“অনেকেই পাশে দাঁড়িয়েছিল। আবার লজ্জা দিতেও ছাড়েনি নিকটাত্মীয়দের কেউ কেউ। এসব বোঝা নিয়েই চলে গেল মেয়েটি।”
Published : 27 Apr 2025, 11:45 PM
তিন সন্তানকে নিয়ে পটুয়াখালীর দুমকিতে যাওয়ার কথা ছিল মায়ের; গেলেন ঠিকই, কিন্তু বড় মেয়ের লাশের সঙ্গী হয়ে।
বোনের পরিবারের জন্য এমন আফসোস করতে করতে কাঁদছিলেন পটুয়াখালীতে ধর্ষণের শিকার হওয়া সেই শহীদকন্যার এক মামা।
শনিবার রাতে আত্মহত্যা করে সেই শহীদকন্যা। রোববার ঢাকা থেকে তার লাশ নেওয়া পটুয়াখালীতে। এদিন তার দাফনও সম্পন্ন হয়।
ঢাকা থেকে লাশ নিয়ে স্বজনদের যাত্রা শুরুর আগে এদিন দুপরে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে কথা হয় তার মামার সঙ্গে।
তিনি বলছিলেন, তার বোনের পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন তার স্বামী, যিনি একটি বেসরকারি কোম্পানির গাড়ি চালাতেন।
তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনে স্বামী মারা যাওয়ার পর তিন সন্তানকে নিয়ে অকুল পাথারে পড়েন এ নারী। অগাস্টের পট পরিবর্তনের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সরকারের ‘জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ পাশে এসে দাঁড়ায়। এরপর তিন সন্তানকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর যুদ্ধে নামেন তিনি।
মামা বলেন, গত মার্চে তার কিশোরী কন্যা পটুয়াখালীর দুমকিতে বাবার কবর জিয়ারত শেষে নানার বাড়ি যাওয়ার পথে ধর্ষণের শিকার হয়। তার ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ারও হুমকি দেয় ধর্ষণকারীরা।
এরপর ক্ষোভে, লজ্জায় মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় ভাইদের কাছাকাছি থাকতে শুরু করেন ওই নারী। অনেকেই পাশে দাঁড়িয়েছিল। আবার লজ্জা দিতেও ছাড়েনি নিকটাত্মীয়দের কেউ কেউ। এসব বোঝা নিয়েই চলে গেল মেয়েটি।
সম্প্রতি তিন সন্তানকে নিয়ে আদাবরে শেখেরটেকের একটি ভাড়া বাসায় ওঠেন এই নারী। ধর্ষণের শিকার মেয়েটিই সবার বড়; সে পটুয়াখালীর একটি কলেজে পড়ত; সামনে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল।
মেজ সন্তানকে মোহাম্মদপুরের একটি আবাসিক মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হয়েছে। আর ছেলেটি এখনও মায়ের কোলেই।
শনিবার রাতের ঘটনা বর্ণনা করে মেয়েটির মামা বলেন, রোববার তিন সন্তানকে নিয়ে মেয়েটির মা গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী যেতে চেয়েছিলেন। সেজন্য শনিবার রাতে মাদ্রাসা থেকে ছোট মেয়েকে আনতে যান তিনি।
“যাওয়ার আগে বড় মেয়েকে বলে যান, সে যেন মন দিয়ে পড়াশোনা করে, সামনে তার পরীক্ষা। এরপর কোলের ছেলেকে নিয়ে মা বাসা থেকে বের হয়ে মেয়েকে আনতে মাদ্রাসায় যান। কিছুক্ষণ পর বাসায় ফিরে দেখেন, ভেতর থেকে দরজা বন্ধ।’
মামা বলেন, “এরপর তার মা চিৎকার শুরু করলে আশপাশ থেকে প্রতিবেশীরা এসে দরজা ভেঙে মেয়েটিকে ঝুলন্ত অবস্থায় পায়। তারা দ্রুত মেয়েটিকে নামিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করে।”
মেয়েটির মৃত্যুর খবর শুনে মোহাম্মদপুরের স্থানীয় কয়েকজন বিএনপি নেতাসহ জুলাই ফাউন্ডেশনের নেতৃস্থানীয়রা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আসেন।
পরের দিন সকালে তার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। এরপর দুপুরে লাশবাহী গাড়ি রওনা হয় পটুয়াখালীর উদ্দেশে।
এর মধ্যে কবর খোঁড়া ও জানাজার স্থান প্রস্তুতের কাজ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ১৭ বছর বয়সী কিশোরীর দাদা। দাদা নিজেই কাঁদতে কাঁদতে নাতনির জন্য কবর খুঁড়েছেন।
মেয়েটির চাচা বলেন, "সে অত্যন্ত সাহসী মেয়ে ছিল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সে বুক চিতিয়ে লড়েছিল। কিন্তু বিচারহীনতার ভয়, সমাজের অবজ্ঞা ও মানসিক চাপ তাকে ভেঙে দিল। আজ সে আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করি এবং এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করি।"
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন এই কিশোরীর বাবা। ১০ দিন পর তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।
এর মধ্যে গত মাসে পটুয়াখালীর দুমকিতে বাবার কবর জিয়ারত করতে যাওয়ার সময় ধর্ষণের শিকার হয় মেয়েটি।
দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনায় ২০ মার্চ দুজনকে আসামি করে মামলা করে কিশোরী।
আসামিদের একজন জনতা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র শাকিব মুন্সি (১৯); আরেকজন স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে।
ওইদিন রাতেই শাকিবকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আরেক আসামিকেও পরদিন আইনের আওতায় নেওয়ার কথা পুলিশ জানিয়েছিল।
মামলার বরাতে পুলিশ জানায়, তার বাবাকে পটুয়াখালীতে দাফন করা হয়। বাবার কবর জিয়ারত করার পর নানা বাড়ি যাওয়ার সময় দুমকি থানা এলাকায় আসামিরা মেয়েটির পিছু নেয়। এক সময় হঠাৎ মুখ চেপে ধরে তাকে সড়কের পাশের একটি বাগানে নিয়ে ধর্ষণ করে। তারা ধর্ষণের ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়।
পরে আলোচিত ওই ধর্ষণের ঘটনার বিচার দাবি করে সমাজের নানা জায়গা থেকে আন্দোলন-প্রতিবাদ হয়, কিন্তু তাতে মেয়েটির আত্মহত্যা ঠেকানো যায়নি।
আরও পড়ুন