শামারুখ মাহজাবিন শ্যামা আত্মহত্যা করেছেন বলে তার শ্বশুর সাবেক সংসদ সদস্য খান টিপু সুলতান দাবি করলেও তা মানতে নারাজ এই চিকিৎসকের সতীর্থরা।
Published : 16 Nov 2014, 06:50 PM
শ্যামাকে হত্যা করা হয়েছে সন্দেহ জানিয়ে তার মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটনে সুষ্ঠু তদন্তের দাবিতে রোববার মানববন্ধন করেছেন হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট কলেজের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা, তাদের সঙ্গে কয়েকজন শিক্ষকও যোগ দেন।
বেসরকারি এই মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে বিএসএমএমইউতে এফসিপিএস করছিলেন শ্যামা, যার ঝুলন্ত লাশ গত বৃহস্পতিবার ধানমণ্ডিতে তার শ্বশুর বাড়িতে পাওয়া যায়।
যশোরের আওয়ামী লীগ নেতা টিপুর স্ত্রী জেসমিন আরা বেগম এই মেডিকেল কলেজেরই শিক্ষক, যিনি শ্যামার পরিবারের দায়ের করা হত্যামামলার তিন আসামির একজন।
শ্যামার স্বামী হুমায়ুন সুলতান এই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এখন পুলিশ রিমান্ডে রয়েছেন। টিপু ও তার স্ত্রী রোববারই হাই কোর্ট থেকে আগাম জামিন নিয়েছেন।
শ্যামা হত্যারহস্য উদ্ঘাটনে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি নিয়ে রোববার বেলা সাড়ে ১২টায় সড়কে নেমে আসেন রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা।
মেডিকেল কলেজের সামনে এই মানববন্ধনে সাবেক-বর্তমান মিলিয়ে শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন, যারা কজে জীবনে শ্যামার নানা তৎপরতার কথা তুলে ধরেন।
“শ্যামা ছিল কলেজের সবার পরিচিত। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতৃত্বেও ছিল সে,” বলেন তার সহপাঠী সাব্বির রহমান।
২০১১-১২ সালে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট কলেজ ডিবেট ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শ্যামা। কলেজে এনডিএফ রানিং ব্লাড ব্যাংক নামে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠনও গড়ে তুলেছিলেন তিনি।
হাসপাতালে রক্তের জন্য কেউ এলে বা কেউ ভর্তি হলে তার রক্তের দরকার হলে শ্যামা তার আয়োজন করে দিত, বলেন তার সহপাঠীরা।
তবে দুই বছর আগে হুমায়ুনকে বিয়ের পর থেকে শ্যামা নিজেকে অনেক গুটিয়ে নিয়েছিল বলে সাব্বির জানান।
একই ছাত্রী হোস্টেলে ৫ বছর শ্যামার সঙ্গে থাকা ডা. সেজুতি বলেন, শ্যামা খুব চাপা স্বভাবের ছিল। নিজের ব্যক্তিগত বিষয়ে কারো সঙ্গে কথা বলত না। বিয়ের আগে কলেজের সব অনুষ্ঠানের মধ্যমনি থাকত সে। বিয়ের পর নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছিল।
“বিয়ের পর নাইট ডিউটি করত না শ্যামা। অনেকে ভাবত, তার শাশুড়ি কলেজটির শিক্ষক দেখে শ্যামা হয়ত বাড়তি সুবিধা ভোগ করছে। আমরা অনেকেই ওকে ভুল বুঝেছিলাম,” বলেই কেঁদে ফেলেন তিনি।
সেঁজুতি বলেন, শ্বশুর বাড়ির আপত্তির কারণে শ্যামা বন্ধু, সহপাঠী ও আত্নীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছিল বলে পরে তারা জেনেছেন।
আরেক সহপাঠী ডা. আবিদা সুলতানা ঐশী বলেন, “শ্যামার মতো মেয়ে আত্নহত্যা করেছে, এটা কেউ বিশ্বাস করবে না। তার দেহে আঘাতের চিহ্ন ছিল। গলায় নখের আচড়ের দাগ ছিল এটা সবাই দেখেছে।
“আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাই। কেউ যেন এ ঘটনাকে প্রভাবিত না করতে পারে সে দাবি জানাই।”
কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান ভূঁইয়াও শ্যামার প্রশংসায় পক্ষমুখ- “শ্যামা আমার ছাত্রী ছিল। ওকে আমি চিকিৎসক বানিয়েছি। খুব ভাল ডিবেটার ছিল মেয়েটি।”
বাইরে শিক্ষার্থীদের কর্মর্সূচির মধ্যে তার কার্যালয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা হয় অধ্যক্ষের।
রোগী দেখার ব্যস্ততা থাকায় মানববন্ধনে অংশ নিতে পারেননি জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার মৌন সমর্থনেই তো শিক্ষার্থীরা মানববন্ধনে অংশ নিয়েছে। তা নাহলে তো তারা এ আয়োজন করতে পারত না।”
শ্যামার শাশুড়ি জেসমিন আরা বেগম পুত্রবধূর মৃত্যুর পর থেকে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে অকালীন ছুটিতে রয়েছেন বলেও জানান তিনি।
মামলার আসামি হওয়ায় ডা. জেসমিনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না- জানতে চাইলে অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান বলেন, “কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেবে কি না, তা তো এখন বলা যাচ্ছে না। তদন্ত চলছে, এমন কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না।”
শিক্ষার্থীদের মানববন্ধনে অংশ নিয়ে নিহতের মামা কাজী ফিরোজুর রহমান বলেন, “শ্যামা বাথরুমে আত্মহত্যা করতে পারে না। কারণ সেখানে সেই সুযোগ বা পরিস্থিতি নেই।”
পিডব্লিউডির অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী যশোরের বাসিন্দা শ্যামার বাবা নুরুল ইসলাম মেয়ের মৃত্যুর খবর শুনেই ঢাকায় এসে জামাতা, বেয়াই ও বেয়ানের বিরুদ্ধে হত্যামামলা করেন। শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের ওপর নির্যাতনের অভিযোগও তার।
মামা ফিরোজ দাবি করেন, টিপু সুলতানের ছেলে কয়েক মাস আগেও শ্যামাকে দিয়ে তার বাবার কাছে সোফা কেনার জন্য ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা, ফ্রিজ কেনার জন্য দেড় লাখ ও এসি কেনার জন্যও টাকা নিয়েছিল।
“তারপরও কোন অপরাধে আমাদের মেয়েটাকে মেরে ফেলল,” বলেই পর কেঁদে ফেলেন তিনি।
ফিরোজের অভিযোগ, শ্যামাকে হত্যা করা হয়েছে এবং এখন ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পক্ষে নিতে টিপু সুলতান প্রভাব খাটাচ্ছেন।
শ্যামার বাবা মামলা দায়েরের পর টিপুর ছেলে হুমায়ুনকে বৃহস্পতিবার রাতেই গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রোববার তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।