“প্রতিবাদ করার স্পর্ধাটি সন্জীদা খাতুন পেয়েছিলেন পিতৃগৃহে," বলেন সারওয়ার আলী।
Published : 26 Apr 2025, 01:31 AM
যে ছায়ানট ঘিরে ছিল তার বসবাস, সেই ছায়ানট ভবনেই স্মরণ করা হলো বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে কিংবদন্তিতুল্য; গবেষকদের চোখে বিস্ময় জাগানিয়া ব্যক্তিত্ব সন্জীদা খাতুনকে।
নৃত্যগীত, পাঠ আর কথামালায় উঠে এলো সন্জীদা খাতুনের বর্ণাঢ্যজীবনের নানা গল্প। গেয়ে শোনানো হলো তার প্রিয় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আর লালনের গান৷
সন্জীদা খাতুনকে নিবেদিত কথনে নতুন করে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী বলেন, "সংস্কৃতি ভুবনের এক নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে দুর্গম পথের যাত্রা অব্যাহত রেখেছিলেন সন্জীদা খাতুন। তার ছায়াটা সরে গেল।"
গত ২৫ মার্চ ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে জীবনের বিপুল যাত্রা সাঙ্গ করেন সন্জীদা খাতুন।
ছয় দশকেরও বেশি সময় আগে কবি সুফিয়া কামালের স্নেহছায়ায় সন্জীদা খাতুন ও ওয়াহিদুল হকসহ কিছু সাহসী বাঙালি স্থির প্রত্যয়ে যাত্রা শুরু করেন। তারা গান ও সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে সর্বজনের মাঝে বাঙালি জাতিসত্তাকে হৃদয়ে ধারণের প্রয়াস নেন।
তার মৃত্যুতে কেবল ছায়ানট, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, ব্রতচারী কিংবা কণ্ঠশীলন নয়, বরং আবহমান বাঙালির সংস্কৃতিকে যারা আগলে রাখতে চান, তারা সবাই এ মহীরুহের ছায়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে মনে করেন সারওয়ার আলী।
ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি বলেন, "পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন করা, রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ করলে প্রতিবাদ করা কিংবা নজরুল খণ্ডিত হলে প্রতিবাদ করার স্পর্ধাটি সন্জীদা খাতুন পেয়েছিলেন তার পিতৃগৃহে।"
"তিনি স্পর্ধা ও সাহস নিয়ে সংগীত বিদ্যায়তন গড়েছেন। যখন বিনোদন হয়েছে বাণিজ্যনির্ভর, তখন তিনি শিল্পী তৈরি করেছেন। ২০০১ সালে যখন অপশক্তি রমনা বটমূলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় তখন তিনি বললেন, 'শুধু গান গেয়ে কাজ হবে না, শিক্ষার প্রতি নজর দিতে হবে'। এরপর গড়লেন নালন্দা বিদ্যালয় বটবৃক্ষটি চলে গেছেন। অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক মানুষের ভরসাস্থল ছিলেন সন্জীদা খাতুন।"
'নতুন করে পাব বলে' শিরোনামে সন্জীদা খাতুনকে ঘিরে শুক্রবার এ স্মরণানুষ্ঠান আয়োজন করে ছায়ানট, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, নালন্দা, কণ্ঠশীলন ও ব্রতচারী।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ঢাকার ছায়ানট মিলনায়তনের এ অনুষ্ঠানের শুরুতে শিল্পীরা গেয়ে শোনান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্মেলক নৃত্যগীত 'কোন্ আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে'।
পরে বক্তব্য দেন ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী। এরপর অনুষ্ঠানে সম্মেলক কণ্ঠে শিল্পীরা শোনান 'পান্থ তুমি পান্থ জনের সখা' গানটি। এছাড়া সন্জীদা খাতুনের লেখা প্রবন্ধ 'একুশ আমাকে ভাষা দিয়েছে' থেকে অংশবিশেষ পাঠ করেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'মালা হতে খসে পড়া' একক কণ্ঠে পরিবেশন করেন তানিয়া মান্নান।
অনুষ্ঠানে স্মরণ বক্তব্যে ছায়ানটের উপদেষ্টা মফিদুল হক বলেন, "আজকে আমরা সবাই মিলে স্মরণ করছি এবং আজকে আমরা সমবেত শুধু সকলেই নয়, সারাদেশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অগণিত মানুষ তার প্রয়াণের দিন থেকেই তাকে স্মরণ করছে। এমন একজন মানুষ আমাদের মধ্যে ছিলেন, যাত্রাপথের আনন্দ গান নিয়েই তিনি আজীবন পথপরিক্রম করেছেন।"
সন্জীদা খাতুন বাঙালি হওয়ার দীক্ষা খুঁজে ফিরেছেন এবং তার উৎস হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথকে নিজের অন্তরে ধারণ করতে পেরেছিলেন বলেও মনে করে মফিদুল হক।
অনুষ্ঠানে আবৃত্তিতে ছিলেন জহিরুল হক খান। রোকাইয়া হাসিনা নীলি একক কণ্ঠে শোনান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'আরো আরো প্রভু, আরো আরো'। মহিউজ্জামান চৌধুরী শোনান 'যেতে যেতে একলা পথে'।
সন্জীদা খাতুনের লেখা প্রবন্ধ 'স্বাধীন বাংলাদেশের সংস্কৃতিভাবনা' অংশবিশেষ পাঠ করেন সুমনা বিশ্বাস।
খায়রুল আনাম শাকিল শোনান কাজী নজরুল ইসলামের 'পাষাণের ভাঙালে ঘুম', ইফ্ফাত আরা দেওয়ান শোনান 'তোমারই তুলনা তুমি প্রাণ', শারমিন সাথী ইসলাম ময়না শোনান 'ফেলে যাবে যদি জানি', প্রমীলা ভট্টাচার্য্য শোনান 'কে যেন আমারে বারে বারে চায়', এ টি এম জাহাঙ্গীর শোনান 'এবার আমায় ডাকলে দূরে'।
অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয় গুরুসদয় দত্তের লেখা ও সুর করা ব্রতচারী গান 'আয় মোরা সবাই মিলে'। নালন্দা উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিবেশনায় ছিল 'সবারে বাস্ রে ভালো'।
এছাড়া বিমান চন্দ্র বিশ্বাস শোনান 'আমি অপার হয়ে বসে আছি'। সম্মেলক কণ্ঠে শিল্পীরা শোনান 'আপনাকে এই জানা আমার'।
পরে বুলবুল ইসলাম শোনান 'আমি চঞ্চল হে' এবং লাইসা আহমদ লিসা শোনান 'আমি বাঁধিনু তোমার তীরে'।
ত্রপা মজুমদার পাঠ করেন সন্জীদা খাতুনের লেখা 'প্রসঙ্গ: মুক্তিযুদ্ধ' প্রবন্ধের অংশবিশেষ।
সম্মেলক শিল্পীরা শোনান 'শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে' এবং সবশেষে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনায় শেষ হয় অনুষ্ঠান। সঞ্চালনায় ছিলেন জয়ন্ত রায়।
যন্ত্রানুষঙ্গে তবলায় ছিলেন গৌতম সরকার ও স্বরূপ হোসেন, সেতারে ফিরোজ খান, কিবোর্ডে রবিন্স চৌধুরী, বাঁশিতে মামুনুর রশীদ, মন্দিরায় প্রদীপ কুমার রায়।
শেষবার যাবেন সন্জীদা খাতুন, শোকজর্জর ছায়ানট তারই অপেক্ষায়