কৃষিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তি দেখতে চান প্রধানমন্ত্রী

“মাঠে কাজ করা বা ফসল ফলানো এটা অত্যন্ত গৌরবের বিষয়, লজ্জার বিষয় নয়,” বলেন তিনি।

গাজীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Feb 2023, 02:31 PM
Updated : 23 Feb 2023, 02:31 PM

সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে কৃষিতেও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেছেন, “চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সাথে তাল মেলাতে- আমরা ন্যানো-প্রযুক্তি, বায়ো-ইনফরমেটিক্স, মেশিন, ইন্টারনেট ও অত্যাধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে জেনেছি। আমাদের এই প্রযুক্তিগুলো কাজেও লাগাতে হবে।”

বৃহস্পতিবার গাজীপুরে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান উদ্বোধনকালে তিনি এ কথা বলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের দেশ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুদ্ধে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, তাই সরকার দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।”

বৈশ্বিক প্রতিকূল পরিস্থিতি ও জলবায়ু পরিবর্তনকে বিবেচনায় নিয়ে খাদ্যশস্যের ফলন বাড়াতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার জন্য কৃষিবিদদের নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, “বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে, আমাদের নিজেদের খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে হবে।

“জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতেও বাংলাদেশকে ঐতিহ্যগত শস্যের পাশাপাশি নতুন জাতের শস্য উৎপাদন করতে হবে।”

তিনি বলেন, “দেশে একটি মাত্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছে। এর মধ্যে দুটি করা হয়েছে কৃষি শিক্ষার জন্য। এ দুটি হচ্ছে দিনাজপুর হাজী দানেশ ও পটুয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়।”

আওয়ামী লীগ সরকারের শেরে বাংলা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

প্রায় আড়াই কোটি শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়ার কথা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, “সরকার বিশেষ করে গবেষণার জন্য বৃত্তি প্রদান করছে। আমি সব সময় মনে করি গবেষণা ছাড়া ভালো কিছু করা সম্ভব নয়।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ হিসেবে সরকার কৃষি গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। পাশাপাশি সরকার স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং বিজ্ঞান গবেষণায়ও দৃষ্টি দিয়েছে।”

কৃষিতে বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে তার বড় মেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমরা কৃষিতে পদক্ষেপ নিয়েছি। কৃষির যান্ত্রিকায়নের জন্য আমরা বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছি।”

কৃষিতে তরুণদের সম্পৃক্ত হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, “অনেক ছেলে মেয়ে লেখাপড়া শিখে মাঠে যেতে চায় না। এমনকি বাবা কৃষক সেটা বলতেও লজ্জা পেত। আজকে কিন্তু সেই লজ্জাটা আর নাই। সে লজ্জাটা আমরা ভেঙে দিয়েছি।

“করোনাকালীন সময়ে যখন আমাদের কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না, ধান কাটতে আমি যখন আমাদের ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে সহযোগী সংগঠনের সকল ছেলে-মেয়েকে নির্দেশ দিলাম- তোমরা মাঠে যাও, ধান কাটো, কৃষকের পাশে থাকো। তারা কিন্তু ধান কেটেছে।…মাঠে কাজ করা বা ফসল ফলানো এটা অত্যন্ত গৌরবের বিষয়, লজ্জার বিষয় নয়।”

সরকারপ্রধান বলেন, “বাংলাদেশ শুধু খাদ্যশস্য উৎপাদনেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেনি, বরং বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, ফলমূল ও অন্যান্য কৃষিপণ্যও উৎপাদন করে যাচ্ছে।”

ক্রমাগত খাদ্য চাহিদা বেড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সবাইকে মনে রাখতে হবে, দেশের জনসংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও আমরা তাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি।”

শেখ হাসিনা বলেন, ৪০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি মিটিয়ে খাদ্য উদ্বৃত্ত রেখে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করে।

“তারপর বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় আসে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ পুনরায় খাদ্য ঘাটতির সম্মুখীন হয়।”

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে পরের বছরের শুরুতে সরকার গঠন করেই দেশে ২৬ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি দেখতে পায় বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

“এ অবস্থা মোকাবেলায় কৃষি গবেষণা, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আওয়ামী লীগ সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং কৃষকদের মধ্যে উচ্চ ফলনশীল বীজ-সার বিতরণ করে এবং কৃষকদেরকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হয়। এই উদ্যোগের ফলে আমরা খারাপ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে সামনে এগিয়ে যাই।”

তিনি বলেন, “উচ্চ ফলনশীল বিভিন্ন জাতের ফসল চাষ এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করায় কৃষি উৎপাদন পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্রি উচ্চ ফলনশীল বিভিন্ন জাতের ধান উদ্ভাবন করেছে।”

১৯৭০ সালের ১ অক্টোবর যাত্রা করা ব্রি এ পর্যন্ত ১১১ ধরনের ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে, যার মধ্যে ১০৪টি ইনব্রিড, বাকি ৭টি হাইব্রিড।

আর প্রতিকূলতা সহিঞ্চু জাত রয়েছে ২৪টি, যার মধ্যে ১০টি লবণাক্ততা সহিঞ্চু, তিনটি ডুবে যাওয়া সহিঞ্চু, তিনটি খরা সহিঞ্চু, চারটি শীত সহিঞ্চু, দুটি জলোচ্ছ্বাসে ডুবে যাওয়া সহিঞ্চু, একটি আধা গভীর জল এবং দ্বৈত সহিঞ্চু।

দেশের মোট ধানি জমির ৮০ শতাংশেরও বেশি ব্রি ধানের চাষ করা হচ্ছে। জাতীয় ধান উৎপাদনে প্রতিষ্ঠানটির অবদান প্রায় ৯১ শতাংশ।

বিজ্ঞানীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ব্রির বিভিন্ন জাতের ধান উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তি দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।”

প্রধানমন্ত্রী ব্রি’র সুবর্ণজয়ন্তীর এ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু-পিয়েরে ট্রুডো কৃষি প্রযুক্তি কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন।

টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বহুমুখী গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন অংশীদারিত্বে সহযোগিতার লক্ষ্যে কানাডার সাচকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্লোবাল ইনস্টিটিউট অব ফুড সিকিউরিটির সঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর ব্রিতে কেন্দ্রটি স্থাপিত হল।

প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে ব্রি ও বিএআরসি’র পাঁচটি গবেষণা গ্রন্থের মোড়কও উন্মোচন করেন।

কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন ব্রি মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবির, কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক জিন বালি, গ্লোবাল ইনস্টিটিউট ফর ফুড সিকিউরিটির নির্বাহী পরিচালক স্টেভেন ওয়েব।

এসময় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল উপস্থিত ছিলেন।