সরকার পতনের পর ঢাকার দুই সিটিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রায় সব কাউন্সিলর কার্যালয় আক্রান্ত; একটির সামনে দেয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে।
Published : 13 Aug 2024, 01:15 AM
মিরপুর-১৩ নম্বরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সামনে কথা হয় আইডিয়াল স্কুল রোডের বাসিন্দা আজিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি এসেছিলেন জন্ম নিবন্ধন সংক্রান্ত কাজে, কিন্তু তার কাজ কবে হবে সে বিষয়ে কোনো ধারণা ছাড়াই ফিরতে হয়েছে তাকে।
আজিজুর বলেন, “আমার একটি দোকান আছে যেখানে অনেকের জন্ম নিবন্ধনসহ বিভিন্ন কাজের ফরম ফিলাপ করে দেই। কয়েকজনের জন্ম নিবন্ধনের ফরম ফিলাপ করে আমিই দিয়ে গিয়েছিলাম এখানে। রেডি হলে নিয়ে গিয়ে আবার তাদেরকে দিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু ৫ তারিখের পর থেকে কার্যালয় বন্ধ থাকায় কাজগুলো হয়নি। এদিকে যাদের জন্ম নিবন্ধন করানোর কথা তারা তাগাদা দিচ্ছে।”
গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন থেকে সারাদেশে সরকারি বেসরকারি স্থাপনা, বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যে বেপরোয়া হামলা হয়েছে, তা থেকে বাইরে নয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর কার্যালয়ও।
বিএনপির বর্জনের কারণে ভোটে নির্বাচিতরা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগপন্থি, তাদের সবার কার্যালয়ই ভাঙচুর করা হয়েছে; আগুন দেওয়া হয়েছে, অনেক জায়গায় নথিপত্র পুড়ে গেছে, লুট হয়েছে জিনিসপত্র, নিম্ন আয়ের মানুষদের সহায়তার জন্য রাখা জিনিসপত্রও নিয়ে গেছে হামলাকারীরা।
সরকার পতনের পর দুই মেয়র প্রকাশ্যে নেই। ঢাকা উত্তরের মেয়র এম আতিকুল ইসলাম নিশ্চিত করেছেন, তিনি ঢাকায় আছেন। তবে অফিস করছেন না।
আর ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের অবস্থান সম্পর্কে কারও কিছু জানা নেই। যেসব কাজে মেয়রের সই লাগে, সেগুলো নিয়ে কীভাবে কী করা যায়, তা নিয়ে ভাবছেন কর্মকর্তারা।
কাউন্সিলরের কার্যালয়ে প্রতিদিনই মানুষ আসছে, সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, কত দিনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, সেই আশ্বাসও পাচ্ছেন না তারা।
এমন প্রশ্নে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সচিব রাবেয়া আকতার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৬ তারিখ কিছু লোক এসে বাইরের ছবি ভাঙচুর করে তালা মেরে দিয়েছে। সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ। কাউন্সিলর ছাড়া তো এসব কাজ করাও যাবে না। উনার সিগনেচার লাগবে।”
ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র জামাল মোস্তফার হদিস নেই ৫ অগাস্ট থেকেই। তিনি কবে ফিরবেন বা কোথায় আছেন, সেই প্রশ্নেরও জবাব নেই।
ঢাকা উত্তরের ৫৪ জন সাধারণ ও ১৮ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের মধ্যে দুজন করে কেবল চারজন বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত। বাকি সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত।
দক্ষিণের ৭৫ জন সাধারণ ও ২৫ জন নারী আসনের কাউন্সিলরের মধ্যে ১০ জন বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত, একজন স্বতন্ত্র ও একজন বিজেপির রাজনীতিতে জড়িত।
এই পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশনের নাগরিক সেবায় বিঘ্ন ঘটছে; বিশেষ করে ঢাকা উত্তরে ওয়ারিশ সনদ, জন্মনিবন্ধন সনদ, মৃত্যু নিবন্ধন সনদ, নাগরিক প্রত্যয়নসহ কাউন্সিলর অফিস থেকে নিতে হয় তার কিছুই পাচ্ছে না মানুষ।
ঢাকা দক্ষিণে অবশ্য জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সনদ নিয়ে সমস্যা নেই, কারণ এগুলো দেওয়া হয় আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে, সেগুলো চালু আছে।
কাউন্সিলরকে বাধা দিতে কার্যালয়ের সামনে ইটের দেয়াল
দুই সিটির ২০ জন কাউন্সিলরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ৮ জনের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে, ১১ জন কল ধরেননি।
