কথা ছিল সচিবালয় ও আশেপাশের এলাকাকে ‘নীরব’ করে হাত দেওয়া হবে নগরীর অন্য এলাকায়। প্রাধান্য পাবে হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, এমন এলাকা। কিন্তু ‘বিসমিল্লায় গলদে’ আটকে গেছে বাকি সব কাজ।
Published : 08 Jun 2023, 01:52 AM
সাড়ে তিন বছর আগে সচিবালয়ের চারপাশকে ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা করেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। ওই এলাকায় হর্ন বাজানো নিষেধ থাকলেও কেউ তা মানেন না, আসলে জানেই না বেশিরভার মানুষ।
সেখানকার শব্দ দূষণের মাত্রা আগের মতই থেকে গেছে। কয়েক দফা ভ্রাম্যমাণ আদালত চালিয়েও সুফল মেলেনি।
তীব্র শব্দ দূষণের এই নগরের বাসিন্দাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে এই এলাকাটিকে ‘নীরব করে’ পরে ধাপে ধাপে নগরের অন্য এলাকাকেও একই ব্যবস্থাপনার আওতায় আনার পরিকল্পনা ছিল। কথা ছিল হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে– এমন এলাকাগুলোতে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
কিন্তু ‘বিসমিল্লায় গলদে’ আটকে গেছে বাকি সব কাজ। এখন সরকার শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা সংশোধন করে হর্ন বাজানোর শাস্তি বাড়ানোর চিন্তা করছে।
২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর সচিবালয় এলাকাকে ‘নীবর’ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে এর চারপাশের সড়কে হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ করা হয়।
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) দেখতে পায় ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণার পর এক বছরে সচিবালয় এলাকায় শব্দ দূষণ বেড়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ।
গবেষণার সময় পল্টন মোড়ে সবচেয়ে বেশি ১২৯ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ পাওয়া যায়। সচিবালয়ের উত্তর-পশ্চিমে ও সচিবালয় মধ্য-পূর্বে পাওয়া যায় এক ডেসিবল কম।
কদম ফোয়ারা, জিরো পয়েন্টে, সচিবালয় উত্তরে ও শিক্ষা ভবন, সচিবালয় দক্ষিণ-পূর্বে, সচিবালয় ১ ও ৩ নম্বর গেইটে ১২৬ ডেসিবেল এবং প্রেসক্লাব এলাকায় শব্দের মাত্রাও কাছাকাছি।
হর্নের অত্যাচার: যাদের দেখার কথা, কানেই যেন যায় না তাদের
৯ গাড়ির সাতটিই ছড়ায় দূষণ, উচ্চ মাত্রার হর্ন ‘সবগুলোতেই’
শব্দ দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ১১.৮% ট্রাফিক পুলিশের শ্রবণশক্তি: সমীক্ষা
ওই এলাকায় দিনের বেলায় সর্বোচ্চ সীমার চেয়ে অনেক বেশি শব্দ থাকে। ওই এলাকায় উচ্চ শব্দের মূল উৎস যানবাহনের হর্ন, ইঞ্জিন ও ব্রেক করার শব্দ।
বিধিমালা অনুযায়ী, নীরব এলাকায় দিনে (ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা) শব্দের মাত্রা ৫০ ডেসিবলের নিচে এবং রাতে (রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা) ৪০ ডেসিবেলের নিচে থাকার কথা। কিন্তু সচিবালয় এবং আশেপাশে কোথাও দিনের বেলায় ১২৪ ডেসিবলের কম মাত্রায় শব্দ পাওয়া যায়নি।
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার জানান, ২০২০ সালের পর আরও কয়েকবার সচিবালয় এলাকায় শব্দের মাত্রা নিয়ে গবেষণা হয়েছে। সব গবেষণাতেই উঠে এসেছে যে সচিবালয় এলাকায় শব্দের মাত্রা বেড়েছে। এলাকাটি নীরব হয়নি।
সচিবালয় এলাকাকে নীরব না করতে পারার পেছনে দুটি কারণের কথা বলছেন আহমদ কামরুজ্জামান। “প্রথমত, মানুষ ভালোভাবে জানে না যে সেটি ‘নীরব’ এলাকা। দ্বিতীয়ত, এলাকাটি খুবই ব্যস্ত, আর ব্যস্ত এই এলাকায় যে হর্ন দেওয়া যাবে না, সে বিষয়ে মানুষ সচেতন নয়।”
তার মতে, ঘোষিত নীরব এলাকার সড়ক সাদা বা সবুজ রঙ করে দিলে সবাই সহজে বুঝতে পারত যে সেখানে শব্দ করা যাবে না। পরীক্ষামূলকভাবে এই কাজটা করা যায় বলেও মনে করেন তিনি।
বাড়বে হর্ন বাজানোর শাস্তি
সচিবালয় এলাকাকে নীরব হিসেবে ঘোষণার পর শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে ওই এলাকাসহ সারাদেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে পরিবেশ অধিদপ্তর।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে ৬৮৬টি ভ্রাম্যমাণ আদালত চালিয়ে তিন হাজার ২৮৫টি মামলা দেওয়া হয়। শব্দদূষণের দায়ে ৩৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকা জরিমানা করে সঙ্গে সঙ্গে তা আদায় করা হয়।
আর জব্দ করা হয় ব্যবহার দুই হাজার ২৭০টি হর্ন, যেগুলো ব্যবহার করার অনুমতি নেই। দূষণের নিয়ে মানুষকে সচেতন করতে গণপরিবহনে স্টিকার লাগানো হয়, বিলি করা হয় লিফলেট।
