Published : 27 Jun 2024, 12:25 AM
যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের বিচার চালিয়ে যাওয়ার রায়ের বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম-আইসিএসএফ এর ট্রাস্টি রায়হান রশিদ।
তার আশঙ্কা, বৃটেনের আদালতের কোনো সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য না হলেও রায়টি ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং এ দেশের বিচার ব্যবস্থাকে বহির্বিশ্বে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে একটি ভিডিওতে মঙ্গলবার রায়ের বিষয়টি তুলে ধরে রায়হান রশিদ বলেছেন, “গত ১৫ বছরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধী, গণহত্যাকারী, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো রায় দিয়েছে। সেগুলো প্রশ্নবিদ্ধ করার একটা চেষ্টা করা হবে যুক্তরাজ্যের আদালতের রায়টিকে একটি রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে দেখিয়ে।
“বাংলাদেশ সরকার যখন রায়গুলো বর্হিঃবিশ্বে উপস্থাপন করতে যাবে, যেমন- বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, ড. ইউনূসের মামলা-এ রকম আরও অনেক মামলার রায় রয়েছে, তখন এক ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হবে এবং বাংলাদেশের আদালতের রায়গুলোর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে।”
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে ২০১৩ সালে মুঈনুদ্দীনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
এ বিষয়ে ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে মুঈনুদ্দীনকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বর্ণনা করে একাত্তরে তার ফৌজদারি অপরাধের বর্ণনা যুক্ত করা হয়। তখনকার ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল প্রতিবেদনটি টুইটারে (বর্তমানে এক্স) শেয়ার করেন।
এতে প্রীতি প্যাটেলের বিরুদ্ধে ৬০ হাজার পাউন্ড ক্ষতিপূরণ চেয়ে মানহানি মামলা করেন দণ্ডিত ঘাতক একাত্তরের আল-বদর নেতা মুঈনুদ্দীন।
মামলাটি ব্রিটিশ হাই কোর্টে দুই দফায় খারিজ হওয়ার পর সুপ্রিম কোর্টে মামলার আবেদন করেন চৌধুরী মুইনুদ্দীন। তার আবেদন আমলে নিয়ে গত ২০ জুন তাকে মামলা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট।
ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টের এমন সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকারকে এ মামলার বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানায় একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ঢাকার কয়েকটি সংগঠন।
মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের আদালতের রায়ের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে বিশেষজ্ঞ আইনজীবীদের নিয়ে গড়ে ওঠা বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক-আইসিএসএফ। এতে উদ্বেগও প্রকাশ করে সংগঠনটি।
একই সঙ্গে বিবৃতিতে তারা এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ারও আহ্বান জানায়।
এবার সংগঠনটির ট্রাস্টি রায়হান রশিদ রায়ের বিষয়টিকে ‘হালকাভাবে’ না নিয়ে সরকারকে ‘সঠিক’ পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন।
ফেইসবুকে ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, “বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে, যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে সে অনুযায়ী বাংলাদেশকে এগোতে হবে। সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আসলে কী ঘটেছিল, যে কারণে যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট এ রায় দিল, সে বিষয়টি আমাদের সকলের জানার প্রয়োজন রয়েছে।
“চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের লিগ্যাল প্রসেসটি হঠাৎ করে হয়নি। এটি গত প্রায় ৪-৫ বছর ধরে চলছে। প্রথমে হাই কোর্ট থেকে এটি শুরু হয়, শেষপর্যন্ত এটি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গেল। এই দীর্ঘসময়ে বাংলাদেশ সরকারের কী কিছু করণীয় ছিল? আমরা অ্যাক্টিভিস্টরা সরকারকে নানা সময় বহুবার বলেছি। কিন্তু তারা তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।”
রায়হান রশিদ বলেন, “এখানে বাংলাদেশ কোনো পক্ষ নয়। কিন্তু অপরাধীর বিষয়গুলো তুলে আনার দরকার ছিল। কেউ সেখানে কনটেস্ট করেনি, তাই এটা একতরফা হয়ে গেছে। যুক্তরাজ্যের আদালতে বাংলাদেশের ভিকটিমদের অবস্থান, বাংলাদেশের আইনব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনের দিকগুলো আনরিপ্রেজেন্টেড থেকে গেছে।”
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়জন শিক্ষক, ছয়জন সাংবাদিক ও তিনজন চিকিৎসকসহ ১৮ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার অভিযোগ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয় আল বদর বাহিনীর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে।
জামায়াতে ইসলামী তখনকার সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পলাতক এ দুই কেন্দ্রীয় নেতার মধ্যে মুঈনুদ্দীন এখন যুক্তরাজ্যে এবং আশরাফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে আছেন।
