেকে প্রতি বছর সপ্তাহব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রামাণ্যচিত্র উৎসবও করে আসছে। যুদ্ধ, গণহত্যা, মানবাধিকার, শান্তি ও সম্প্রীতি বিষয়ক তথ্যচিত্র এতে প্রদর্শিত হয়। এ ছাড়া প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ ও ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
এর বাইরে প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রয়াত বজলুর রহমান ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বজলুর রহমান স্মৃতিপদক চালু করেছে ২০০৮ থেকে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিকতার জন্য প্রতিবছর সংবাদপত্রের জন্য একজন এবং ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের জন্য একজনকে এই পদক দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আন্তর্জাতিক জাদুঘর সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন অব সাইটস অব কনসায়েন্স’ এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব মিউজিয়ামের সদস্য। ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব মিউজিয়াম (আইকম)- বাংলাদেশের সদস্য।
১৯৯৯ সালে সেনাবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিরপুরে মুসলিম বাজার ও জল্লাদখানা বধ্যভূমি খননের কাজ সম্পন্ন করে এবং ২০০৮ সালে জল্লাদখানা বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিপাঠ নির্মাণ করে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রয়েছে গ্রন্থাগার ও তথ্য ভাণ্ডার এবং অডিও-ভিজ্যুয়াল সেন্টার।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ব্যবস্থাপক (কর্মসূচি) রফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এলে মানুষ এখানে প্রদর্শিত প্রায় ১৫০০০ থেকে ১৬০০০ স্মারক বা নিদর্শন দেখতে পারবে। এর বাইরে আমাদের আউটরিচ কর্মসূচি, রিচআউট কর্মসূচি আছে। ফিল্ম সেন্টার আছে, জেনোসাইড অ্যান্ড জাস্টিস সেন্টার আছে।
“প্রায় ১৬ হাজারের মত স্মারক আমাদের সংগ্রহে আছে। বিষয়কেন্দ্রিক গুরুত্বপূর্ণ স্মারকগুলো প্রদর্শিত হয়। আর মাঝেমধ্যে বিশেষ প্রদর্শনী হলে তখন আর্কাইভ থেকে সংগ্রহগুলো প্রদর্শন করা হয়।”
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আগুন
গত ১০ মার্চ সকালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জেনারেটর কক্ষে আগুন লাগে। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। তাতে বড় ধরনের ক্ষতি না হলেও জেনারেটর রুমের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়।
আগুনের কারণ ও ঘটনার তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, “আমরা তিনটা প্রতিষ্ঠানের এক্সপার্টদের দিয়ে দেখিয়েছি। প্রাথমিকভাবে ফায়ার সার্ভিস একটা তাৎক্ষণিক পর্যবেক্ষণের কথা বলেছিল। তারপরে আমরা ফায়ার সার্ভিস এবং বুয়েটকেও আমরা চিঠি দিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তারাও দেখে গেছে। তারা উভয়েই তদন্ত প্রতিবেদন শেষ করেছে।
“বাইরের একটা কনসালটেন্সিও আমরা নিয়েছিলাম। তবে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে এটা বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকেই ঘটেছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেলে বলা যাবে। ঈদের পরে হয়ত পাব।”