হয়রানির শিকার নারী চিকিৎসক জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে বিষয়টি ফরিদপুরের সিভিল সার্জনকে জানিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি।
Published : 03 Dec 2024, 12:03 AM
নারী সহকর্মীকে নানাভাবে যৌন হয়রানি করেছিলেন এক চিকিৎসক। হয়রানির শিকার ওই নারী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ করার পর অভিযুক্ত চিকিৎসককে বদলিও করা হয়েছিল।
তবে চার দিন পর ওই বদলির আদেশ পাল্টে যায়। আরেকটি আদেশে অভিযুক্ত ওই চিকিৎসক ফের পুরনো কর্মস্থলে ফিরে এসেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এখন বলছে, অভিযুক্ত চিকিৎসককে পুরনো কর্মস্থলে ফেরানোর আদেশ ভুলবশত হয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে।
অভিযুক্ত ওই কর্মকর্তার নাম মোহাম্মদ ওমর ফয়সল। তিনি ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা। ৩৩ ব্যাচের স্বাস্থ্য ক্যাডারের চিকিৎসক তিনি।
গত ১১ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন হয়রানির শিকার ওই নারী চিকিৎসক।
তিন দিন পর ১৪ নভেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. এবিএম আবু হানিফের স্বাক্ষরে ১৪ জন চিকিৎসককে বদলির প্রজ্ঞাপন হয়। তালিকার ১০ নম্বরে ছিল ডা. মোহাম্মদ ওমর ফয়সালের নাম। ওই প্রজ্ঞাপনে তাকে ফরিদপুরের সদরপুর থেকে বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে বদলি করা হয়।
এরপর ১৮ নভেম্বরে এবিএম আবু হানিফের স্বাক্ষরে আরেকটি প্রজ্ঞাপন হয়। তাতে ১৪ নভেম্বরের আদেশ বাতিল করে ডা. ফয়সালকে পূর্বের পদ এবং কর্মস্থলে বহাল রাখার কথা বলা হয়েছে।
যৌন হয়রানির ঘটনায় অভিযুক্ত চিকিৎসককে বদলির চার দিনের মধ্যেই আগের কর্মস্থলে ফেরানোর অফিস আদেশ কীভাবে হল, জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. এবিএম আবু হানিফ রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নারী চিকিৎসকের অভিযোগের পর মোহাম্মদ ওমর ফয়সলকে বদলি করা হয়েছিল। আগের পদে ফিরিয়ে নেওয়ার আদেশটি ভুলে হয়ে থাকতে পারে।
“তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আছে সেগুলো আমরা তদন্ত করছি। অভিযোগের প্রেক্ষিতে রুটিন হিসেবে প্রথমেই তাকে সেখান থেকে অন্য জায়গায় বদলি করেছিলাম। দ্বিতীয়বারের আদেশটা হয়তো অন্য অসংখ্য বদলি আদেশের ফাঁকে হয়ে গেছে। আমরা শিগগিরই এটা রিভার্স করব।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবু জাফর এ প্রসঙ্গে বলেন, “পুরো বিষয়টি আমি জানি। আমরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলছি। বদলি হওয়ার তিনদিন পরই সে রিটার্ন করেছে। কেন, কীভাবে সেটা আমি জানব।”
সহকর্মীকে নানাভাবে হয়রানি
গত ১১ নভেম্বর ডা. মোহাম্মদ ওমর ফয়সালের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী ওই নারী চিকিৎসক। সহকারী সার্জন পদমর্যাদার ওই কর্মকর্তাও সদরপুর উপজেলায় কর্মরত।
স্বাস্থ্য অধিদ্প্তরের পরিচালকের কাছে দেওয়া অভিযোগপত্রে তিনি বলেছেন, ডা. মোহাম্মদ ওমর ফয়সল দীর্ঘদিন ধরে তাকে উত্যক্ত করেছেন। প্রায়ই মদ্যপ অবস্থায় মধ্যরাতে তার মোবাইলে কল দিতেন মোহাম্মদ ওমর ফয়সল। ফোন না ধরলে হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারে মেসেজ পাঠাতেন। এভাবে দিনের পর দিন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেসেজ ও কলে কুরুচিপূর্ণ, আপত্তিকর প্রস্তাব দিয়েছেন।
তিনি আরও অভিযোগ করেছেন, ডা. ফয়সাল তাকে ভিডিও কল দেওয়ার চেষ্টা, অফিসে ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তার মাধ্যমে মানসিকভাবে হেনস্তা করার চেষ্টা করেছেন। প্রায়ই গভীর রাতে মদ্যপ অবস্থায় ফোন দিয়ে উত্ত্যক্ত করেছেন। তার বাসায় যাওয়া, বিভিন্ন জায়গায় যেতে তাকে চাপ দিতেন বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
এসব অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ এবং মোবাইলে কলের স্ক্রিনশট অভিযোগপত্রের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জমা দিয়েছেন ওই নারী চিকিৎসক।
নারী চিকিৎসকের অভিযোগ, ফয়সালের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় কর্মস্থলে নানাভাবে বাধাবিঘ্ন সৃষ্টি করা হয়েছে। পদ থেকে অপসারণের মাধ্যমে স্টাফদের সামনে হেয় করেছেন তাকে। তাছাড়া রোগীদের সেবাদানে তাকে বিরত রেখেছেন মোহাম্মদ ওমর ফয়সাল।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ওই নারী চিকিৎসক বলেন, “প্রথমদিকে উনার পরিবারের কথা চিন্তা কিছু বলিনি, এড়িয়ে গেছি। কিন্তু তিনি যেভাবে আমার পেছনে লেগেছেন তাতে বিষয়টি নিয়ে আর নীরব থাকা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।”
তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে বিষয়টি ফরিদপুরের সিভিল সার্জনকে জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি।
উল্টো তাকে নিয়ে কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করে সেগুলোর কপি সিভিল সার্জন অফিসে জমা দিয়েছেন ডা. ফয়সাল। ৪ নভেম্বর সিভিল সার্জন তাকে ফরিদপুর সদর হাসপাতালে সংযুক্তি দেন।
অভিযোগের বিষয়ে ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ডা. সাজেদা বেগম পলিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই নারী চিকিৎসক তার কাছে মৌখিকভাবে অভিযোগ করেছিলেন।
“লিখিত অভিযোগ দিলে হয়তো আমি তদন্ত করতে পারতাম। তারপরও আমি ওমর ফয়সালকে ডেকে বিষয়টি জানতে চাই। সে দাবি করে এগুলো (স্ক্রিনশট) তার না, তৈরি করা যায়। বিষয়টি প্রমাণ করা মুশকিল, সেও স্বীকার করেনি। এজন্য কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি।
“আর ওই ঘটনার পর নারী চিকিৎসকের সেখানে ঝামেলা হচ্ছিল। নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমি তাকে অ্যাটাচমেন্টে ফরিদপুর নিয়ে আসি।”
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ডা. মোহাম্মদ ওমর ফয়সালের মোবাইল ফোন এবং হোয়াটঅ্যাপে একাধিকবার কল দেওয়া হয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপে বার্তাও পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তিনি কোনো সাড়া দেননি।