এর ছয় বছর পর ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কমিশন ফর কাউন্টারিং এক্সট্রিমিজমের তৈরি ‘চ্যালেঞ্জিং হেইটফুল এক্সট্রিমিজম’ বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
বিষয়টি নিয়ে ২০২০ সাল থেকে আদালতে ঘুরছেন চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও তার আইনজীবীরা। হাহ কোর্টে ব্যর্থ হয়ে সুপ্রিম কোর্টে যান তিনি, যেখানে চলতি বছর ২০ জুন ‘মুঈনুদ্দীন (বাদী) বনাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (বিবাদী)’ শিরোনামের রায়ে মুঈনুদ্দীনকে মামলা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে রায় দেয় দেশটির সর্বোচ্চ আদালত।
যুক্তরাজ্যে মুঈনুদ্দীনের মামলাটি শুরুর পর রায়হান রশিদ বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন দাবি করে এদিনের ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, “আমি ভিকটিম ও মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কাজ করছিলাম এ মামলায়। আইনজীবী হিসেবে আমি লিগ্যাল ওপিনিয়ন পাঠিয়েছি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে। কিন্তু আমরা ইতিবাচক সাড়া পাইনি।
“ফলে বাংলাদেশের আদালত ও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে অনেক ধরনের আপত্তিকর পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। এটা আমাদের সরকারের দিক থেকে সীমাবদ্ধতা ছিল।”
তিনি বলেন, “যুক্তরাজ্যে চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের মানহানি মামলাটি যখন শুরু হয়েছিল, তখন আমি এটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি। যুক্তরাজ্যের আদালতে আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন, ভিকটিমদের বিভিন্ন ভার্সন অনেক ক্ষেত্রে ভুলভাবে উপস্থাপন হয়েছে, সেই ভুলের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন পর্যায়ে রায় হয়েছে। এই ভুলগুলো না হলে আমি মনে করি, রায়টি এমন হত না।”
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের কোনো ধারণা না থাকার ফলেই এ ধরনের রায় দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে কাজ করা এই অ্যাক্টিভিস্ট আইনজীবী।
তিনি বলেন, “এখানে চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের আইনজীবীরা যা উপস্থাপন করেছেন, তা রাষ্ট্রপক্ষ কনটেস্ট করতে পারেনি।”
চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ১৯৭৩ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে বাস করেন, যিনি ১৯৮৪ সালে দেশটির নাগরিকত্ব পান।
দেশটির সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়ার প্রক্রিয়াটিতে বাংলাদেশ সরকারের যথেষ্ট ‘ঘাটতি’ রয়েছে বলে ধারণা রায়হান রশিদের।
“চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের ক্ষেত্রে এটি করা উচিত ছিল। অন্য অনেক দেশের ক্ষেত্রে এই ফিরিয়ে আনার বিষয়ে পৃথক চুক্তির প্রয়োজন কিন্তু বাংলাদেশের জন্য সেটি প্রযোজ্য নয়। বাংলাদেশ সরকারের দিক থেকে খুব জোরালো উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেই প্রক্রিয়াটি ঠিকভাবে এগোয়নি।
“রায়ের পরে ইন্টারপোলে চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের নামে রেড নোটিস ইস্যু হয়। এরপরে তার আইনজীবীরা ইন্টারপোলের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করেন, যেন তার নাম সরিয়ে ফেলা হয়। একতরফাভাবে এটা হয় না। হয় বাংলাদেশ সরকার ইন্টারপোলের প্রসেসটি কনটেস্ট করেনি বা করলেও সেই প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে করেনি। সেখানে কোনো ঘাটতি ছিল। এ বিষয়গুলোও আমাদের জানা জরুরি,” বলেন তিনি।
রায়হানের আশঙ্কা যুক্তরাজ্যের এই রায়ের ফলে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য যে আন্দোলন, সেই আন্দোলনটি প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হবে।
এর কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন, “এখন আমরা বাংলাদেশের অ্যাক্টিভিস্টরার যখনই বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার কাছে একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য যাব, তখন যুক্তরাজ্যের এই রায়কে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হবে। এটা দেখানোর জন্য যে, আমাদের গণহত্যার ইতিহাসটি ‘প্রশ্নবিদ্ধ’। এতে আমাদের কাজ আরও বেড়ে গেল।
“এছাড়া একাত্তরের ইতিহাস নিয়ে এখন থেকে যারা লিখবেন, গবেষণা করবেন লেখালেখি করবেন, তাদের কাজগুলো একটি নতুন ধরনের বিপদের সম্মুখীন হবে। ভবিষ্যতের মানহানির মামলার খড়্গ মাথায় নিয়ে লেখক-গবেষকদের কাজ করতে হবে। আমাদের ইতিহাস চর্চার ওপর এর একটি বড় প্রভাব পড়বে।”
আরও পড়ুন:
যুক্তরাজ্যে মুঈনুদ্দীনের মামলা চালানোর সুযোগের নিন্দায় আইসিএসএফ
যুদ্ধাপরাধী মুঈনুদ্দীনের মামলা: ব্রিটিশ আদালতের রায়ে ঢাকায় উদ্বেগ
যুক্তরাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে মামলা চালানোর সুযোগ পেলেন যুদ্ধাপরাধী
যুক্তরাজ্যের আদালতে প্রশ্নবিদ্ধ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং ইতিহাসের ...