পাওয়া গেছে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর চিত্তরঞ্জন দাসকে। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৫ অগাস্টের আগে-পরে ডিএসসিসির বেশিরভাগ কাউন্সিলর আত্মগোপনে চলে গেছেন। কয়েকজন ঢাকায়, বেশিরভাগই ঢাকার বাইরে চলে গেছেন। বিএনপি এবং স্বতন্ত্র কাউন্সিলর ছাড়া প্রায় সবার অফিসে ভাঙচুর, আগুন দেওয়া হয়েছে।
“আমার কার্যালয় পুরো ভেঙে দিয়েছে। যা কিছু ছিল সবকিছু নিয়ে গেছে, একটা পিনও রাখেনি। যেগুলো নিতে পারেনি সেগুলো কুপিয়ে নষ্ট করে দিয়েছে। গেটের সামনে ইটের দেয়াল দিয়েছে যেন আমি ঢুকতে না পারি।”
তাহলে কীভাবে চলছে কার্যক্রম- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে ২৮ ধরনের প্রত্যয়নপত্র দিতে হয়, কার্যালয় বন্ধ থাকায় সেগুলো দেওয়া যাচ্ছে না। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মশক নিধন কার্যক্রমের ব্যাপারে টেলিফোনে নির্দেশনা দিচ্ছি।”
ভাঙচুরের পাশাপাশি আগুন-লুটপাট
৫ অগাস্ট ঢাকার তেজগাঁওয়ের কলোনিবাজারে ঢাকা উত্তরের (ডিএনসিসি) ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, প্রধান কার্যালয়ের ফটকে তালা ঝুলছে। দোতলা ভবনের নিচতলায় ওয়ার্ড সচিবের রুম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুড়ে গেছে সব কাগজপত্র। সেখান থেকে লুট করা হয়েছে কম্পিউটারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র।
ওয়ার্ড কাউন্সিলর এলাকায় নেই, ওয়ার্ড সচিবও আসেন না। মশক নিবারণ শাখার কর্মীদের একটা অফিস আছে সেখানে। নাজমুল নামে একজন কর্মী বলেন, “প্রতিদিনই লোকজন বিভিন্ন কাজে আসে।”
পল্লবীতে ডিএনসিসির ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ও ভাঙচুর করা হয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, কম্পিউটার, ল্যাপটপ এবং জন্মনিবন্ধনসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রও লুট করা হয়।
ওই ওয়ার্ডের সচিব মো. আবদুস সামাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সব নিয়ে গেছে। আমরা আঞ্চলিক কার্যালয়ে লিখিতভাবে জানিয়েছি, স্যাররা বলেছেন আপাতত কার্যক্রম অফ রাখতে। আর এখানে কাজ করার মত কিছুই নাই। প্রতিদিন অন্তত ৫০ জন মানুষ এসে ঘুরে যায়।”
বাড্ডায় ডিএনসিসির ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিসও ভাঙচুর করা হয় ৫ অগাস্ট।
ওই ওয়ার্ডের সচিব নেসার আহমেদ রাসেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেদিন হামলা করে অফিসের সবকিছু নিয়ে গেছে। নেওয়া হয়েছে টিসিবির চালও।
“চারপাশের দেয়াল ছাড়া অফিসে আর কিছু নেই। অনেকের জন্মনিবন্ধনসহ কিছু সার্টিফিকেট রেডি করা ছিল সেগুলো, আড়াই টন চালের ডিও ছিল গরিব মানুষের জন্য, সেই ডিও নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। কাউন্সিলর নাই, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আমাকে অনেকে ফোন দেয় বিভিন্ন সেবার জন্য। কিন্তু এ অবস্থায় সেবা দেওয়া সম্ভব না।”
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আঞ্চলিক কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়েছিল, ভাঙচুর করা হয়েছে। ব্যবহার করা যাবে না এমন পরিস্থিতি হয়নি। সেখানে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
“নতুন সরকার মাত্র দায়িত্ব নিল। সরকার হয়তো এসব বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেবে। কাউন্সিলরদের কেউ চলে যেতে বলেনি, আবার এই অবস্থায় তাদের আসতে বলবে সেটাও কেমন দেখায়। তারা নির্বাচিত পরিষদ, কোনো সাইকোলজিক্যাল থ্রেটের কারণে যদি অনুপস্থিত থাকেন, সেটা ভিন্ন কথা।”
মেয়ররা কোথায়
ঢাকা উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি ঢাকাতেই আছেন, তবে আপাতত অফিসে যাচ্ছেন না। টেলিফোনে কর্মকর্তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন।
“টেলিফোনে বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজের নিদের্শনা দিচ্ছি। যেসব কাজ আমার হাতে আছে সেগুলো আমি করছি, আমিও চাই সবকিছু স্বাভাবিক হোক। কাউন্সিলররাও তাদের কাজগুলো করুক, জনগণ যেন সেবা বঞ্চিত না হয়।”