ভ্রাম্যমাণ আদালত চালিয়েও শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা সংশোধন করে হর্ন বাজানোর শাস্তি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবদুল হামিদ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য টিভিসি তৈরি করা হয়েছে, বিভিন্ন টেলিভিশনের তা প্রচার করা হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। হাইড্রোলিক হর্ন বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় যে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে এটিকে সংশোধন করে আপডেট করার চেষ্টা করছি।”
বিশ্বে শব্দ দূষণের শীর্ষে ঢাকা
শব্দ দূষণে কানের সমস্যায় ৪২ শতাংশ রিকশাচালক: গবেষণা
ঢাকার আবাসিক এলাকায় রাতে হর্ন বাজানোয় নিষেধাজ্ঞা
বিধিমালা অনুযায়ী, নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে নীরব এলাকায় চলাচলের সময় যানবাহনে হর্ন বাজানো দণ্ডনীয় অপরাধ। এই অপরাধের জন্য প্রথমবার অনধিক এক মাস কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডের বিধান আছে। আর কেউ পরবর্তীতে একই অপরাধ করলেও অনধিক ছয় মাস কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
শাস্তি বাড়িয়ে কী করা হবে, সেটি সুনির্দিষ্ট নয়। তবে জরিমানা বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
প্রচার নেই
সচিবালয় এলাকাকে নীরব ঘোষণার পর এই এলাকায় বেশ কয়েকবার ভ্রাম্যমাণ আদালত চালিয়ে কিছু গাড়ির চালককে জরিমানা করা হয়। তবে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালানোর সময় বেশিরভাগ চালকই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেছেন, নীরব এলাকার বিষয়ে তারা আগে থেকে জানতেন না।
এই এলাকায় হর্ন বাজানো নিষেধ জানিয়ে শিক্ষা ভবনের পাশে এবং সচিবালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে দুটি বড় আকারের সাইনবোর্ড বসানো আছে। এর বাইরে সচিবালয়ের এক নম্বর গেইট এবং দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ছোট ছোট দুটি সাইনবোর্ড বসানো হয়েছে। অন্য সড়কগুলোতে নীরব এলাকা সম্পর্কিত কোনো সাইনবোর্ড নেই।
সচিবালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশের সাইনবোর্ডটি গাছের ডালপালার আড়ালে পড়ে যাওয়ায় ভালোমত তা দেখা যায় না। অন্য সাইনবোর্ডটিও শুধু সড়ক বিভাজক ঘেঁষে চলাচলকারীরা দেখতে পাবেন।
সচিবালয়ের সামনের সড়ক দিয়ে গত সাত বছর ধরে গাড়ি নিয়ে চলাচল করেন ব্যাংক কর্মকর্তা সোহেল রানা। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এটি যে নীবর এলাকা এই সড়কে চলার সময় সেটি বোঝার কোনো উপায় নেই। আর সত্যি কথা হচ্ছে ব্যস্ত এই সড়কে গাড়ি চালানোর সময় হর্ন না বাজালে অনেক সময় মানুষ গাড়ির নিচে চাপা পড়বে। পরিবহনগুলোও তো সড়কে চলার সময় নিয়মনীতি মানে, ফলে হর্ন বাজাতেই হয়।”
পল্টন মোড় হয়ে চলাচলকারী একটি বাসের চালক শরিফুল ইসলাম বলেন, “হর্ন না দিলে তা অ্যাক্সিডেন্ট অইব। আর অ্যাক্সিডেন্ট অইলে জরিমানার টাকা কি সরকার দিব? হর্ন না দিয়া এই সড়কে চলা কঠিন।”
শুধুই আশার বাণী
সচিবালয় এলাকাকে নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণার দিন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেছিলেন, পরবর্তী সময়ে হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে নীরব এলাকার বাস্তবায়ন করা হবে।
সাড়ে তিন বছর পর মন্ত্রী বললেন, “বিভিন্ন দূষণ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। এসব বাস্তবায়ন করতে সবার সহযোগিতা লাগবে।”
হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশেপাশকে কেন নীরব এলাকা হিসেবে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না, সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, “পরবর্তী সময়ে আমরা সেখানেও বাস্তবায়নে যাব।”
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফারহিনা আহমেদ জানান, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য এ বছর আরেকটি প্রকল্প নিতে যাচ্ছেন তারা। বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় জুলাই থেকেই শুরু হবে একটি প্রকল্প, যার মাধ্যমে বিআরটিএর সক্ষমতা বাড়ানো হবে।
তিনি বলেন, “ঢাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত চালালে জনগণের ভোগান্তি হয়। ট্রাফিক বিভাগের লোকজনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রত্যেক গাড়িতে নো হর্ন স্টিকার লাগানো হবে। শব্দদূষণ কমাতে শুধু এনফোর্সমেন্ট দিয়ে হবে না, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।”