টিকেটের মূল্য বাড়ানোর পর একেকজনের কাছ থেকে একেকরকম ফি নেওয়া হচ্ছে, বলছেন দর্শনার্থীরা।
Published : 08 Jul 2024, 09:01 AM
ঢাকার মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান বা বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্রবেশে শনিবার টিকেট মূল্য ৫০ টাকা রাখলেন কাউন্টারকর্মী, তবে ভেতরে প্রবেশের পর জানা গেল ভিন্ন তথ্য।
দর্শনার্থীদের কেউ কেউ বলছিলেন, তাদের কাছ থেকে ১০০ টাকা নেওয়া হয়েছে টিকেট কাউন্টারে; আবার কেউ বলছিলেন, ৫০ টাকা দিয়েই ভেতরে প্রবেশ করেছেন তারা।
আগে ২০ টাকা টিকেট ফি রাখা হলেও বৃহস্পতিবার থেকে বাড়িয়ে ১০০ টাকা করা হয়েছে। ১২ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে ফি ধরা হয়েছে ৫০ টাকা।
অপরদিকে উদ্যানে শরীর চর্চার জন্য যাওয়া ব্যক্তিদের আগে ফি না লাগলেও এখন তাদের বাৎসরিক কার্ড করে নিতে হবে। এর জন্য দিতে হবে ৫০০ টাকা। আবার ভেতরে তাদের অবস্থান করা যাবে মাত্র এক ঘণ্টা।
একলাফে টিকেটের দাম পঁচগুণ বাড়ানো নিয়ে ‘অসন্তোষের’ মধ্যে কাউন্টারে দামের এমন হেরফেরের কারণে ‘হতাশা’ প্রকাশ করলেন উদ্যানে আসা দর্শনার্থীরা।
শনিবার দুপুর ১২টার দিকে উদ্যানের কাউন্টারের সামনে এক তরুণকে বলতে শোনা গেলে- “এত্ত দাম কেন?”
তার সঙ্গে থাকা এক তরুণীও বলছিলেন, “এত টাকা দিয়ে ভেতরে যাওয়ার দরকার নেই।”
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এশিয়া প্যাসিফিকের শিক্ষার্থী সিন্থিয়া দুই বান্ধবী নিয়ে শনিবার পুরান ঢাকা থেকে প্রথমবার ঘুরতে আসেন উদ্যানে। তাদের কাছ থেকেও টিকেটের দাম রাখা হয়েছে ১০০ টাকা।
অনেকের কাছ থেকে ৫০ টাকা রাখা হচ্ছে শুনে সিন্থিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দামে এমন বিভ্রান্তি কেন! টিকেটের দাম ৫ গুণ বাড়িয়ে ১০০ টাকা করা একেবারেই বাড়াবাড়ি।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শেখ মোহাম্মদ এসেছিলেন মা ও বোনকে নিয়ে। তাদের তিনজনের কাছ থেকেই প্রবেশমূল্য রাখা হয়েছে ৫০ টাকা।
কারও কাছ থেকে ১০০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে শুনে তিনি বললেন, “এত দাম হলে তো আর কেউ আসবে না, লোকসানে পড়লে তারা ঠিকই দাম কমাতে বাধ্য হবে।”
আরেক দর্শনার্থী ইমন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দাম বাড়িয়ে কোনো লাভ তো নেই, এতে করে যারা নিয়মিত আসেন তারা আসা বন্ধ করে দেবে।”
উদ্যানে আসা জাপান ফাউন্ডেশনের ফিজিওথেরাপির শিক্ষার্থী সৈকতের ভাষ্য, “এরা তো নিজেদের মনমতো টিকেটের দাম রাখছে। সবার কাছ থেকে তো একই দাম রাখার কথা।”
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বোটানিক্যাল গার্ডেন ইজারার মাধ্যমে পরিচালনা করছে ‘সাগর এন্টারপ্রাইজ’।
দামের হেরফেরের প্রসঙ্গে কাউন্টারে টিকেট বিক্রয়কর্মী নাম প্রকাশ না করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারিভাবে দাম বাড়াতে বলা হয়েছে, তাই বাড়ানো হয়েছে। কারণ বলতে পারব না। আর যারা টাকা নেই বলছেন এবং ১০০ টাকায় প্রবেশ করতে পারছেন না, তাদের ৫০ টাকার টিকেট দিচ্ছি। সাহায্য করার জন্যই মূলত এই ডিসকাউন্ট দেওয়া হচ্ছে।”
জানতে চাইলে সাগর এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী জাহাঙ্গীর আলম টিয়া সাংবাদিকদের বলেন, "সরকার তো টিকিটের দাম উল্লেখ করেই প্রজ্ঞাপন জারি করেছে আর আমরাও দেখেশুনেই টেন্ডার দিয়েছি।"