সরকার পতনের দাবিতে ডাকা অসহযোগের ডাক দেওয়ার পর তার ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের বিমানে চড়ার একটি ছবি ভাইরাল হয়। পরে জানা যায়, ৩ অগাস্টই তিনি দেশ ছেড়েছেন।
জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "মেয়র স্যার সিঙ্গাপুরে গেছেন সেটা জানি। এরপর কোথায় গেছেন বলতে পারব না।"
মেয়র নেই, এ অবস্থায় যেসব ফাইলে তার সই দরকার, সেগুলো কীভাবে হবে- এই প্রশ্নে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, “তিনি (মেয়র) কখন আসবেন সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আমাদের কার্যক্রম শুরু হয়েছে, মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা মহোদয় যোগ দিয়েছেন। আমাদের সচিব মহোদয় আছেন, উনারদের সঙ্গে পরামর্শ করে অবশ্যই আমরা কাজগুলো করে নেব। কোনো সমস্যা হবে বলে মনে করি না।”
অন্য এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে সিটি করপোরেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি কাজ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং মশক নিধন কার্যক্রম পুরোদমে চলছে।
“কাউন্সিলদের যেসব কাজ আছে সেগুলো তারা আগের নির্ধারিত জায়গায় করতে পারছেন না। তবে যোগাযোগের মাধ্যমে তারা অন্য জায়গা থেকে সেসব সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তারপরও আমাদের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় আছে। নাগরিকরা তাদের সেবার জন্য সেখানে আসতে পারেন।”
জনপ্রতিনিধিরা না এলে কী হবে
এই প্রশ্নে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যারা পালিয়ে আছেন তাদের ফিরে আসার জন্য সরকার একটা সময় বেঁধে দেবে। ওই সময়ের মধ্যে তারা না আসলে, চিঠির উত্তর না দিলে তাদের পদ বাতিল হয়ে যাবে।
“বাতিল হওয়ার পর কাউন্সিলররা মিলে প্যানেল মেয়র নির্বাচন করবেন। আর সেটা না হলে নতুন করে নির্বাচন হবে অথবা প্রশাসক নিয়োগ করতে হবে।”
অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে কী ভাবছে, সে প্রশ্নে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফকে কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
রোববার নিজ দপ্তরে স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মত বিনিময় সভায় তিনি বলেন, আইন ও বিধি-বিধানের আলোকে ভবিষ্যতের উন্নয়ন ও কল্যাণের দিক বিবেচনা করে প্রশাসনিক দায়িত্ব সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হবে।
অফিসে আসছেন না ওয়াসার এমডি
সরকার পতনের আগে-পরে ঢাকা ওয়াসার কোনো স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর হয়নি। তবে ৫ অগাস্ট সায়েদাবাদে ঢাকা ওয়াসার পানি শোধনাগারের ভাঙচুর চালাতে যায় একদল মানুষ। তবে ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের বুঝিয়ে শান্ত করলে তারা ফিরে আসেন।
শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর থেকে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান আড়ালে চলে গেছেন। তবে তিনি দেশেই আছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা ওয়াসার একজন কর্মকর্তা।
সরকার পতনের পর ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশ তাকসিম এ খানসহ কয়েকজন কর্মকর্তাকে ওয়াসা ভবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ কারণে তাকসিম এ খানসহ শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা ওয়াসা ভবনে আসছেন না।
নামপ্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, “এমডি স্যার ঢাকাতেই আছেন। রোববার অফিসে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সকালেই একদল কর্মচারী স্যারের রুমের সামনে গিয়ে হট্টগোল করে এসেছে। এছাড়া এমডি স্যারের আশপাশে যারা আছেন এমন কর্মকর্তাদেরও হুমকি দিয়েছেন। এ কারণে স্যার আসেননি। আমাদের দাপ্তরিক কাজ মোটামুটি চলছে। খুব ব্যাহত হচ্ছে না।”
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে তাকসিম এ খানের মোবাইল ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে কল দিলেও তিনি ধরেননি।