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "ইজারা পেতে ভ্যাট ট্যাক্স ছাড়া ৩ কোটি ৭ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। আর ৩৫ শতাংশ ভ্যাট ট্যাক্স যোগ করে এই অর্থ দাঁড়ায় ৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা।"
টিকিটের মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া নিয়ে জানতে চাইলে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের (বোটানিক্যাল গার্ডেন) পরিচালক শওকত ইমরান আরাফাত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল তার উপর ভিত্তি করে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা কেবল তা বাস্তবায়ন করছি।"
দাম নির্ধারণে সঙ্গে ইজাদারদের কোন সম্পর্ক নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, "টিকিটের মূল্য তো রাজস্ব, আর রাজস্ব নির্ধারণের ক্ষমতা কেবল অর্থ মন্ত্রণালয়ের আছে। ইজারাদারদের কাজ শুধু দর্শনার্থীদের উদ্যানে প্রবেশ ও বের করা, যার জন্য তাদের টেন্ডার দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া তাদের সরকার নির্ধারিত রাজস্ব বা রেভিনিউ জমা দিতে হবে।"
ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতাদের ‘মাথায় হাত’
১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত বোটানিক্যাল গার্ডেনটি প্রায় ৮৪ হেক্টর এলাকা জুড়ে। প্রায় ৫০ হাজার প্রজাতির গাছপালা রয়েছে সেখানে।
আগে উদ্যানে দর্শনার্থীদের ভিড় বেশি হলেও টিকেটের মূল্য বাড়ার পর কমেছে দর্শনার্থী, যার প্রভাব পড়েছে স্থানীয় ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতাদের আয়ে।
উদ্যান ঘিরে স্থানীয় অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করেন। কেউ আসেন ফুল নিয়ে, কেউ বসেন ওজন মাপার মেশিন নিয়ে।
এমনই একজন ফুল বিক্রেতা মোহাম্মদ বাসার জানালেন, তার বিক্রি কমে গেছে অর্ধেকের বেশি।
“দুই ঘণ্টা ধইরা বইসা আছি মাত্র পাঁচটা ফুল বিক্রি হইছে। মানুষ ফুল কেনবে কী দিয়া, টিকেটের দামেই তো টাকা শেষ।”
বাসারের মত একই অবস্থা জাহানারা বেগমের। দর্শনার্থীদের ওজন মেপেই চলে তার সংসার।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এই নারী বলেন, “আগে দিনে ৬০০ টাকার বেশি ইনকাম হইত। আর আজকে (শনিবার) সকাল থেকে মাত্র ৬০ টাকা হইছে।
“আগে পরিবার নিয়া অনেকেই আসত। তারা ওজন মাপলে একলগেই ৭০/৮০ টাকা পাইতাম। (টিকেটের) টাকা বাড়াইয়া কার লাভ হইল বুঝি না।”
টিকেটের দাম বৃদ্ধিতে দর্শনার্থী কমে যাওয়ায় প্রভাব পড়েছে উদ্যানের আশেপাশের দোকানেও।
উদ্যানের ভেতরে খাবারের দোকান ক্যামেলিয়ায় দুদিন আগেও বসার জায়গা পাওয়া কঠিন হলেও এখন ডাকাডাকি করেও খদ্দের মিলছে না বলে জানালেন বিক্রয়কর্মী জাফর হোসেন।
তার ভাষ্য, “সব ব্যবসা শেষ। মানুষ নাই, আগে ১০ হাজারের বেশি লোকজন এসেছে, আজকে (শনিবার) ২ হাজারও হবে না।”
এর আগে উদ্যানের টিকেট কাউন্টার পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন মোহাম্মদ ফিরোজ। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমি আগে তিনবার এই দায়িত্বে ছিলাম। কোভিডের সময় ছাড়া বাকি বছর আমার কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে টিকেটের দাম বাড়ায় এবার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।”
টিকেটের মূল্য বৃদ্ধির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সরকারের নিয়ম নিয়ে আমি কিছুই বলতে পারব না। কেন বেড়েছে, তা আমরা কিছুই জানি না।”
তবে টিকেটের দামে হেরফের নিয়ে তিনি বলেন, “মানুষকে সহায়তা করতেই তো ৫০ টাকা রাখা হচ্ছে অনেকের কাছ থেকে। তারা তো খারাপ কিছু করছে না।”